ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মোয়াজ্জেমুল হক

বহুরূপী জামায়াত কি নতুন রূপ ধারণ করছে?

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২৪ অক্টোবর ২০১৬

বহুরূপী জামায়াত কি নতুন  রূপ ধারণ করছে?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত একটি ঘৃণিত নাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এ দলের নাম ছিল পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী। স্বাধীনতার পর নাম পরিবর্তন করে এটি হয়ে যায় জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। দীর্ঘ সময় পর এ দল আবার নাম পরিবর্তন করে হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। যতভাবে যত প্রক্রিয়ায় এই দল নাম পরিবর্তন করুক না কেন দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে দেশ বিদেশে পরিচিত। ইতোমধ্যেই এ দলের শীর্ষস্থানীয় কয়েক নেতার যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার হয়েছে। বিচারের রায় সর্বোচ্চ আদালত গড়িয়ে কার্যকরও হয়েছে। দলটি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সঙ্গে জোট বেঁধে এখনও নিজেদের কোন রকমে অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রেখেছে। বর্তমান শাসকগোষ্ঠী অর্থাৎ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে হেন কোন অপকর্মে এ দলের ক্যাডার ও সন্ত্রাসীরা লিপ্ত হয়নি এমন রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যাবে না। সর্বশেষ এ পর্যন্ত দলের শীর্ষস্থানীয় ৭ নেতার বিচার ও বিচারের রায় কার্যকর হওয়ার পর অতিসম্প্রতি স্বাধীনতাবিরোধী এ দলটি রাজনীতিতে নতুন রূপে আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের তকমা মাথায় নিয়ে এ দলের আমিরের নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন মকবুল আহমদ। ইতোপূর্বে দলের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী যুদ্ধাপরাধে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে মকবুল আহমদ ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আমির নির্বাচিত হওয়ার পর রাজধানীর একটি মিলনায়তনে এটিএম মকবুল আহমদকে শপথ পাঠ করানো হয়। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, শপথ নেয়ার পর যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের নতুন এই আমির স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। পাশাপাশি স্মরণ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, ন্যাপ নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীসহ স্বাধীনতা সংগ্রামে অবিসংবাদিত নেতাদের। জামায়াতের প্রচার বিভাগের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য দিয়ে বলা হয়েছে, নতুন আমির স্বাধীনতা সংগ্রামের এসব নেতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেছেন। বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রচার পাওয়ার পর ইতোমধ্যেই জামায়াতের এই তৎপরতাকে অপতৎপরতার অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী’, ‘কয়লার ময়লা ধুলেও যায় না।’ এসব প্রবাদ বাক্য শতভাগ সঠিক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বহু আগে থেকে। যে দলটি এদেশের স্বাধীনতা চায়নি। শুধু তাই নয়, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এ দলটির নেতাকর্মীরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী হয়ে এদেশের বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মানুষসহ সাধারণ নারী-পুরুষকে অকাতরে মেরেছে, তাদের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ওই কর্মকা- যে ভুল ছিল তজ্জন্য ক্ষমা চাওয়া হয়নি। বরঞ্চ ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের কোন কোন নেতা এমন বক্তব্যও দিয়েছেন যে, মুক্তিযুদ্ধে তাদের কর্মকা- সঠিক ছিল। বর্তমানে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যে জামায়াতের নেতাসহ চিহ্নিতদের যখন বিচার শুরু হয়েছে এবং দেশে বিদেশে লবিং করেও যখন তা ঠেকানো যায়নি এখন তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কথা। বিষয়টি বিস্ময়কর বটে। এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, ১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকা কি জঘন্য ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হত্যা, গুম, ধর্ষণ, জ্বালাও পোড়াও থেকে হেন কোন অপকর্ম নেই যা এরা করেনি। এ দলটির সদস্যরা আধা সামরিক বাহিনী, শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর গঠন করে স্বাধীনতাকামী বাঙালীদের নিধনে লিপ্ত ছিল। এরপরও বাংলাদেশের স্বাধীনতা তারা ঠেকাতে পারেনি। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার জামায়াতকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এ পরিস্থিতিতে জামায়াতের বেশকিছু নেতা পাকিস্তানে চলে যান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা পরবর্তী সময়ে সেনা নায়ক জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করে জামায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে পাকিস্তানে চলে যাওয়া জামায়াতী নেতারা দেশে ফিরে আসার সুযোগ পায়। শুধু তাই নয়, তাদের শীর্ষ নেতা গোলাম আযমের নাগরিকত্বও প্রদান করা হয়। প্রসঙ্গত, ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের আগে ১৯৪১ সালে পাকিস্তানের লাহোরে সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী জামায়াতে ইসলামী হিন্দ নামে যে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেটিই এখন বাংলাদেশে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ নামকরণ হয়েছে। স্বাধীনতার পর এ দলটির নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। মূলত ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এ দলটি অপরাজনীতিতে জড়িত। আর এ কারণে এ দলের সদস্যরা ১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হয়। ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাতা তখন ভারপ্রাপ্ত আমিরের পদটি পেয়েছিলেন আব্বাস আলী খান। ২০০১ সালে সংসদ নির্বাচনে এ দলটি ৩শ’ আসনের মধ্যে ১৪টিতে জয়লাভ করে। পরবর্তীতে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে এরা সরকার গঠন করে। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদকে মন্ত্রীর পদ দিয়ে জাতীয় পতাকার অবমাননা করেন। এ ঘটনাটি মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির প্রতি চরম উপহাস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ক্যাডারভিত্তিক এ দলটির নিবন্ধন অবৈধ এবং এ সংগঠনটিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য ঘোষণা করেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের বিভিন্ন দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে এ দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণার জোর দাবি রয়েছে। এ অবস্থায় মানবতাবিরোধী অপরাধে শীর্ষ ৫ নেতার ফাঁসি হওয়ার পর দলটি বিপাকে পড়ে। এ ছাড়া সর্বোচ্চ নেতা গোলাম আযম আমৃত্যু কারাদ-ে দ-িত হয়ে জেল অভ্যন্তরে মৃত্যুবরণ করেছেন। এর পাশাপাশি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আমৃত্যু জেল খাটার সর্বোচ্চ আদালতের রায় নিয়ে বেঁচে আছেন। এ অবস্থায় নানা চড়াই-উতরাই শেষে ইতোমধ্যে এরা অতি গোপনে সম্মেলন করেছে এবং সে সম্মেলনে দলের নতুন নেতা নির্বাচন করা হয়েছে মকবুল আহমদকে। এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, বর্তমানে দেশজুড়ে যে জঙ্গী তৎপরতার উত্থান ঘটেছিল এর নেপথ্যে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা ও ইন্ধন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যে রয়েছে তা প্রমাণিত। এ অবস্থায় এরা নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার প্রয়াস নিয়ে নতুন রূপে আবির্ভূত হওয়ার ফর্মুলা নিয়েছে। যে ফর্মুলায় তারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে আর স্মরণ করছে বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, আসলে বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে সন্দেহজনক। জামায়াতের যেসব নেতার মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি হয়েছে কেউ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষাও চায়নি। কারণ, প্রাণভিক্ষা চাইতে গেলে মুক্তিযুদ্ধে তাদের তৎপরতা ভুল ছিল বলে স্বীকার করে নিতে হবে। যা তারা কেউ করেনি এবং আগামীতেও যারা বিচারের কাঠগড়ায় যাবে তাদের পক্ষ থেকেও কেউ প্রাণভিক্ষা চাইবে বলে ধারণা করা হয় না। অথচ এদিকে দলের নতুন আমির নির্বাচিত হয়ে মকবুল আহমদের বক্তব্যে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুকে স্মরণের যেসব কথা বেরিয়ে এসেছে তা কি জামায়াতের রূপ পাল্টানোর নতুন কৌশল কিনা, তা কি সন্দেহের উর্ধেÑ এমন জিজ্ঞাসা ও প্রশ্ন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। লেখক : সাংবাদিক
×