ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সিটিসেল বন্ধের নেপথ্যে- নেতৃত্বের অভাব, বিনিয়োগ ব্যর্থতা

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৪ অক্টোবর ২০১৬

সিটিসেল বন্ধের নেপথ্যে- নেতৃত্বের অভাব, বিনিয়োগ ব্যর্থতা

ফিরোজ মান্না ॥ সিটিসেল বন্ধের পেছনে উক্ত প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের কৌশলগত ভুলই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের পাওনা ধাপে ধাপে পরিশোধ করার সুযোগ পেয়েও বার বার সেই সুযোগ হাতছাড়া করেছে তারা। দেড় বছর হাতে সময় পেয়েও দেনা শোধে কোন প্রকার উদ্যোগ নেয়নি সিটিসেল কর্তৃপক্ষ। মোবাইল অপারেটর সিটিসেলের বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে ‘কৌশলগত ভুলই’ দেখছেন টেলিকম সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সুযোগ থাকার পরও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ও বিনিয়োগের ব্যর্থতা প্রতিষ্ঠানটির পতনের জন্য দায়ী। খোদ সিটিসেলের কয়েকজন উর্ধতন কর্মকর্তা এ কথা বলেন। সিটিসেল পরিচালনাকারী প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মেহবুব চৌধুরীও নিজেদের কৌশলগত ভুল স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, সিডিএম থেকে জিএসএমে না যাওয়া সিটিসেলের একটা বড় ভুল ছিল। সময় মতো এ সুযোগ কাজে না লাগানোর জন্যই আজকের এই অবস্থা। বিটিআরসি সূত্র জানিয়েছে, সিটিসেলকে গত ১৬ আগস্ট পর্যন্ত পাওনা পরিশোধের জন্য শেষ সময় বেঁধে দিয়েছিল বিটিআরসি। কিন্তু সিটিসেল কর্তৃপক্ষ এই সুযোগটিও গ্রহণ করেনি। তারা আইনের আশ্রয় নিয়েছিল। বিটিআরসির সুযোগটি কাজে লাগালে তরঙ্গ বাতিল হয় না- অপারেশনাল কার্যক্রমও বন্ধ হতো না। এখানেই তাদের কৌশল গত বড় ভুল। এর বাইরে অন্য কোন কিছু নেই। রাজনৈতিক বা অন্য কোন স্বার্থ নেই সিটিসেল বন্ধের পেছনে। এদিকে সিটিসেলের কর্মকর্তা আশরাফুল করিম বলেন, সিটিসেলের তরঙ্গ বাতিল করা হয়েছে, লাইসেন্স তো বাতিল করেনি। আলোচনা হচ্ছে, আবার কিভাবে সিটিসেল চালু হতে পারে। সিটিসেলের কার্যক্রম বন্ধ হলেও অপারেটরটি আবার চালু হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে চলে যায়নি। সূত্র জানিয়েছে, লাইসেন্স নবায়নের সময় টেকনোলজি নিউট্রালিটির (যে কোন সেবা দেয়া) লাইসেন্স পেয়েছিল। তবে জিএসএমে যাওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করতে না পারায় তরঙ্গ বুঝে পাওয়া যায়নি। এ কারণে জিএসএমে যাওয়া যায়নি। টাকা জমা সাপেক্ষে যে কোন সময় জিএসএমে যাওয়ার কথা রয়েছে জানিয়ে মেহবুব চৌধুরী বলেন, তবে বিটিআরসি তরঙ্গ নিয়ে পরিষ্কার করেনি। আমাকে ১০ (মেগাহার্টজ তরঙ্গ) দেয়ার কথা সেখানে বিটিআরসি দিয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৫ বা ৮ মেগাহার্টজ। এ কারণে জিএসএম (সিম) প্রযুক্তিতে যেতে পারিনি। অবশ্য বিটিআরসি জানিয়েছে, সিটিসেলকে দুই দফায় ১৮ মেগাহার্টজ তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তারা এই তরঙ্গ বসিয়ে রেখেছে। কাজে লাগায়নি। এ জন্য বিটিআরসি কোনভাবেই দায়ী নয়। বিটিআরসির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. শাজাহান মাহমুদ বলেন, সিটিসেলের কাছে বিটিআরসির পাওনা রয়েছে ৪৭৭ কোটি টাকা। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তাদের দিতে হতো ৩১৮ কোটি টাকা। কিন্তু তারা ১৩০ কোটি টাকা দিয়েছে। আর এনবিআরকে দিয়েছে ১৪ কোটি টাকা। বাকি টাকা তারা পরিশোধ করেনি। তাই তাদের তরঙ্গসহ সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তরঙ্গ ফি বাবদ প্রতিষ্ঠানটির কাছে বিটিআরসির পাওনা ছিল ২২৯ কোটি টাকা। বাকি ২৪৮ কোটি টাকা অন্যান্য খাতে পাওনা। এই টাকা আদায়ের জন্য বিটিআরসি গত দেড় বছর ধরে সিটিসেলকে চিঠি দিয়ে এসেছিল। কিন্তু তারা বিটিআরসির চিঠির কোন গুরুত্ব দেয়নি। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার তাদের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, তৃতীয় প্রজন্মের (থ্রিজি) মোবাইল প্রযুক্তির সেবার নিলামের জন্য যোগ্য বিবেচিত হয়েও দুই কোটি ডলারের আর্নেস্ট মানি জমা দিতে না পারায় থ্রিজি সেবা থেকে সরে আসে ১৯৮৯ সালে মোবাইল ও ফিক্সড ফোনের লাইসেন্স পাওয়া প্রতিষ্ঠান সিটিসেল। ২০১২ সালে লাইসেন্স নবায়নের সময় সিডিএমএ (কোড ডিভিশন মাল্টিপল এ্যাকসেস) থেকে মাত্র ২শ’ কোটি টাকায় জিএসএম (টুজি বা দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তি) প্রযুক্তিতে যাওয়ার সুযোগও পেয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (বিটিএল) নামে টেলিকম সেবা পরিচালনার লাইসেন্স পায় সিটিসেল। পরের বছর হংকং হাচিসন টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেড এ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে বিটিএল নাম বদলে হয় হাচিসন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (এইচবিটিএল)। ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় আবার পরিবর্তন আসে। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিএনপি নেতা মোরশেদ খানের মালিকানাধীন প্যাসিফিক মোটরস ও ফারইস্ট টেলিকম মিলে এইচবিটিএলর শেয়ার কিনে নেয়। এবার কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড। এই নামে ব্র্যান্ডিং শুরু করে। সর্ব শেষ নাম বদল করে রাখা হয় সিটিসেল। ২০০৪ সালে এ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে সিঙ্গাপুরের সিংটেল। প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেডের (সিটিসেল) সর্বশেষ ৩৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক বিএনপি নেতা এম মোরশেদ খান। ৪৫ শতাংশ সিঙ্গাপুরভিত্তিক সিংটেলের। বাকি ১৭ দশমিক ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক ফারইস্ট টেলিকম লিমিটেড। এই কোম্পানিটিও মোরশেদ খানের। মোট মালিকানার ৫৫ শতাংশের মালিক হচ্ছেন মোরশেদ খান। বাকি ৪৫ শতাংশের মালিক সিংটেল। সিটিসেলের কয়েকজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, ভাল বিনিয়োগকারী যোগাড় করতে না পারা, প্রযুক্তিগত দূরদৃষ্টি ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় দক্ষ নেতৃত্বের অভাব এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন। তখনই বলা হয়েছিল এসব বিষয়ে নজর না দিলে প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। দিন দিন প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু সিটিসেল নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করেনি। সব সুযোগ থাকার পরেও পুরনো এই প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে যেতে পারেনি। কারণ প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় দক্ষ ম্যানেজমেন্ট ছিল না। শেষের দিকে প্রতিষ্ঠানটি চলেছে হাল ভাঙ্গা নৌকার মতোই। অর্থ সঙ্কেটে ভুগতে থাকলেও সিটিসেল ভাল বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করে তুলতে পারেনি। তাছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করেছিল। এই দুর্নীতির সঙ্গে মালিক পক্ষের লোকজনই জড়িত ছিল। ফলে প্রতিষ্ঠানটি দিন দিন রুগ্ন হয়ে পড়ে। মোবাইল টেলিকম অপারেটরদের সংগঠন এ্যামটবের সাবেক মহাসচিব আবু সাঈদ খান বলেন, ফিক্সড ও মোবাইল ফোনের লাইসেন্স থাকার পরও সিটিসেল বছরের পর বছর ফিক্সড লাইসেন্স ‘অবহেলা’ করে গেছে। সে সময় যে চাহিদা ছিল তা কাজে লাগালে প্রতিষ্ঠানটি অনেক এগিয়ে যেতে পারত। সিটিসেলের সবই ছিল, তবে তাদের স্ট্র্যাটেজিক ভিশনারি ছিল না। সিডিএমএ কাভারেজ এরিয়া জিএসএমের চেয়ে অনেক বেশি, থ্রিজি লাইসেন্স দেয়ার আগেই তারা থ্রিজি প্রযুক্তি নিয়ে বসে ছিল। সব সুযোগ পেয়েও কেন তারা কোন সুযোগ কাজে লাগায়নি। তাদের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য সিংটেলের মতো স্বনামধন্য অপারেটর শেয়ার পেয়েও এমন অবস্থায় কেন যে পড়ল সেটাই ভেবে দেখার বিষয়। সিটিসেলের বর্তমান অবস্থার জন্য প্রতিষ্ঠানটির সিইও মেহবুব চৌধুরীরও সমালোচনা করেন। সিটিসেলের একজন সাবেক কর্মকর্তাও একই অভিযোগ করেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, মেহবুব চৌধুরী সিইও হিসেবে যোগ দেয়ার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির অধঃপতন শুরু হয়। ২০১০ সালে মেহবুব চৌধুরী সিটিসেলের সিইওর দায়িত্ব নেয়ার সময় সিটিসেলের গ্রাহক সংখ্যা ছিল প্রায় ২৩ লাখ। সর্বশেষ গত জুনে গ্রাহক সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৭ লাখেরও কম। এসব বিষয়ে মেহবুব চৌধুরী বলেন, বিনিয়োগ আনতে পারিনি এটা ঠিক, তবে আমরা চেষ্টা করেছি। যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানি বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। সিটিসেলের জিএসএমে না যাওয়ার সিদ্ধান্তকে ভুল বললেও সেটা তার সিদ্ধান্ত ছিল না দাবি করে মেহবুব চৌধুরী বলেন, জিএসএমে না গিয়ে থ্রিজিতে যাওয়া যায় না। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে কোন কথা তিনি বলেননি। যারা বলছে তারা অজ্ঞ। এই প্রতিষ্ঠানে যারা বিনিয়োগ করেছে তারা সরকারের অনুমতি নিয়েই করেছে। ব্যবসা হচ্ছে বলেই তো বিনিয়োগ করেছে।
×