ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বড় হামলার ছক ছিল নব্য জেএমবির

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৪ অক্টোবর ২০১৬

বড় হামলার ছক ছিল নব্য জেএমবির

শংকর কুমার দে ॥ দেশের ভেতরে সক্রিয় জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ (হুজি) আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), হিযবুত তাহরীরসহ জঙ্গী সংগঠনগুলোকে একই প্লাটফর্মে এনে ঐক্যবদ্ধ জঙ্গী সংগঠন করে বড় ধরনের জঙ্গী হামলার পরিকল্পনা করেছিল নব্য জেএমবি। বিজিবি ক্যাম্প, পুলিশ স্টেশন, সেনা ছাউনি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ (ভিআইপি) ব্যক্তিদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেছিল জঙ্গী সংগঠনটি। কিন্তু নব্য জেএমবির কথিত খিলাফত প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বিরোধিতা থাকায় অন্যান্য জঙ্গী সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্মে আনা সম্ভবপর হয়নি। এমনকি নব্য জেএমবির দাওয়াত পর্যন্ত ফিরিয়ে দিয়েছে জেএমবি। নব্য জেএমবির প্রধান নিহত আবদুর রহমান ওরফে সারোয়ার জাহান ওরফে আবু ইব্রাহিম আল হানিফের সাভারের আশুলিয়ার বাড়ির জঙ্গী আস্তানা থেকে উদ্ধারকৃত ই-মেইল, মোবাইল ফোনের এসএমএস, চিঠিপত্র, তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে, তদন্তে ও গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে এ ধরনের তথ্য পেয়েছে র‌্যাব ও গোয়েন্দারা। গত ১৩ বছর ধরে আত্মগোপনে থেকে জঙ্গী তৎপরতায় থাকা গুলশান হামলাসহ সাম্প্রতিক ২২ হামলার নেতৃত্ব দেয়ার পর আবদুর রহমান ওরফে সারোয়ার জাহান ওরফে আবু ইব্রাহিম আল হানিফ নিহত হয়েছে বলে র‌্যাবের দাবি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, গত শুক্রবার রাজধানীর বিএসইসি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলন করে র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেছেন, গত ৮ অক্টোবর ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় র‌্যাবের অভিযান চলাকালে পাঁচতলা থেকে পড়ে নিহত ব্যক্তি আবদুর রহমান ছিলেন নব্য জেএমবির প্রধান সারোয়ার জাহান ওরফে সাংগঠনিক নাম শায়খ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ। ওই সংবাদ সম্মেলনে এই জঙ্গীনেতার আশুলিয়ার বাসা থেকে পাওয়া বিভিন্ন চিঠিপত্র, সাংগঠনিক প্রতিবেদন, খুদে বার্তার যোগাযোগ, পাঠ্যক্রম, হামলার লিখিত পরিকল্পনা ইত্যাদি দেখানো হয়। এছাড়াও আবদুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী নাফিস আহমেদ নয়ন ও হাসিবুল হাসানকে ২৭ লাখ ৭০ হাজার টাকাসহ গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের হেফাজতে পেতে রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, নব্য জেএমবি প্রধান আবদুর রহমানের আশুলিয়ার বাসা থেকে পাওয়া বিভিন্ন চিঠিপত্র, সাংগঠনিক প্রতিবেদন, খুদে বার্তার যোগাযোগ, পাঠ্যক্রম, হামলার লিখিত পরিকল্পনা ইত্যাদি দেখিয়ে বেনজীর আহমেদ বলেন, আবদুর রহমানের ই-মেইল, মোবাইলের এসএমএস, ৯টি চিঠি গ্রহণ ও ১০টি চিঠি বিতরণের তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর এখন বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এই জঙ্গীনেতার আশুলিয়ার বাসায় পাওয়া চিঠিতে উল্লেখ আছে, এখন আমাদের কাছে (নব্য জেএমবি) ৩০০ সৈন্য, ২০টি আধা স্বয়ংক্রিয় ও ৯টি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং কিছু হ্যান্ড গ্রেনেড আছে। জেএমবি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পুলিশ স্টেশন, ছোট আকারের সেনা ও বিজিবি ক্যাম্পে হামলা চালাতে সক্ষম এবং তারা সাধারণ নাগরিকদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান, নাস্তিক ও মুরতাদদের ওপর হামলা (অপারেশন) চালাচ্ছে বলে উল্লেখ আছে উদ্ধার করা চিঠিতে। চিঠিতে লেখা আছে, জঙ্গীনেতা আবদুর রহমানের আশুলিয়ার বাসায় পুরনো জেএমবির প্রধান মাওলানা সাইদুর রহমান ও সালাহউদ্দীন ওরফে সালেহীনের নেতৃত্বাধীন জেএমবির অংশটিকে আমাদের দিক থেকে বারবার দাওয়াত দেয়া সত্ত্বেও খিলাফতের যৌক্তিকতা ও ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তারা। তাদের বেশিরভাগ নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য কারাবন্দী থাকার কারণে এখন খুব বেশি সংগঠিত এবং ভাল কাঠামোতে নেই। নব্য জেএমবির সঙ্গে পুরনো জেএমবির বিরুদ্ধাচরণ এতই বেশি যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। পুরনো জেএমবিকে নব্য জেএমবির বিরুদ্ধাচরণ করতে সরকারের তাগুত (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) সমর্থন করতে পারে। এমন সন্দেহও প্রকাশ পেয়েছে নব্য জেএমবির প্রধানের বাসা থেকে উদ্ধার করা চিঠিতে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেছেন, নব্য জেএমবির প্রধান সারোয়ার জাহান, প্রধান সমন্বয়ক তামিম আহমেদ চৌধুরী, মেজর জাহিদুল ইসলাম ওরফে মেজর মুরাদ নিহত হওয়ায় সংগঠনটির মধ্যে নেতৃত্ব শূন্যতা, আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ ও অর্থাভাব দেখা দিয়েছে, দিশেহারা হয়ে পড়েছে আত্মগোপনে থাকা জঙ্গীরা। নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় পুলিশ অভিযানে নব্য জেএমবির নেতা তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার পর তার আস্তানা থেকে এমন একটি চিঠি উদ্ধার করার প্রসঙ্গে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার আগে তামিম আহমেদ চৌধুরীর লেখা উদ্ধার করা চিঠিতে লেখা আছে, নব্য জেএমবি সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ৩০০ বলে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে নব্য জেএমবির ১৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, বিভিন্ন অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে ও বোমা তৈরি করতে গিয়ে বিস্ফোরণে ১০ জন নিহত হয়েছে। এরপর বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয় আরও ৩২ জন। আরও কয়েকজন গ্রেফতার হয়। অর্থাৎ জঙ্গীদের জনবল এখন আর নেই, সঙ্কটের মুখে নব্য জেএমবি। গোয়েন্দা সংস্থার আরেক কর্মকর্তা বলেছেন, নব্য জেএমবির আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে শায়খ মাওলানা আবুল কাশেম। এই আধ্যাত্মিক গুরু এখনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। এছাড়াও নব্য জেএমবির সোহেল মাহফুজ, নুরুল ইসলাম মারজান, বাশারুজ্জামানসহ যেসব শীর্ষ জঙ্গীনেতা পলাতক রয়েছে তাদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান অব্যাহত আছে। নব্য জেএমবিসহ জঙ্গী সংগঠনগুলোকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে না পারলেও হামলা করার মতো তাদের এখন আর সামর্থ্য নেই। শীর্ষ জঙ্গীনেতাসহ প্রশিক্ষিত আত্মঘাতী জঙ্গীরা নিহত, গ্রেফতার ও পলাতক থাকার কারণে নব্য জেএমবির জঙ্গী সদস্য, অস্ত্র ও বিস্ফোরক, অর্থভাব সবকিছুই বিপর্যয়ের মধ্যে চলে গেছে।
×