ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা চান তৃণমূল নেতারা

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৪ অক্টোবর ২০১৬

বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা চান তৃণমূল নেতারা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আজীবন আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং তাঁর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদে সম্মানজনক পদে রাখার দাবিতে রবিবারও আওয়ামী লীগের সারাদেশের তৃণমূলের নেতারা ছিলেন সোচ্চার। দলের গ্রুপিং-বিভেদ সৃষ্টিকারী এবং দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করার সঙ্গে জড়িতদের ক্ষমা নয়, বরং আরও কঠোর শাস্তি প্রদানের দাবি জানিয়ে তাঁরা বলেন, আওয়ামী লীগের ঐক্য ও শৃঙ্খলা বিনষ্টকারীদের এভাবে ক্ষমা করলে তারা আগামীতেও দলের ক্ষতি করতেই থাকবে। এদের দল থেকে আজীবনের জন্য বের করে দিলে আওয়ামী লীগের কোনই ক্ষতি হবে না। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে রবিবার সকাল সাড়ে ৯টায় শুরু হওয়া জাতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে তৃণমূল নেতারা এসব দাবি জানান। মাঝে দেড় ঘণ্টার বিরতি দিয়ে বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত মোট ৪১ জন বিভিন্ন জেলার সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদক বক্তব্য দেন। তৃণমূল নেতাদের দীর্ঘ বক্তব্যে সামাল দিতে অধিবেশনের সঞ্চালকের দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বেশ গলদঘর্মই হতে হয়। সময় স্বল্পতার কারণে যেসব জেলা ও মহানগরের নেতারা বক্তব্য দিতে পারেননি খুব শীঘ্রই দলের বর্ধিত সভা ডেকে তাঁদের বক্তব্য শোনা হবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বার বার নতুন নেতৃত্ব খুঁজে নিতে আহ্বান জানালেও কাউন্সিলরা আজীবন তাঁকেই সভাপতি পদে দেখতে চান। তাই শেখ হাসিনা যতবারই এই কথা বলেছেন ততবারই জেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, কাউন্সিলররা সঙ্গে সঙ্গে তার বিরোধিতা করে একবাক্যে তাঁকে আজীবন সভাপতির পদে রাখতে গঠনতন্ত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার দাবি জানান। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার বয়স সত্তর হয়ে গেছে। আর কত, নতুন নেতৃত্ব আনতে হবে। সারাদেশের কাউন্সিলররা সঙ্গে সঙ্গে সমস্বরে ‘না’ ‘না’ বলে তাঁর এ বক্তব্যের বিরোধিতা করেন এবং শেখ হাসিনাকেই আজীবন মূল নেতৃত্বে থাকতে হবে বলে সাফ জানিয়ে দেন। সঙ্গে প্রতিটি বক্তাই সজীব ওয়াজেদ জয়কে নতুন কমিটিতে সম্মানজনক পদে রাখার দাবি জানান। যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহীদুল ইসলাম মিলন অভিন্ন এ দাবি জানানোর পাশাপাশি বহিষ্কৃত বিদ্রোহী প্রার্থীদের দলে ফেরানোর বিরোধিতা করেন। শোনা যাচ্ছে, বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে দল থেকে বহিষ্কৃতদের ক্ষমা করে দলে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। বহিষ্কৃতরা কী আগের পদে ফিরবেন নাকি প্রাথমিক সদস্য হবেনÑ এটি আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। কিন্তু আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছেÑ আওয়ামী লীগ যাতে জিততে না পারে সেজন্য দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন, তাদের এত সহজে দলে ফিরিয়ে আনলে আগামীতেও এরা বার বার দলের ক্ষতি করবে। তাই ক্ষমা নয়, এদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তারা কখনও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী হতে পারে না। সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান নেত্রীর ওই কথা প্রত্যাহারের আহ্বান জানান তাঁর বক্তব্যে। তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আপনি আমাদের ছেড়ে কোথায় যাবেন? আপনি যতদিন শারীরিকভাবে সুস্থ থাকবেন, ততদিন আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে যাবেন। কিশোরগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি কামরুল হাসানও শেখ হাসিনার উদ্দেশে বলেন, যতদিন আপনার কর্মক্ষমতা থাকবে, ততদিন আপনাকেই আওয়ামী লীগের হাল ধরে থাকতে হবেÑ এটাই আমাদের দাবি। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান জয়কে সম্মানজনক পদে আনার দাবি জানিয়ে বলেন, কারও অনুকম্পা বা পারিবারিক সূত্রে নয়, সজীব ওয়াজেদ জয় তাঁর মেধা দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন। দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, দলে থেকে অন্যদের সাইজ করার প্রচেষ্টা বন্ধ করুন। বিভেদ সৃষ্টিকারী অনেকেই আছেন বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার নৌকা মার্কা ছাড়া তারা জামানতও রক্ষা করতে পারবেন না, ফেল করাও কষ্টকর হবে। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগে কোন ‘ভাইয়ের গ্রুপ’ দেখতে চান না মন্তব্য করে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বেনজীর আহমেদ বলেন, ভাই গ্রুপ সৃষ্টিকারীকে দলে জায়গা দেয়া যাবে না। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, দল চলবে আপনার একক নেতৃত্বে। এই জন্য আপনি আপনার যোগ্যতায় নেতৃত্ব বেছে নেবেন। ১/১১-এ আপনি জীবিত থাকতে দেখেছেন আপনার পাশে কারা ছিল, কারা কী ভূমিকা রেখেছে। তাই ভাই গ্রুপ সৃষ্টিকারীকে দলে জায়গা দেয়া যাবে না। তিনি বলেন, আপনি বলেছেন সভাপতি থাকতে চান না। এতে দলের নেতাকর্মীরা আহত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ আপনাকে ছাড়তে চায় না। রাজশাহীর সাবেক মেয়র এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, আওয়ামী লীগের হাতে দেশ, জাতি ও গণতন্ত্র নিরাপদ। দেশের অভাবনীয় অগ্রযাত্রা, উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে শেখ হাসিনা যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন সভাপতি থাকবেন। পরে সজীব ওয়াজেদ জয় নতুন টিম নিয়ে দল চালাবেন, দেশের নেতৃত্ব দেবেন। লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট মতিউর রহমান দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমি একটি প্রস্তাব করতে চাই, যতদিন আপনি বেঁচে থাকবেন, ততদিন সভাপতির দায়িত্ব পালন করে যাবেন। গঠনতন্ত্র সংশোধন করে বিশেষ একটি বিধানে উল্লেখ করতে হবে, যতদিন শেখ হাসিনা বেঁচে থাকবেন, ততদিন সভাপতি থাকবেন। রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদার পার্বত্যাঞ্চল থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি জানিয়ে বলেন, এ অঞ্চলের অবস্থা ভাল না। পুরো পার্বত্যাঞ্চলে অস্ত্রের ঝনঝনানি চলছে। খুব দ্রুত শক্তহাতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা না হলে আগামীতে আওয়ামী লীগের অস্তিত্বই টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ জয়কে যোগ্য জায়গায় রাখার দাবি জানিয়ে বলেন, জয় একদিন এদেশ পরিচালনা করবে। শিশু বয়সে জয়কে আদর না করে বঙ্গবন্ধু বাড়ি থেকে বের হতেন না। বঙ্গবন্ধুর অন্তর্নিহিত সব শক্তি তিনি দিয়ে গেছেন সজীব ওয়াজেদ জয়কে। জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বাকী বিল্লাহ বলেন, জয়কে নেতৃত্বের আসনে বসাতে হবে। নেত্রী আপনি আমাদের ছেড়ে যাবেন না। নীলফামারি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট মমতাজুল ইসলাম নিজেদের মঙ্গা এলাকার লোক উল্লেখ করলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা ভুল, উত্তরবঙ্গে আর মঙ্গা নেই। উত্তরবঙ্গ থেকে আমরা মঙ্গা দূর করেছি। রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ যোগ্য নেতাকর্মী তৈরিতে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগে প্রশিক্ষিত নেতাকর্মীর বড় অভাব আছে। প্রশিক্ষণ শিবির করা উচিত। সভা-সমাবেশে জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর নির্দেশ দিতে শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানান তিনি। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট জহিরুল হক খোকা বলেন, একটি রাজনৈতিক দল ৬৭ বছর ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, এটা সারাবিশ্বে একটি ইতিহাস। আর তরুণ প্রজন্মের উন্মেষ ঘটাতে অবশ্যই জয়কে নেতৃত্বে আনতে হবে। আমরা ভোটাভুটিতে যেতে চাই না, প্রধানমন্ত্রী যেমন চাইবেন তেমনি আগামী নেতৃত্ব গঠিত হবে। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোসলেম উদ্দিন বলেন, কর্মীদের মূল্যায়ন করা উচিত। সাধারণ সম্পাদক কে হবেন, সেটা আপনি নির্ধারণ করবেন। জয়কে আমরা চাই। প্রশাসন থেকে পাকিস্তানের প্রেতাত্মাদের দূরে রাখতে ব্যবস্থা নিতে বলেন চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নইম পাটোয়ারী দুলাল। সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান বলেন, যারা আগামী দিনে নির্বাচন করবেন, তারা কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনবেন। কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির নাম ঘোষণা করতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, কিশোরগঞ্জের সভাপতি আমাদের রাষ্ট্রপতি। আমি জানি বঙ্গবভবনে বসে ওনার কেমন লাগছে। বেলা ১টা ১০ মিনিটে কাউন্সিল অধিবেশনে বিরতি দিয়ে বেলা আড়াইটায় ফের অধিবেশন শুরু হয়। এছাড়া সুনামগঞ্জ জেলা সভাপতি মতিউর রহমান, লক্ষ্মীপুর জেলা সাধারণ সম্পাদক নুরুদ্দীন চৌধুরী স্বপন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সাধারণ সম্পাদক আল মাহমুদ স্বপন, নীলফামারী জেলা সাধারণ সম্পাদক মমতাজুল ইসলাম, গাইবান্ধার সভাপতি সামশুল আলম হীরকসহ ৪২ জন জেলার নেতারা বক্তব্য দেন।
×