ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের ভীড় পাকশীর জোড়া সেতু এলাকায়

প্রকাশিত: ০২:০৫, ২৩ অক্টোবর ২০১৬

প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের ভীড় পাকশীর জোড়া সেতু এলাকায়

তৌহিদ আক্তার পান্না, ঈশ্বরদী ॥ উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদার বলে খ্যাত রেলওয়ে জংশন শহর ঈশ্বরদীর আট কিলোমিটার দক্ষিন পশ্চিমে পাকশী পদ্মা নদির উপর সৌন্দর্যের রাজা সেজে দাঁড়িয়ে আছে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম রেলওয়ে হার্ডিঞ্জ সেতু। ১৯১০ সালে এই সেতুটি ব্রিটিশ প্রকৌশলী রবার্ট উলিয়াম গেলস এর নকসা অনুযায়ী নির্মিত হয়। পাশাপাশি মাত্র তিন’শ মিটার ভাটিতে নির্মিত হয়েছে লালনশা সেতু। এতে দেশের দক্ষিন পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরী হয়েছে। প্রতিদিন এখানে দুরদুরান্ত থেকে শতশত দর্শনার্থীরা ঘুরতে এসে ভীড় জমায় এ এলাকায়। এই দু’সেতুর পাশেই রয়েছে একই সময়ে গড়ে ওঠা প্রকৃতির রুপতিলক ও ঈশ্বরদীর গর্বিত কন্যা বলে পরিচিত বিভাগীয় রেলওয়ে শহর পাকশী। সবুজে ঘেরা এই শহরটিকে ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। লালনশাহ সেতু নির্মাণকে ঘিরে পদ্মা নদীর পাদদেশে গড়ে উঠেছে দেশিবিদেশী কর্মকর্তাদের সৌন্দর্য মন্ডিত আবাসিক এলাকা। বিমানে উড্ডয়নরত অবস্থায় বা যে কোন উঁচুস্থান থেকে দেখলে মনে হবে এটি চিন দেশের কোন এক অঙ্গরাজ্য। পর্যটনের উজ্জল সম্ভাবনা নিয়ে দু’হাত বাড়িয়ে প্রতিনিয়ত জানাচ্ছে সাদর সম্ভাসন। এখানে রয়েছে রাশি রাশি বালুচর আর নয়ন ভোলানো ঘন সবুজ বনরাজি। দেশিবিদেশী বিচিত্র পাখির কিচিরমিচির,হৃদয় দোলানো পদ্মার গর্জন। মৎস্য শিকারে জেলেদের নৌকা নিয়ে পদ্মায় ছুটেচলা। পদ্মায় আচরে পড়া ঢেউতরঙ্গ আর রয়েছে লালনশাহ সেতু ও হার্ডিঞ্জসেতুর মধ্য দিয়ে সূর্যোদয় এবং সুর্যাস্তের দৃশ্য। বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপকের কার্যালয়ের সামনে রক্ষিত স্মৃতির পাতা থেকে হারিয়ে যাওয়া ইষ্টিম ইঞ্জিন এবং সুদুর ভারত থেকে আগত কুরাইশ বংশধরদের ঐতিহাসিক ফুরফুরা শরীফ। হার্ডিঞ্জসেতু নির্মাণকালিন ব্রিটিশ প্রকৌশলী রবার্ট উইলিয়াম গেলসের ব্যবহৃত বাংলো দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে। সব মিলিয়ে পাকশী শহর ও পদ্মা নদী যেন শুধুই ভালবাসার এক প্রাকৃতিক স্বর্গ। সে প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার রয়েছে অপূর্ণ সুযোগ। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা সহ বিভিন্ন কারণে প্রকৃতির রুপতিলক পদ্মা নদীর তীরে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠছেনা। ১৯৯৩ সালে সাবেক সাংসদ সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের সাংবাদিক প্রতিনিধি দল বঙ্গভবনে তৎকালিন রাষ্টপতির কাছে পাকশীতে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য সুপারিশ করেন। সাবেক সরকারের বিমান মন্ত্রীও পাকশীতে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার আশ্বাস দিয়েও কোন কাজ হয়নি। সে সময়ের পাকশী আর বর্তমনের পাকশীর মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে। পদ্মা নদীর গাইডবাঁধের শিশু পার্ক, চিড়িয়াখানা এমন কি একটি পরিপাটি আধুনিক পিকনিক স্পট নির্মাণ করাও সম্ভব। যদিও সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই প্রতি শীত মৌসুমে পাকশীতে পিকনিকপার্টির ভিড় জমে। অথচ এতসব সম্ভাবনা থাকা সত্তেও কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করছেননা। পাকশীর ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে প্রতিবছর এখানে বসানো হয় বৈশাখী মেলা । আয়োজন করা হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। ১৯১০ সালে হার্ডিঞ্জ সেতু নির্মাণকে কেন্দ্র করে পদ্মার কোলঘেষে পাকশী শহর গড়ে উঠেছে। সেতু নির্মাণ শেষে শহরের মধ্যে গড়ে উঠেছে রেলওয়ে বিভাগীয় রেলওয়ে কন্ট্রোল অফিস। এখান থেকেই দেশের অভ্যন্তরে ও ভারত বর্ষের মধ্যে চলাচলকারি ট্রেন তদারকি করা হতো। তখন বিভাগীয় রেলওয়ে কন্ট্রোল অফিসের পাশেই পদ্মা নদীতে ছিল ঐতিহাসিক সাড়াঘাট। এ ঘাটে নিয়মিত ভিরতো দেশীবিদেশী যাত্রী , মালবাহী জাহাজ ও ষ্টিমার। এ ঘাট থেকে নদী পথে সহজেই ভারতের বিভিন্নস্থানে যাতায়াত করা যেত। বর্তমানে সাড়াঘাটে দেশীবিদেশী জাহাজ ষ্টিমার না ভিরলেও বিভিন্ন কারণে পাকশীর আকর্ষণ বেড়েই চলেছে। বিশাল এলাকাজুরে তৈরী হয়েছে ইপিজেড। পাশেই নদীর ধারদিয়ে তৈরী হয়েছে একটি ভারতীয় কোম্পানীর আবাসিক এলাকা ও বিশ্বের ২৮ তম রুপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ কাজ চলছে। রাশিয়ানদের পদভারে এলাকা সবসময় সরগরম থাকছে। প্রতিবছর শীত মৌসুমে উত্তর গোলার্ধ থেকে ছুটে আসা অনেক পাখি পাকশী অঞ্চলে থেকে যায়। সম্প্রতি পাখি শিকার করতে গিয়ে পাকশী সেতু প্রকল্পের ডেপুটি ম্যানেজার মিঃ মেসের আলী খান(টাইগার খান) সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছিলেন। প্রায় সারা বছরই পাকশীতে জেলেদের কর্মব্যস্ততা লক্ষ্য করা যায়। পাকশীর গোটা শহরটা সবুজে ঘেরা থাকায় বিমানে উড্ডয়নের সময় মনে হয় শালিক পাখির বাসা আর হার্ডিঞ্জসেতুকে মনে হয় বাঁশের তৈরী সাঁকো। পাকশীর সঙ্গে দেশের সকল অঞ্চলের যোগাযোগ খুবই সহজ। বিমান,রেলপথ,সড়কপথ ও নদীপথে পাকশীতে সহজেই আসাযাওয়া সহজ। এছাড়াও এখানে রয়েছে পেপারমিল,আকর্ষণীয় রেলওয়ে একাধিক সিঙ্গল ও দ্বিতলবিশিষ্ট টানেল। ইপিজেডসহ আরো অনেক কিছু। যা সহজেই দেশীবিদেশীদের মন কেড়ে নেয়। নদীতে পালতোলা নৌকা,স্পিডবোট,কেরিট্রলার। এসবই নদী ভ্রমনের কাজে লাগে। পর্যটকরা কোথাও না গেলেও ব্রিটিশ প্রকৌশলী রবার্ট উলিয়াম গেলসের বাংলো এবং রেলওয় বিভাগীয় ব্যবস্থাপকের কার্যালয়ের সামনে বিভিন্ন রঙে সজ্জিত ইংল্যান্ডের তৈরী বাস্পচালিত ন্যারোগেজ ইঞ্জিনটি দেখতে যান। এদু’টি স্থানে না গেলে পর্যটকরা যেন স্বস্তি পাননা। পাকশীতে নিরাপদ রাত কাটানোর জন্য সুব্যবস্থা রয়েছে। এখানে কয়েকটি এসি নন এসি গেস্ট হাউজ ছাড়াও বিনোদনের জন্য রয়েছে টেনিস কোর্ট, একাধিক সুইমিংপুল,ফুটবলমাঠ। এলাকার ঐতিহ্যবাহি সাংস্কৃতিক সংগঠন ও মঞ্চ। পাকশীর মধ্যে রয়েছে ঐতিহ্যবাহি বিবিসি বাজার। এ বাজার সম্পর্কে বিশ্বের সচেতন মহলের কমবেশী জানা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধচলাকালিন সময়ে বিবিসি বাজারের কাশেম মোল্লার চায়ের দোকানে বসে এলাকার লোকজন রেডিওতে বিবিসি সেন্টারের মাধ্যমে যুদ্ধের খবর শুনতেন। এ কারণেই বাজারটির নাম করণ হয়েছে বিবিসি বাজার। অনেক পর্যটক বিবিসি বাজারে এসে মুগ্ধ হয়েছেন। আরো মুগ্ধ হয়েছেন গ্রামের পরিবেশ দেখে। দুরসম্প্রতি লন্ডন থেকে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং সেন্টারের কর্মকর্তারা এসে বিবিসি বাজার ঘুরেগেছেন। তাঁরা টএক সভায় বিবিসি বাজারসহ গোটা পাকশীর ভূঁয়সী প্রশংসা করেন।
×