ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মো. তানভির

অর্থনীতির নতুন দিগন্ত

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ২৩ অক্টোবর ২০১৬

অর্থনীতির নতুন দিগন্ত

বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সম্মেলন শেষ করেই ১৬ অক্টোবর ঢাকায় এসেছিলেন দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে থাকা দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক কিম।এর আগে ২০০৭ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন বিশ্বব্যাংকের তখনকার প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্য দেখতে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম ঢাকায় এসেছিলেন।বিশ্বব্যাংকের পঞ্চম প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশ সফরে এলেও কিমের এই সফরকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিমের ঢাকা সফরকে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্যের ‘স্বীকৃতি’ হিসেবে দেখছেন অর্থমন্ত্রী মুহিত।দারিদ্র্য বিমোচন এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে (এমডিজি) বাংলাদেশের সাফল্যে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট অভিভূত।তাই নিজের আগ্রহেই আমাদের দেশ সফর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। উপলক্ষ হিসেবে বেছে নিয়েছেন বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবস। বাংলাদেশে তাই এবার দিবসটি ভিন্ন আঙ্গিকে পালিত হবে।বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফর আমাদের জন্য একটি গর্বের বিষয়। আমরা দারিদ্র্য বিমোচনে যে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছি, সেটা সরেজমিনে দেখতেই তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিম সম্প্রতি গণমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘যেভাবে বাংলাদেশের অগ্রগতি হচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে দারিদ্র্যের হার ৩ শতাংশে নেমে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।’ বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে অতি দারিদ্র্যের হার মোট জনসংখ্যার ১২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে, যেখানে ২০০৯-১০ অর্থবছর শেষে এ হার ছিল সাড়ে ১৮ শতাংশ।জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) ২০৩০ সালের মধ্যে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা শূন্য থেকে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। কিমের এই সফর পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের তিক্ত স্মৃতি ভুলিয়ে দেবে বলেও আশা করা যায়। বিশ্বব্যাংক তিন বছরের প্যাকেজে ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এ্যাসিস্ট্যান্ট (আইডিএ) হিসেবে বাংলাদেশকে ঋণ দিয়ে থাকে। এর অংশ হিসেবে গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশকে ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শেষ পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার ছাড় করেছিল বিশ্বব্যাংক। বর্তমানে যে আইডিএ প্যাকেজ চলছে, তার মেয়াদ শেষ হবে আগামী অর্থবছরে। এরপর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাংকের এই স্বল্পসুদের ঋণ-সহায়তার পরিমাণ এখনকার তুলনায় ৫০ শতাংশ বাড়ানো হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কিম। তিনি বলেন, গত চার বছরে আইডিএ প্রতিশ্রুতি বেড়েছে। এ পর্যন্ত আইডিএ-এর প্রতিশ্রুতি রয়েছে ৯৭০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১২ সালে এটি ৪০০ কোটি ডলার ছিল। একইসঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের (আইএফসি) বিনিয়োগও বেড়েছে। গত অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ৬৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ২০১২ সাল পর্যন্ত এটা ছিল ৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার। আগামীতে এই সহায়তার পরিমাণ আরও বাড়বে। তিনি বলেন, শিশু অপুষ্টি দূর করতে আরও ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়া হবে বাংলাদেশকে। দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সরাসরি উত্তর দেননি কিম। তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের উন্নয়নের সঙ্গেই আছি। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতে আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে।’ ওয়াশিংটনে সদর দফতরে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশের নাগরিক জুনাইদ কালাম। তাই কিমকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন জুনাইদ। তিনি বলেন, ‘উনি (কিম) খুবই পজিটিভ মাইন্ডের একজন মানুষ। একজন আশাবাদী মানুষ।’ বাংলাদেশ সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে জুনাইদ বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে আসছেন।‘এই পাঁচ বছর তিনি বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। আর সেই সাফল্য-অর্জন সরেজমিনে দেখতেই বাংলাদেশ সফরে যাচ্ছেন।’ গত মঙ্গলবার বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ রাকুদিয়া ও উজিরপুর উপজেলার ভরসাকাঠি গ্রাম পরিদর্শন করেছেন কিম। কিম গ্রামের দরিদ্র নারীদের অবস্থার পরিবর্তন ও দারিদ্র্য বিমোচনে তাঁদের অগ্রণী ভূমিকা দেখে ভীষণ খুশি হয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি কলেরা ও যক্ষ্মা রোগ প্রতিরোধে বাংলাদেশের অনুকরণীয় সাফল্য এবং মানুষের কঠোর পরিশ্রমের প্রশংসা করেছেন। এ সময় স্থানীয় বক্তারা এলাকায় আরও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও সৌরবিদ্যুত প্রকল্প চালুর দাবি জানালে। এ প্রসঙ্গে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাষ দিয়েছেন। কিম এই সফরে তিনটি বড় প্রকল্প বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের ঘোষণা দিয়েছেন। এর একটি পুষ্টি নিয়ে। আরেকটি হলো জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক। তৃতীয়টি হলো একটি ট্রাস্টফান্ড। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ যে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে, সেটি বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরতে ট্রাস্টফান্ড ব্যবহার করার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট তিন দিনের সফরে সব মিলিয়ে ৩০০ কোটি ডলার সহায়তার নতুন প্রতিশ্রুতি পেল বাংলাদেশ। প্রায় এক দশক পর বিশ্বব্যাংকের কোন প্রেসিডেন্টের সফর বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তুলবে বলে সবাই আশাবাদী।
×