ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জলি রহমান

জোরালো হয়েছে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ২৩ অক্টোবর ২০১৬

জোরালো হয়েছে  দীর্ঘদিনের সম্পর্ক

বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম শক্তির নাম চীন। ১৪ অক্টোবর ছিল বাংলাদেশের জন্য স্মরণীয় দিন। এদিন প্রায় তিন দশক পর চীনের কোন প্রেসিডেন্ট প্রথম বাংলাদেশ সফর করেন। সফরকালে দু’দেশের মধ্যে উপকূলীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণসহ অবকাঠামো উন্নয়ন ও সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে সই হয়েছে। চুক্তি ও সমঝোতাগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় - ক. বিনিয়োগ ও উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা চুক্তি, যার আওতায় ২৮টি উন্নয়ন প্রকল্পে ২১.৫ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি সাহায্যের কথা বলা হয়েছে। খ. এছাড়া আট কোটি ৩০ লাখ ডলার অনুদানের জন্য অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা চুক্তি, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে ৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি, দাশেরকান্দ্রি পয়ঃনিষ্কাশন ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট প্রকল্পের জন্য ২৮ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি এবং ছয়টি জাহাজ সম্পর্কিত মোট চারটি ঋণচুক্তি। গ. কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ ও দাশেরকান্দ্রিতে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণে দুটি কাঠামো চুক্তি হয়েছে দুই দেশের মধ্যে। ঘ. এছাড়া চীনের ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ উদ্যোগে সহযোগিতা, মেরিটাইম কো-অপারেশন, মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল গঠনের সম্ভাব্যতা যাচাই, আইসিটিতে নতুন ফ্রেমওয়ার্ক, সন্ত্রাস দমনে সহযোগিতা, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ও তথ্য আদান-প্রদান, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলা, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, এবং বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতার লক্ষ্যে সমঝোতা স্মারক হয়েছে। আরও ছয়টি প্রকল্পের ফলক উন্মোচন করেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এগুলো হলো- চট্টগ্রামের কর্ণফুলী মাল্টিলেন টানেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বাংলাদেশ ফোর টায়ার ন্যাশনাল ডেটা সেন্টার, ফেঞ্চুগঞ্জে শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড, পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুতকেন্দ্র্র এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুতকেন্দ্র্র। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এসব চুক্তির আওতায় ৩৩.৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও চীনা ব্যবসায়ীদের ৮৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলও ঢাকায় এসেছিল। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাদের ১৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের ১৯টি চুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশের অবকাঠামোসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে এতবড় অঙ্কের ঋণ কোন একক দেশ আগে কখনও সরাসরি দেয়নি। প্রধানত বাণিজ্য ও অর্থনীতি, বিনিয়োগ অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে এসব ঋণের প্রকল্প হাতে নেয়া হবে। বিশ্ববাজারে যে পরিমাণ পণ্য রফতানি করে চীন, বিভিন্ন দেশ থেকে দেশটির আমদানির পরিমাণও কম নয়। চীন বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত পণ্য রফতানির সুযোগ দিয়ে আসলে তা খুব বেশি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। কারণ, বাংলাদেশী রফতানি পণ্য বহুমুখী নয়। বাংলাদেশী উদ্যোক্তাদের উচিত হবে এমন সব পণ্য উৎপাদন করা, যাতে চীনের মতো একটি বড় বাজার ধরা যায়। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, চীনে বাংলাদেশের রফতানি বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে চীনে রফতানি প্রবৃদ্ধি ২৫ শতাংশ, যেখানে দেশের মোট রফতানি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ। মন্ত্রী আশাবাদী, আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে চীনে ২০০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করা যাবে। তিনি আরও বলেন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ইতোমধ্যে ২০টির কাজ শুরু হয়েছে, যার মধ্যে একটি দেয়া হবে চীনকে। বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ সম্পৃক্ততা বাড়াতে চীনের যে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ নীতি পরিকল্পনার পথ ধরে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে। শুধু তাই নয়, দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে মধ্যম আয়ের দেশের দিকে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। আগের সম্পর্কগুলো নতুন করে স্থাপন করতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক হতে পারে ‘টেস্ট কেস’ এবং চীনের সঙ্গে ‘সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তি’ করা যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য চীনের সঙ্গে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে দরকষাকষি করতে হবে। অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এছাড়া প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে শর্তাবলী সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। অন্যথায় বিনিয়োগের সুফল পাওয়া যাবে না। এতে ঋণভারে জর্জরিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকেেত পারে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আসন্ন ঢাকা সফরকে সামনে রেখে ইংরেজী দৈনিক ডেইলি স্টারের উদ্যোগে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল। এতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেছিলেন, চীনের সহযোগিতায় বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সুশাসন ও বাস্তবায়ন সক্ষমতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এ প্রকল্পগুলো থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় আমরা বিনিয়োগের সুফল পাব না এবং ঋণভারে জর্জরিত হব। তিনি বলেন, চীন তার ভূমিবেষ্টিত অঞ্চলগুলোর জন্য দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্রপথ উন্মুক্ত করতে চাচ্ছে। এজন্য চট্টগ্রাম, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে তারা আগ্রহ প্রকাশ করছে। বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগাতে পারে। তিনি আরও বলেছেন, ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে বাংলাদেশের ৯৭ ভাগ পণ্যকে চীন শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে।’ শুল্ক সুবিধা নিয়ে ভারতের মতো চীনের সঙ্গেও দ্বিপক্ষীয় সমঝোতায় পৌঁছানো যায়। বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ পণ্যকে ভারত শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে। বিশ্বে তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় রফতানিকারক দেশ চীন ধীরে ধীরে স্বল্প দরের পণ্য উৎপাদন থেকে সরে আসছে। তাই তৈরি পোশাকের এ খাতে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দাবি করতে পারে। শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফর ১৬ কোটি মানুষের জন্য হতে পারে একটি মাইলফলক এবং দুই দেশের নতুন নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত হবে আরও উন্মোচিত। তাই ২০১৭ সালকে ঘোষণা করা হয়েছে মৈত্রী ও বিনিময়ের বছর হিসেবে।
×