ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মূর্তিমান আতঙ্ক

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২৩ অক্টোবর ২০১৬

মূর্তিমান আতঙ্ক

নিজস্ব সংবাদদাতা, মাদারীপুর, ২২ অক্টোবর ॥ হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে খ্যাত রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ি ও আশপাশের এলাকা আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত। অথচ, রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তিতে সেখানেই পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থী দীনেশ বিশ্বাস। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের রোষানলে পুড়ছে কদমবাড়ির প্রায় ৩০ হাজার সংখ্যালঘু। অবৈধ টাকা ও পেশীশক্তির প্রভাবে, হীনস্বার্থ চরিতার্থের জন্য এখানকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ত্রিধাবিভক্ত করে রাখা হয়েছে। এলাকার বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী সবসময় আতঙ্কে থাকে। কদমবাড়ি ইউনিয়নের বিতর্কিত চেয়ারম্যান বিধান বিশ্বাসের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে এলাকার শান্তিপ্রিয় মানুষের অভিমত। যে কোন মুহূর্তে এলাকায় বড় ধরনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে কদমবাড়ি ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি গোলক বসু চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তখন আড়ুয়াকান্দি গ্রামের অর্জুন বিশ্বাসের ছেলে বিধান বিশ্বাস, তার ভাই ধিতান বিশ্বাস ও এদের ভগ্নিপতি নিখিল হাজরা গোলক বসুর সান্নিধ্যে এসে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার শুরু করে। তারা ২০০২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থেকে জাল টাকার ব্যবসা, অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় মানব পাচারসহ এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বিধান বিশ্বাসের ক্ষমতার দাপটে আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মী এলাকা ছাড়া হয় এবং কেউ কেউ ভারতে আশ্রয় নেয়। বিভিন্ন ঘটনায় মাদারীপুর ও ঢাকায় তাদের বিরুদ্ধে দুই ডজন মামলা হয়। এখনো ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের সি.আর ১৪৩/২০১১ নং মামলায় বিধান বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা রয়েছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বিএনপি-জামায়াত জোটের ইউপি নেতা বিধান বিশ্বাস আওয়ামী লীগে যোগদান করে। ২০১১ সালের ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়ে দীনেশ বিশ্বাসের কাছে পরাজিত হন। দীনেশ বিশ্বাস ছাত্রজীবন থেকেই প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনে দীনেশ বিশ্বাস নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন। এ সময় বিধান বিশ্বাস তথ্য গোপন রেখে নির্বাচন কমিশনের শর্ত ভঙ্গ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ উপেক্ষা করে ৭ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কদমবাড়ি ইউপি সভাপতি বিনোদ গাইন ও সাংগঠনিক সম্পাদক অপূর্ব গাইনসহ কিছু সুযোগসন্ধানী গোপনে বিধান বিশ্বাসের পক্ষে কাজ করে। শুধু তাই নয় জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপ দু’পক্ষ অবলম্বন করায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয় হয়। ফলে বিদ্রোহী প্রার্থী বিধান বিশ্বাস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। সন্ত্রাসী কর্মকা-ের পাশাপাশি সরকারী গাছ চুরি, কালি মন্দিরের সোলার প্যানেল খুলে নেয়া, প্রতিপক্ষের লোকজনকে হুমকি-মারধর, সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতির বিরুদ্ধে অবৈধ সমাবেশ, মানববন্ধন, রাজৈর উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে বিতর্কের জন্ম দেন এই জনপ্রতিনিধি। এসব ঘটনায় তার বিরুদ্ধে আরও তিনটি মামলা হয়। মামলা থেকে রেহাই পেতে বিধান বিশ্বাস আত্মগোপনে থেকে এ বছর ৪ সেপ্টেম্বর এলাকার কিছু নারী-পুরুষ রাজৈরে এনে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করে। ঐদিন বেলা এগারোটার দিকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের রাজৈর বাসস্ট্যান্ডে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে। এ সময় বিক্ষোভকারীরা সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরকে উদ্দেশ করে অশ্লীল সেøাগান দিয়ে মিছিল করে মহাসড়ক অবরোধ করে। অনুসন্ধান করে আরও জানা গেছে, বিধান বিশ্বাসের উত্থানের নেপথ্যে চাঞ্চল্যকর কাহিনী। বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে বিধান বিশ্বাস, তার ভাই ধিতান বিশ্বাস ও ভগ্নিপতি নিখিল হাজরা মিলে জাল টাকার কারবার ও অবৈধ পথে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার শুরু করে। বিধানের বড় ভাই ধিতান বিশ্বাস মালয়েশিয়ায় গিয়ে আন্তারামবাঞ্ছা নামের রেড ইন্ডিয়ানকে বিয়ে করেন। তারা মালয়েশিয়ার হেরামবানে রেকানটেক কলেজ নামে প্রতিষ্ঠান চালু করে বাংলাদেশ থেকে গলাকাটা পাসপোর্ট ও জাল স্টুডেন্ট ভিসার মাধ্যমে মানবপাচার শুরু করে। মাদারীপুরসহ বিভিন্ন জেলার কয়েক শ’ শিক্ষিত/ অশিক্ষিত যুবককে ধাপে ধাপে মালয়েশিয়া নিতে শুরু করেন। সেখানে প্রতারিত হয়ে দীর্ঘদিন অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে মানবেতর জীবনযাপন করে। পরে তারা বাংলাদেশী ও পুলিশের সহায়তায় দেশে ফিরে আসে। একই সময় বিধান বিশ্বাস পরিচালিত কৃষক কল্যাণ সমিতিতে জাল টাকা দিয়ে ঋণ বিতরণ করলে জাল টাকার কারবার ধরা পড়ে। তখন রাজৈর থানার পুলিশ তাদের বাড়ি করে ঘরের বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুল জাল টাকা উদ্ধার করে। তাদের মানব পাচার ব্যবসা দিন দিন বিস্তার ঘটে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে। টাকার দাপটে শুরু হয় উচ্চ মহলে ওঠাবসা। তখন থেকে স্থানীয় পুলিশের কর্মকর্তা, ঢাকার পুলিশের বড় অফিসার, প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ, জনশক্তি রফতানির কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠার সুবাদে তাদের ব্যবসা সুদৃঢ় হয়। এদিকে কদমবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান বিধান বিশ^াসের দায়িত্ব পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে হাইকোর্ট। কদমবাড়ি ইউনিয়নের ভোটারদের আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ১৬ অক্টোবর বিচারপতি নাঈমা হালদার ও বিচারপতি সেলিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। একই সঙ্গে ঢাকার মুখ্য মহানগর আদালতের বিচারাধীন মানবপাচার মামলার পলাতক আসামি বিধান বিশ^াসকে চেয়ারম্যান পদ থেকে কেন অপসারণ করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে আদালত। স্থানীয় সরকার সচিব, মাদারীপুর জেলা প্রশাসক, রাজৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ইউপি চেয়ারম্যান বিধান বিশ^াসকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
×