ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মানবতাবিরোধী অপরাধের সাক্ষীরা নিরাপত্তাহীনতায়

সাক্ষী সুরক্ষা আইন পাঁচ বছরেও চূড়ান্ত হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৩ অক্টোবর ২০১৬

সাক্ষী সুরক্ষা আইন পাঁচ বছরেও চূড়ান্ত হয়নি

বিকাশ দত্ত ॥ আইন কমিশনের সুপারিশ ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পর পাঁচ বছরেও চূড়ান্ত হয়নি ‘সাক্ষী সুরক্ষা আইন’। স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিলেও এখন পর্যন্ত আইন প্রণয়নের কার্যক্রম সম্পন্ন করা যায়নি। আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সাক্ষীদের সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখছে মন্ত্রণালয়। সাক্ষীর নিরাপত্তা সুরক্ষায় একটি পূর্ণাঙ্গ আইন তৈরির পরিকল্পনা করে সরকার। নতুন আইনে কোন কোন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে তা নিয়ে প্রতিবেদন বিনিময়ের মধ্যেই দুই মন্ত্রণালয় দীর্ঘ সময় পার করেছে। আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আইনটি চূড়ান্তকরণে সংশ্লিষ্ট বিভাগ কাজ করছে, আশা করা যাচ্ছে দ্রুত সম্পন্ন হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে যারা এখন পর্যন্ত সাক্ষী হয়েছেন তারা নিরাপত্তার ঝুঁকিতে রয়েছেন। আর যাদের সাক্ষ্য দিতে তালিকাভুক্ত করা হয় তাদের অনেকে ভয়ে শেষ পর্যন্ত সাক্ষ্য দিতে রাজিই হন না। তাতে তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটরদের মারাত্মক বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। জানা যায়, লক্ষাধিক সাক্ষী নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন। যাদের ইতোমধ্যে সাক্ষ্য হয়েছে, তারা এখন নিজ নিজ এলাকায় আতঙ্কে দিনযাপন করছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক জনকণ্ঠকে বলেছেন, জেলা পর্যায়ে কমিটির পাশাপাশি কেন্দ্রীয় কমিটিও রয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে (রাজনৈতিক ) প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটিতে পুলিশ, র‌্যাব, ডিজিএফআই, এনএসআই, এসবি, তদন্ত সংস্থার প্রতিনিধি রয়েছে। তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটির পাশাপাশি জেলা কমিটি রয়েছে। সাক্ষীদের কল্যাণে যা যা করা প্রয়োজন এ কমিটি তা করবে। স্বারাষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে একটি খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে গেছে, আইন মন্ত্রণালয় সেটি অনুমোদন করলেই সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তখন সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সরকারের বাইন্ডিং এ থাকবে। প্রশাসন যাতে করে সাক্ষীদের সহজে চিনতে পারে সে জন্য তাদের জন্য পরিচয় পত্র দেয়া হচ্ছে। এতে করে তারা প্রশাসনের কাছে ত্বরিতগতিতে পৌঁছতে পারবেন। ফৌজদারি মামলায় প্রভাবশালী কোন আসামি সাক্ষীকে ভয়ভীতি দেখালে বার বার সমন সত্ত্বেও সাক্ষী আদালতে হাজির হতে চায় না। কারণ সাক্ষী নিরাপত্তার অভাববোধ করে থাকেন। ফলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করতে বেগ পেতে হয় আদালতের। এসব গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে আইন কমিশন, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা পরিষদ এবং কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদসহ সংশ্লিষ্টরা দীর্ঘদিন ধরে আইন করার দাবি জানিয়ে আসছে সরকারের কাছে। জানা গেছে, আইন কমিশন ২০১১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি উল্লেখিত আইনটি প্রণয়নের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে একটি খসড়া প্রেরণ করে। কমিশন তাদের সুপারিশমালায় সুরক্ষার অধিকার, সুরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য জানার অধিকার, সুরক্ষা বিষয়ে জাতীয় নীতিমালা কর্মসূচী ও বাস্তবায়ন সংস্থা, সুরক্ষা প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্তির আবেদন, আবেদনের শর্তাবলী, সুরক্ষাপ্রাপ্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি (ভিকটিম) বা সাক্ষীর অধিকার, সাক্ষীদের অধিকার ভোগ নিশ্চিত করা, সাক্ষীর অঙ্গীকার, সাক্ষীর নিরাপত্তাসহ ১৯টি সুপারিশমালা প্রেরণ করে। এদিকে উচ্চ আদালতও সাক্ষী সুরক্ষায় আইনটি দ্রুত প্রণয়ন করতে সরকারকে তাগিদ দিয়েছেন। ২০১৫ সালের ৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট একটি হত্যা মামলার আসামির জামিনের আবেদনের শুনানি শেষে ফৌজদারি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে নির্ধারিত দিনে সাক্ষীর উপস্থিতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইন করার উদ্যোগ নিতে সরকারকে নির্দেশনা দেন। আদালত স্বরাষ্ট্র ও আইন সচিবকে এ বিষয়ে আইন প্রণয়নে দ্রুত উদ্যোগ নিতে এই নির্দেশনা প্রদান করেন। হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়, সমন পাওয়ার পরও সাক্ষী আদালতে হাজির না হলে এ জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারী কৌঁসুলি ও পুলিশ কর্মকর্তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার বিষয়টি আইনে সংযুক্ত করার বিষয়টি বিবেচনা নিতে বলা হয়। সমন পাওয়ার পর নির্ধারিত তারিখে সাক্ষী উপস্থিত না হলে সংশ্লিষ্ট পিপি ও পুলিশ কর্মকর্তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার বিধান যুক্ত করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একটি হত্যা মামলার আসামির জামিন শুনানির সময় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আমীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। স্বরাষ্ট্র সচিব ও আইন সচিবকে এই আদেশ পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালের ১৪ জুন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে রিংকু নামের এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় হীরা ওরফে হারুন নামের এক ব্যক্তিকে একই বছরের ১০ জুলাই গ্রেফতার করে পুলিশ। এ মামলায় ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ-৩য় আদালতে ২০১২ সালের ৫ জুন অভিযোগ গঠন করা হয়। এরপর প্রায় ৮ থেকে ১০ বার সাক্ষী সমন করা হয়। কিন্তু সাক্ষীরা হাজির হননি। এর মধ্যে আসামিপক্ষ জামিনের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন। এ আবেদনের পর হাইকোর্ট সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পিপিকে তলব করেন। এ আদেশ অনুসারে অতিরিক্ত পিপি আসাদুজ্জামান হাইকোর্টে হাজির হয়ে বলেন, আসামি খুব ভয়ঙ্কর। তার ভয়ে কেউ সাক্ষী দিতে আসেন না। পরে হাইকোর্ট আসামির জামিন আবেদন খারিজ করে দিয়ে সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে সরকারের দুই সচিবকে নির্দেশ দেন। একইভাবে চলতি বছরের ৩০ জুন হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চ ফৌজদারি মামলায় সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল প্রদান করেন। চট্টগ্রামের এক মামলায় সাক্ষী হওয়ায় পর হয়রানির অভিযোগ তুলে ওই সাক্ষীর করা রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর অবকাশকালীন বেঞ্চ এ রুল দেন। “বিচারিক আদালত পুলিশকে অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেন। তবে পুলিশ মনগড়াভাবে তদন্ত করে। পরবর্তীতে আসামির হুমকির মাত্রা আরও বেড়ে যায়। আসামি ও পুলিশের এক ধরনের যোগাসাজশ এখন কমল নাথের স্বাভাবিক জীবনযাপন দুরূহ প্রায়। এসব কার্যক্রম নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত সংবিধানের ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৬ ও ৪৩ অনুচ্ছেদ পরিপন্থি।” “এসব কারণে ফৌজদারি মামলায় সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের নির্দেশনা চেয়ে রিটটি করা হলে আদালত রুলসহ ওই আদেশ দিয়েছেন।” তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা যায়, আইসিটি এ্যাক্টে সাক্ষীদের সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। সেখানে শুধু সাক্ষীকে বাড়ি থেকে আনা এবং ট্রাইব্যুনাল থেকে বাড়িতে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দেয়ার বিধান রয়েছে। সে জন্য আইসিটি এ্যাক্ট ২৫-এর সঙ্গে ‘এ’ ও ‘বি’ নতুন দুটি ধারা যোগ করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে, যা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে এতে ধীর গতি দেখে সংশ্লিষ্ট সবার বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে দেখার অনুরোধ জানান সরকারকে। কেননা, এখন যে মামলাগুলো আসছে তাতে অনেক মামলার সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। সাক্ষীরা নিরাপত্তার অভাবে সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না। ফলে মামলার কাজে বিঘœ ঘটছে। কোন কোন সাক্ষী গোপনে সাক্ষ্য দিলেও তা মিডিয়ায় প্রচার করতে তদন্ত কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানান। এ অবস্থায় সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগ সময়ের দাবি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তার রুলস-এ সাক্ষী ও ভিকটিম সুরক্ষায় বলা হয়েছে, ৫৮ক(১) ট্রাইব্যুনাল স্ব-উদ্যোগে বা কোন পক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে সাক্ষী অথবা ভিকটিমের সুরক্ষা, গোপনীয়তা এবং কল্যাণ নিশ্চিত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশসহ প্রয়োজনীয় আদেশ দিতে পারবেন। এই প্রক্রিয়া গোপন থাকবে এবং অপর পক্ষকে অবহিত করা হবে না। (২) সরকার (ক) সাক্ষী অথবা ভিকটিম প্রার্থনা করলে তার বা তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করবেন। (খ) ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা মোতাবেক সাক্ষী অথবা ভিকটিমের নিরাপত্তা ও তদারকি নিশ্চিত করবেন; এবং (গ) আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যগণ দ্বারা প্রহরা প্রদানপূর্বক সাক্ষী এবং ভিকটিমকে বিচারকক্ষে আনা-নেয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। (৩) আইনের ১০(৪) ধারার অধীনে ক্যামেরা কার্যক্রম অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রসিকিউটর এবং ডিফেন্স কাউন্সিলের উভয়ই কার্যক্রমের গোপনীয়তা রক্ষা করবেন মর্মে অঙ্গীকারনামা প্রদান করবেন এবং অনুরূপ কার্যক্রম হতে উদ্ভূত কোন তথ্যাদিসহ সাক্ষীর পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন পক্ষের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ জনকণ্ঠকে বলেছেন, সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং বিষয়। সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে বাধার সম্মুখীন হতে হবে। মামলার অভিযোগ প্রমাণে কষ্টসাধ্য হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে ভবিষ্যতে কোন সাক্ষী মামলার সাক্ষ্য দিতে আসবে না। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা দরকার। প্রতিটি অভিযোগ প্রমাণে সাক্ষীরা গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কত বছর পর বিচার শুরু হয়েছে। অনেক সাক্ষী মারা গেছেন। আবার কেউ ভারতে চলে গেছেন। সাক্ষীদের খুঁজে পাওয়াটা বেশ মুশকিল। তাদের সাহার্য্য দিতে না পারলে সেটা হবে দুর্ভাগ্যজনক।
×