ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এক বছরে বিদেশীসহ ৪০ জনকে হত্যা করেছে নব্য জেএমবি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৩ অক্টোবর ২০১৬

এক বছরে বিদেশীসহ ৪০ জনকে হত্যা করেছে নব্য জেএমবি

শংকর কুমার দে ॥ শুধু গুলশানে ইতালীয় নাগরিক সিজার তাবেলা হত্যাই নয়, রংপুরে জাপানের নাগরিক হোশি কুনিও হত্যার ঘটনাও ঘটিয়েছে নব্য জেএমবিই। গত এক বছরে নব্য জেএমবিই বিদেশী নাগরিক ছাড়াও পুরোহিত, ধর্মযাজক, পুলিশ, ভিন্নধর্মাবলম্বীসহ ৪০ জনকে হত্যা করেছে। বর্তমানে নব্য জেএমবির নতুন আমির হিসাবে ৩ জনের নাম সামনে এসেছে। এদের মধ্যে রয়েছে গুলশান হামলার অপারেশনাল কমান্ডার নুরুল ইসলাম মারজান, বাসারুজ্জামান ওরফে চকোলেট ও সোহেল মাহফুজ। র‌্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ সংবাদ সম্মেলন করে নব্য জেএমবির প্রধান নিহত আবদুর রহমান ওরফে সারোয়ার জাহান ওরফে আবু ইব্রাহিম আল হানিফের পরিচয় উদঘাটনের দাবির পর তার জঙ্গি আস্তানা থেকে পাওয়া তথ্য উপাত্ত বিষয়ে বিগত দিনের হত্যাকান্ডগুলোর তদন্তের গতি প্রকৃতি পরিবর্তন হয়ে এখন পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি, কাউন্টার টেররিজম ইউনিটে তোলপাড় শুরু হয়েছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, এতদিন ধরে সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়ক নারায়নগঞ্জে নিহত তামিম আহমেদ চৌধুরীকেই বলা হলেও এখন দেখা যাচ্ছে সংগঠনটির প্রধান নিহত আবদুর রহমান ওরফে সারোয়ার জাহান ওরফে আবু ইব্রাহিম আল হানিফ। অনুরূপভাবে গুলশানে ইতালিয় নাগরিক সিজার তাবেলা, জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যার ঘটনায় বিএনপির অঞ্চল ভিত্তিক স্থানীয় নেতাদের দায়ী করে তদন্ত এগুলেও এখন দেখা যাচ্ছে, দুই বিদেশী হত্যাকান্ডের ঘটনায়ও নব্য জেএমবিই জড়িত। শুধু তাই নয়, নব্য জেএমবির নেতৃত্বে ২২টি বড় ধরনের হামলায় ৪০ জন নিহত হওয়ার ঘটনার পর ২১টি ঘটনায়ই দায় স্বীকার করা হয়েছে ইসলামিক স্টেটস (আইএস) এর নামে। অথচ এর আগে তদন্তে প্রকাশ পেয়েছিল এসব হত্যাকান্ডের ঘটনায় দায় স্বীকারের প্রধান ভূমিকা পালন করেছে তামিম আহমেদ চৌধুরী। এখন দেখা যাচ্ছে, নিহত আবদুর রহমান ওরফে সারোয়ার জাহান ওরফে আবু ইব্রাহিম আল হানিফ দায় স্বীকারের ভূমিকা পালন করেছে। গত ৮ অক্টোবর আশুলিয়ায় জঙ্গী আস্তানায় অভিযানের সময় লাফিয়ে পড়ে আবদুর রহমান। পরে হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয় বলে র‌্যাবের দাবি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, র‌্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ গত শুক্রবার সকালে কাওরানবাজারে বিসিআইসি ভবনে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রথম প্রকাশ করেন যে, গুলশানে ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যাকা-ে নব্য জেএমবি জড়িত। এখন বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দেয়ার পর মামলা বিচারিক প্রক্রিয়ায় আদালতে চলে যাওয়ায় তার কি জবাব দেয়া হবে তা নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় গুলশান ২-এর ৯০ নম্বর সড়কে ইতালিয় নাগরিক সিজার তাবেলাকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পুলিশ এই ঘটনায় ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার এমএ কাইয়ুম, তার ভাইসহ সাতজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়েছে। তবে রংপুরে জাপানের নাগরিক হোশি কুনিও হত্যার ঘটনায় প্রথমে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্তে অভিযোগ পাওয়ার পর গ্রেফতার, রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও অভিযোগপত্রে (চার্জশীট) তাদেরকে দায়ি করা হয়নি। অভিযোগ দেয়া হয়েছে জেএমবির আঞ্চলিক কমান্ডার মাসুদ রানাসহ ৮ জঙ্গীর বিরুদ্ধে। গত ৩ জুলাই রংপুরের আমলি আদালতে মাসুদ রানা-সহ অন্য ৮জঙ্গী ইসাহাক, লিটন মিয়া, আবু সাইদ, সাদ্দাম, আহসান উল্লাহ, নজরুল ইসলাম, সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে জঙ্গী মাসুদ রানা, ইসাহাক, লিটন মিয়া ও আবু সাইদ রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রয়েছে, বাকিরা পলাতক। গত বছরের ৩ অক্টোবর সকালে জাপানী নাগরিক কুনিও হোশি নাছনিয়া বিল আলুটারী এলাকায় তার ঘাসের খামার বাড়ি যাওয়ার পথে ৩ মুখোশধারী দুর্বৃত্ত তাকে গুলি করে মোটরসাইকেলযোগে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নব্য জেএমবির প্রধান নিহত আবদুর রহমান ওরফে সারোয়ার জাহান ওরফে আবু ইব্রাহিম আল হানিফের ভাড়া করা সাভারের আশুলিয়ার বাসা থেকে যে চিঠি ও তথ্যউপাত্ত পাওয়া গেছে তাতে নব্য জেএমবি সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে ৩০০ সদস্য নিয়ে। এর মধ্যে বর্তমানে সক্রিয় আছে মাত্র ২১ জন সদস্য। বাদ বাকিরা গ্রেফতার বা পলাতক নয়তো ভারতে পালিয়ে গেছে। তবে রাজধানীর গুলশানে ইতালিয় নাগরিক সিজার তাবেলা হত্যাসহ ১৮টি নাশকতার ঘটনায় নব্য জেএমবি জড়িত বলে দাবি করেছে র‌্যাব। নব্য জেএমবির এই ২১ সদস্যের মধ্যে ২জন শুরা সদস্য, ১৯ জন মিড লেভেলের জঙ্গিদের সাংগঠনিক নাম পাওয়া গেছে, যা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। র‌্যাবের তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, নিহত আবদুর রহমানের ই-মেইলে পাওয়া পলাতক জঙ্গিদের মধ্যে গুলশান হামলার অপারেশনাল কমান্ডার নুরুল ইসলাম মারজান ও বাসারুজ্জামান ওরফে চকোলেট ও সোহেল মাহফুজ নিউ জেএমবির নেতৃত্ব দেয়ার চেষ্টা করছে। তবে গুলশান হামলার বোমা সরবরাহকারী সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যার সঙ্গে জড়িত একই বিভাগের শিক্ষার্থী শরীফুল ইসলাম খালেদ, উত্তরাঞ্চলের দুর্ধর্ষ জঙ্গী মামুনুর রশীদ রিপন, গুলশান হামলার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ভাটারার জুনায়েদ হাসান খান ভারতে পালিয়ে গেছে বলে গোয়ন্দাদের ধারণা। তার আরেক ভাই ইব্রাহীম হাসান খান এবং একজন সরকারী কর্মকর্তার ছেলে তাহমীদ শাফী এখন সিরিয়ায় জঙ্গীডেরায় অবস্থান করছে। আবদুল রহমানের তালিকায় থাকা তালিকায় থাকা জঙ্গী ওয়াসিম আজওয়াদ আবদুল্লাহ ওরফে আসিফ আজওয়াদ নিউ জেএমবির ডাকাতির সংগঠক, উত্তরাঞ্চলের কমান্ডার রাজীব গান্ধী ওরফে জাহাঙ্গীর ওরফে সুভাস বসু, কমান্ডার মানিক, সংগঠক মামুন, প্রশিক্ষক আবদুস সাকিব ওরফে মাস্টার সাকিব, মিজান, অপারেশন বাস্তবায়নকারী সদস্য বাদল মিয়া ওরফে ওস্তাদ বাদল, আবদুল খালেক ও মামা খালেক, সাগর, আকাশ এবং আজাদুল ওরফে কবিরাজ, কল্যাণপুরের আস্তানা থেকে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গী ইকবাল এখনও পলাতক। নিহত আবদুর রহমানের সাভারের আশুলিয়ার জঙ্গী আস্তানা থেকে পাওয়া নথিপত্র থেকেই ইতালির নাগরিক সিজার তাভেল্লা ও জাপানের নাগরিক হোশি কুনিও হত্যায়ও জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে বলে র‌্যাবের দাবি।
×