ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দক্ষিণে কুটুম হয়ে আসে মেয়ে

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ২২ অক্টোবর ২০১৬

দক্ষিণে কুটুম হয়ে আসে মেয়ে

শরতের পরে আসে হেমন্ত। প্রকৃতিতে লাগে শীতের ছোঁয়া। বছরের এ সময়টাতে সাগরপাড়ের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনযাপনেও আসে পরিবর্তন। আবহমানকাল থেকে পরিবর্তনের এ ধারা চলে আসছে। আধুনিক প্রযুক্তি যতই আসুক, আজও এ ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি দখিনের মানুষ। বিশেষ করে এ সময়টাতে গাঁয়ের বধূদের বাবার বাড়ি ‘নাইওর’ যাওয়ার প্রবণতা আজও সমানতালে বহমান। বর্ষা মানেই দক্ষিণের মানুষের কর্মমুখরতা। মাঠে মাঠে ধানচাষের ধুম। বিশেষ করে রোপা আমন ও আউশ ধান চাষে কৃষকের ব্যস্ততা তুঙ্গে ওঠে। নদী-সাগরে চলে ইলিশ ধরা। দক্ষিণের প্রায় সব গ্রাম ডুবে যায় বর্ষার পানিতে। চর-দ্বীপ তলিয়ে যায় সাগর-নদীর পানির নিচে। হাট-ঘাট-মাঠ সবই প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পুরুষরা যেমন মাঠে কিংবা নদী-সাগরে ব্যস্ত সময় কাটায়। নারীরাও ঘর-গেরস্থালিতে ব্যস্ত থাকে। বর্ষা চলে যেতেই পানির নিচ থেকে জেগে ওঠে গ্রাম। ছবির মতো সুদৃশ্য হয়ে ওঠে গেরস্ত বাড়ির আঙ্গিনা। সবুজে সবুজে ছেয়ে যায় ধান ক্ষেত। পথঘাটও শুকিয়ে যায়। প্রকৃতিতে লাগে হাল্কা শীতের প্রলেপ। ঘাষের ডগায় জমে শিশিরবিন্দু। মানুষের মেলে অবসর। ধানকাটা শুরু হতে ঢের বাকি। তাই মানুষ বেরিয়ে পড়ে স্বজনদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বিশেষ করে বছরের এ সময়টাতে গাঁয়ের বধূরা ছোটে বাবার বাড়ি নাইওরে। বর্ষার পুরোটা সময়ে প্রকৃতির একঘেয়েমি বন্দিদশা ছেড়ে বধূরা পাখনা মেলে ছুটে চলে মুক্ত আকাশের পানে। গাঁয়ের রাস্তাঘাটে কিংবা নদী তীরের যে কোন জায়গায় দাঁড়ালেই এখন চোখে পড়ে দক্ষিণের গাঁয়ের বধূদের ছুটে চলার দৃশ্য। কেউ ছুটছে গাঁয়ের মেঠোপথে পা ফেলে। কেউ ছুটছে দ্রুতগতির যানে। আবার কেউবা ছুটছে নৌকা-ট্রলারে। কারও কোলে শিশু। কেউ স্বামীর হাত ধরে। দু’হাত ভরা বাজার সদাই। জোড়া ইলিশের সঙ্গে লাল মুরগির চিৎকার। মিষ্টির প্যাকেট। জিলাপি-আমৃত্তি হাতে। মুড়ির মোয়া আনে ভিন্নতর স্বাদ। মাথায় বস্তাভরা আরও নানা সদাইপাতি। নাইওর যাওয়ার আরেক অর্থই এমনতর হাজারো কেনাকাটার বস্তা। কেউ কেউ কাছেরজনদের জন্য কেনে পোশাক-আশাক। নাইওর মানে দক্ষিণের গ্রামীণ জীবনে ভিন্ন দৃশ্যের অবতারণা। অনেকদিন পর ঘরের মেয়ে এসেছে ঘরে। সঙ্গে ছেলেমেয়ে-স্বামী। অনাবিল আনন্দের মধুর পরিবেশ। বাড়ির সবার ব্যস্ততা যায় বেড়ে। জাল ফেলে পুকুর থেকে তোলা হয় বড় সাইজের রুই, কাতল কিংবা কোড়াল মাছ। মুরগির মাংস তো রয়েছেই। সঙ্গে হরেক রকমের পিঠা। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে ভাপাতোলা চিতই পিঠার স্বাদ এবং কদরই আলাদা। বাড়ির খেজুর গাছের রসে তৈরি গুড় আর চিতই পিঠা মিলেমিশে হয়ে ওঠে একাকার। পাটিসাপটা, কদমফুলি, কুলি, রসমালাই, বড়াসহ কত ধরণের পিঠা দিয়ে যে দক্ষিণের নারীদের নাইওরে আপ্যায়ন করা হয়, গোনাগুনতিতে তার শেষ নেই। অবস্থাপন্নরা জবাই দেয় খাসি। নতুন কাপড় দিয়ে বরণ করা হয় মেয়েদের। সঙ্গী স্বামী-সন্তানদেরও দেয়া হয় নতুন পোশাক। এ রেওয়াজও চলে আসছে আবহমানকাল থেকে। নাইওর আসা বধূরা নিজ বাবার বাড়িতে ক’দিন কাটিয়েই ক্ষান্ত হয় না। আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতেও এ ফাঁকে বেড়িয়ে আসে। বাবার বাড়িতে বসে মেয়েদের মেলা। শেষ বিকেলে আজ এ বাড়ি তো কাল অন্য বাড়ি। পালা করে চলে বধূদের আড্ডাবাজি। সেসব আড্ডায় উঠে আসে শ্বশুরবাড়ির আদর সোহাগের গালগল্প। শাশুড়ি দেবর ননদদের খুনসুটি। আর ক’দিন পরেই গোলায় উঠবে নতুন ধান। বাড়বে আবার কৃষকের ব্যস্ততা। তাই দেখতে না দেখতে ফুরিয়ে আসে বেড়ানোর সময়। বধূরা ফিরে যায় আপন নীড়ে। -শংকর লাল দাশ, গলাচিপা থেকে
×