ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সম্পর্কের নিবিড় বন্ধন

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ২২ অক্টোবর ২০১৬

সম্পর্কের নিবিড় বন্ধন

কুটুম্বিতা আবহমান বাংলার লোক সংস্কৃতির ঐতিহ্য। কুটুম্বিতার আবেদন সুদীর্ঘকাল ধরে সমাজে প্রচলিত। গ্রামবাংলার লোকাচার ও সংস্কৃতিতে কুটুম্বিতার গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষ স্বভাবজাত ও সামাজিক কারণে কুটুম্বিতা করে থাকে। প্রাচীনকাল থেকে ঘরে ঘরে কুটুম্বিতার প্রচলন আছে বলেই সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের সম্পর্কের নিবিড় বন্ধন অটুট রয়েছে। ইষ্টিকুটুম বা কুটুম্বিতার আবেদন থাকবে অনাদিকাল। সমাজে বংশ পরম্পরায়, বৈবাহিক সূত্র, রাখিবন্ধন, ধর্মীয় লোকাচার, উৎসব, পার্বণ, বন্ধুত্ব, সন্তানাদি দত্তক, সই পাতানো ইত্যাদি সূত্র ধরে কুটুম্বিতা হয়ে থাকে। কুটুম্বিতা মানেই বাহারি আয়োজন, তৃপ্তি মিটিয়ে ভূরিভোজ, আদর আপ্যায়ন, উপহার সামগ্রী আদান প্রদান, আনন্দ ভাগাভাগি। তবে কেউ কেউ কুটুম, সকলেই কুটুম নয়। আদর্শগত দিক দিয়ে সম্পর্কের মিল না হলে কুটুম্বিতা হয় না। হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, সময়-অসময়, অভাব-অভিযোগ, আপদে-বিপদে একজন অন্যজনের পাশে না থাকলে কুটুম্বিতা হয় না । কুটুম্বিতায় কোন বাধা নিষেধ বা গ-ি থাকে না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজে কুটুম্বিতা হয়। বিয়ে আধুনিক সমাজ বিন্যাসের সুদৃঢ় বন্ধন, পরিবার, আত্মীয়তা, কুটুম্বিতা উত্তরাধিকার সূত্রের মূল ভিত্তি। ভালবাসার আত্মিক অনুভূতির প্রধান ও পরিপূর্ণ অভিব্যক্তি হচ্ছে কুটুম্বিতা। সভ্যতার আগেও আদিম মানুষের মধ্যে পরস্পর গোষ্ঠীগত বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে আগের চেয়ে আতিথেয়তায় অনেকটা ভাটা পড়েছে। একসময় অতিথি আপ্যায়নের প্রতিযোগিতা ছিল উল্লেখ করার মতো। কোন গেরস্থ কার কুটুমকে ভুরিভোজ করিয়ে এবং বেশি উপহার দিয়ে খুশি করবে তা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা হয়েছে। আর যারা বা যিনি কুটুম আপ্যায়ন করতেন তিনিও তৃপ্তি পেয়েছেন। কুটুম্বিতার সম্পর্কের সূত্রে ইষ্টিকুটুম বাড়িতে আগমনের প্রাক্কালে কেনাকাটার ধুম পড়ে গেছে। গৃহিণীরা রকমারি রান্নয় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। এক সময় বাড়িতে কুটুম আসার খবর জানান দিত ইষ্টিকুটুম পাখি? এ পাখিকে নিয়ে অনেক ছড়া-গল্প প্রচলিত রয়েছে ? কিন্তু আজ ডিজিটাল যুগে ইষ্টিকুটুম পাখির ডাক আর শোনা যায় না? যখন ঘরের চালে-গাছের ডালে ‘কুটুম আয়-কুটুম আয়, ইষ্টিকুটুম-ইষ্টিকুটুম’ বলে হলুদ রঙের কুটুমপাখি ডাকত। তখনই বাড়ির বয়স্করা বুঝতে পারতেন, কুটুম আসবে। এখন আর কুটুম পাখির মন মাতানো সেই মধুর ডাক তেমন শোনা যায় না। কুটুম পাখি চোখেও পড়ে না? তবে পল্লী অঞ্চলে কুটুমপাখি এখনও দেখা যায়। কুটুম পাখি এখনও কুটুমের আগমনী বার্তা শোনায় সুরে সুরে। প্রকৃতির আপন খেয়ালে হলুদ বর্ণের ইষ্টিকুটুম পাখি অনাদিকাল ধরে কুটুম আসার আগাম বারতা পৌঁছে দেয় বাঙালীর ঘরে ঘরে। ইষ্টিকুটুম পাখি নিয়ে মজার গল্প রয়েছে। গ্রামের এক গৃহবধূ প্রতিদিন সংসারের প্রয়োজন মতো রান্না করত। বাড়ির সবাইকে খাইয়ে গৃহবধূ নিজে খেতে বসার ঠিক আগে বাড়িতে কোন না কোন অতিথি এসে হাজির হয়? ভরদুপুরে বাড়িতে অতিথি এলে তাকে খালি মুখে ফেরাতে নেই ? তাতে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়? তাই নিজের ভাত অতিথিকে খাইয়ে দিত। নিজের জন্য কিছুই থাকত না? ফলে তাকে না খেয়েই কাটাতে হয়? দিনের পর দিন একই ঘটনা ঘটায় একদিন সে নিজের গায়ে হলুদ মেখে, মাথা ও মুখে কালি মেখে আত্মহত্যা করে। সেই বউই নাকি মরে ইষ্টিকুটুম পাখি হয়ে ফিরে আসে? সেই থেকে কারও বাড়িতে অতিথি আসার আগেই সে গাছের ডালে বা ঘরের চালে বসে ‘ইষ্টিকুটুম’ ‘কুটুম আয় কুটুম আয়’ সুরে ডেকে বউ-ঝিদের আগাম বারতা দিয়ে যায়। গেরস্থ বাড়িতে কুটুম এসে খালি মুখে ফিরে গেছে এমন আগে কখনও হয়নি। পেট পুরে খেয়ে পান চিবুতে-চিবুতে ভাত ঘুম দিয়ে পড়ন্ত বিকেলে বাড়ি ফিরেছে? সে সময় কুটুমদের আসা-যাওয়া ছিল রোজকার ব্যাপার। শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী-সন্তান, জা, ননদ-ননদাই, ভাগ্নে-ভাগ্নি, বন্ধু-বান্ধবসহ তাদের পাড়া-প্রতিবেশীরা এসেছে একে অন্যের গৃহে। কুটুম নিয়ে বাড়ির নারীদের ভাবনার অন্ত ছিল না। দাবি-আবদার মিটিয়ে কুটুমদের সঙ্গে কুটুম্বিতাতেও তাদের ক্লান্তি ছিল না। -সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×