ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আয়োজন হয় পিঠা-পুলি পায়েসের

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ২২ অক্টোবর ২০১৬

আয়োজন হয় পিঠা-পুলি পায়েসের

শীতের শুরু থেকেই গ্রামীণ জনপদে কুটুমবাড়ি বেড়ানোর রীতি এখনও রয়েছে রাজশাহী অঞ্চলে। তবে ধরণ ও আচার-আচরণ পাল্টে গেছে। কুটুমবাড়ি যাত্রায় লেগেছে আধুনিতার ছাপ। হুট করে নয়, এখন বলে-কয়ে কুটুমবাড়ি যায় মানুষ। আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ করার প্রয়াসে হরহামেশাই আয়োজন চলে কুটুমবাড়িতে। এক থেকে দেড় যুগ আগেও রাজশাহী অঞ্চলে দূরের আত্মীয়রা হুট করে দলবেঁধে চলে এসেছে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি। আপ্যায়িত হয়েছে সাধ্য অনুযায়ী। তবে সময় বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে রীতিনীতিতেও পরিবর্তন এসেছে। এখন হুট করে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়ার পালা নেই। আগে থেকে জানান দিয়ে তারপর কুটুমবাড়ি মুখো হতে হয়। কুটুম আপ্যায়নের জন্য তাই প্রস্তুতও থাকে বাড়ির কর্তা। আগে শীতকাল কেন্দ্রিক আত্মীয়স্বজনদের পদচারণায় মুখরিত থাকত গ্রামীণ জনপদের পাড়া-মহল্লা। এখন কি শীত, কি বর্ষা সারাক্ষণই নানা অজুহাতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে কুটুম হাজির হয় বাড়িতে। দূরের কুটুমবাড়ি গিয়ে এক সপ্তাহ কিংবা তারও বেশি সময় অবস্থানের দিন শেষ হয়েছে। এখন কুটুম আসে তাৎক্ষণিক অতিথি হয়ে। সকালে যাওয়া তো বিকেলে ফেরা। খুব বেশি হলে একদিন এক রাত অবস্থান হয় কুটুমবাড়িতে। তবে এইটুকু সময়ের মধ্যেই আপ্যায়নের কোন সীমারেখা থাকে না। বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চলের গ্রামীণ জনপদে কুটুম আপ্যায়নের ধরণ পাল্টেছে। সময়ের ব্যবধানে পাল্টেছে আচার-আচরণও। দেড় থেকে দুই যুগ আগেও হুট করে যে কোন সময় চলে এসেছে দূরের আত্মীয়স্বজন। অনেক সময় পুরো পরিবারের সদস্যই বেড়াতে বের হয়েছে। গ্রামের কর্তারা বিপাকেও পড়েছে। আগে বাড়ির কাছে হাটবাজার ছিল না। তাই পোষা মুরগি, হাঁস, কবুতর, পুকুরের মাছ আর ঘরের মোটা চালের ভাত ছিল কুটুম্বিতার তালিকায়। এছাড়া বাড়ির কুঠিতে মজুদ গুড় দিয়ে তৈরি পিঠাপুলি। চালের গুড়ার তৈরি পিঠা পায়েশ ছিল। তাতেই ভোজন বিলাস হতো আত্মীয়দের। এবাড়ি ওবাড়ি খেয়ে কমপক্ষে এক সপ্তাহ ধরে অবস্থান করত কুটুম। আর জামাই-মেয়ে এলে আপ্যায়নের মাত্রা বেড়ে গেছে আরও। উঠোনে তাড়িয়ে মুরগি ধরা কিংবা জাল ফেলে পুকুরের বড় মাছ ধরে জামাই আপ্যায়নের রীতি ছিল রাজশাহী অঞ্চলের গ্রামীণ জনপদে। এ ধারা এখনও রয়েছে তবে পাল্টেছে রীতি আর আচার-আচরণ। সবখানে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। গ্রামের নিভৃত পল্লীর ঘরে ঘরে জায়গা করে নিয়েছে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট। বাড়ির পাশেই পা বাড়ালেই এখন বাজার। তাই মোবাইল ফোনে কন্টাক্ট করেই জামাই-মেয়ে কিংবা আত্মীয়স্বজন বেড়াতে আসে। এতে গৃহকর্তাও স্বস্তি পায়। আগে থেকেই বাজার করে প্রস্তুত থাকে। এ কারণে এখন আপ্যায়নেও গ্রামীণ জনপদে শহরের ছাপ দৃশ্যমান। কুটুম এলেও এখন ঘটা করে আর পুকুরে জাল ফেলতে হয় না। কিংবা বাড়ির পোষা মুরগি ধরতে হয় না। ফ্রিজের মজুদ মাছ মাংস পরিবেশন করা হয়। মোটা চালের পরিবর্তে পরিবেশন হয় পোলাও-কোর্মা। বাজারের মিষ্টি, দই আর কোমল পানীয় গ্রামের অতিথি আপ্যায়নেও অনুষঙ্গ। এখন নানা ওসিলায় কুটুম আসে। তবে শীত মৌসুমে কুটুমযাত্রার আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে এখনও বরেন্দ্রের ঘরে ঘরে। নতুন চালের ম ম গন্ধেভরা আটা দিয়ে তৈরি পিঠা-পায়েশের আয়োজন হয় এ সময়ে। নতুন খেজুরের গুড়। কিংবা খুব ভোরে মিষ্টি খেজুরের রসে ভিজিয়ে মুড়ির স্বাদ এখনও হারিয়ে যায়নি। তাই এই সময়ে কুটুম আপ্যায়নের রীতি এখনও রয়েছে আগের মতো। নতুন সামগ্রী দিয়ে খাবার তৈরিতে জুড়ি থাকে না এ সময়ে। সব বাড়িতেই শীত মৌসুমে থাকে কুটুমের আগাগোনা। একটু পেছনে ফিরে থাকালে-বরেন্দ্র অঞ্চলে গ্রামের কোনো নিমন্ত্রণ অনুষ্ঠানে গেলে হরহামেশাই দেখা মিলেছে পদ্মপাতার। বড় পদ্ম পাতায় দেয়া হতো অতিথিদের খাবার। তবে এখনকার সময় এমন দৃশ্য মেলা ভার। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এসব হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে আত্মীয়তার বন্ধন রয়েছে আগের মতোই। এখন হেমন্ত। দুয়ারে উঁকি দিচ্ছে শীত। আর ক’দিন পরই গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নে শীতের পিঠা আর পায়েস খাওয়ার ধুম পড়বে। আত্মীয়দের নিয়ে আগে বছরের শুধুমাত্র শীতকাল বেছে নেয়া হলেও এখন সারাবছরই আয়োজন হয় অতিথি আপ্যায়নের। Ñমামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী থেকে
×