ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সেকাল-একালের কুটুম্বিতা

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ২২ অক্টোবর ২০১৬

সেকাল-একালের কুটুম্বিতা

গরুর গাড়ির চাকার ক্যাঁ-ক ক্যাঁ-ক শব্দ বাড়ির অন্দরে পৌঁছাতেই গৃহকর্ত্রী, ছেলেমেয়ে পড়শিরা তড়িঘড়ি অতিথি বরণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই অতিথি কাছের স্বজন, কুটুম্ব। বাঙালীর সমাজ জীবনে কাছেরজনের সঙ্গে দিন কয়েকের জন্য মিলিত হয়ে একসঙ্গে থাকা চিরন্তন মধুময়তা। যা হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত। বাংলা কুটুম্ব শব্দটির মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় ভালবাসার আবেগের এক ধরনের হৃদ স্পন্দন। যা ভাবায়, হাসায়, কাঁদায়, মনের উচ্ছ্বাসে উড়ন্ত বলাকা হয়ে উড়িয়ে নিয়ে যায় অনন্ত ভাললাগার ভালবাসার রাজ্যে। নিজের ঘরের উঠান হয়ে ওঠে সেই স্বপ্নময় রাজ্য। যেখানে শুধুই হৃদয় ছোঁয়া কত না কথা মালার গাঁথুনি। সেদিনের সে-ই কুটুম্বিতা দিনে দিনে হারিয়ে যেতে বসেছে। বর্তমানে যে কুটুম্বিতা একেবারেই নেই, তা নয়। আছে তবে ভিন্নমাত্রায়। মনে হবে নানা রোগ ব্যাধি নিয়ে কোন রকমে ধুকে ধুকে টিকে আছে। আরেকভাবে বলা যায় কুটুম্বিতা বয়োবৃদ্ধ হয়ে গেছে। অতি বয়স্ক মানুষেরা যেমন ভুলো মনের হয়, সহজে চিনতে পারে না, কোন জিনিস কোথায় রেখেছে তা সহজে মনে করতে পারে না, অনেক সময় চেনা পথ হারিয়ে ফেলে। বর্তমানে কুটুম্বিতা কিছুটা (কিছুটা কেন অনেকটাই) সেই পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কুটুম্বিতা বয়সজনিত কারণে নানা ব্যাধি ব্যামোতে আক্রান্ত। চিকিৎসাতেও সারে না। কুটুম্বিতার অধ্যায় সবচেয়ে মধুর ছিল পঞ্চাশের দশক থেকে ষাটের দশকের পুরোটা সময়। সত্তর দশকের মধ্যভাগ থেকে আশি দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত কুটুম্বিতায় মেডিক্যালের এ্যানাটমি ক্লাসের ব্যবচ্ছেদের পালা শুরু হয়। তারপর কুটুম্বিতার হৃদয়ের সেই যে বাইপাস শুরু হলো হৃদগমনের আর্টারিগুলোর অবস্থা ঢাকা মহানগরীর জ্যামের মতোই। কেউ আর কারও খোঁজ রাখে না। ঢাকা মহানগরীর ফ্ল্যাট বাড়ির এক তলার মানুষ আরেক তলার খবর রাখে না। ঢাকার বাইরের শহরগুলোর পুরনো এলাকায় পড়শির খবর নেয়ার পালা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। তবে নতুন করে গড়ে ওঠা আধুনিক ইমারতের উপশহরের বাসিন্দাদের অবস্থা ঢাকা মহানগরীর মতোই। মনে হবে মানুষ কম্পিউটার। নির্দিষ্ট প্রোগ্রামের সফটওয়্যার দেয়া আছে। সেই মতোই চলছে। প্রযুক্তি জীবনে চলার বেগ এনেছে, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। আর কুটুম্বিতা ফাস্ট ফুডের স্যান্ডউইচের মতো। ওপর নিচ দু’দিক থেকেই চাপ। রাজধানী ঢাকা মহানগরীর কয়েকটি স্থানে ‘কুটুমবাড়ি’ লেখা সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। যদি হৃদয়ের সেই কুটুম মনে করে সেখানে ঢুকে পড়েন, তবেই হয়েছে। প্রথমে তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা আপনার মনকে ভরিয়ে দেবে। তারপর আপ্যায়নের পালা। পছন্দের খাবার খাবেন। সবশেষে যা বুঝতে পারবেন, তা হলো আপনার পকেট গড়ের মাঠ। সব খাবারের আগুনে দাম পরিশোধে আপনার হাতের সময় যন্ত্রে ‘টুয়েলভ ও ক্লক।’ ওখান থেকে বের হয়ে আসার পর মন বলে উঠবে ‘এই আর যাবি কুটুম বাড়ি!’ তখন ছেলেবেলার সেই ছড়া মনে পড়বে ‘দাদা আর যাব না ওই ইসকুলেতে।’ এবার দেখা যাক কেমন ছিল সেদিনের কুটুমবাড়ি। পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগে একান্নবর্ত্তী পরিবারগুলো যখন খ-িত হওয়ার পালা শুরু হলো, তখন কুটুম্বিতার গাঢ় প্রকাশ ঘটতে থাকে। খ-িত পরিবারের সদস্যরা তখন বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। বনেদী ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যদের অনেকে চাকরি নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেতে থাকে। সরকারী চাকুরেদের বদলিজনিত কারণে ঘুরতে হয় বিভিন্ন জেলা-মহকুমায়। বিয়ে শাদীর পালায় তৈরি হয় নতুন আত্মীয়। তৈরি হয় পরিচিতজন, বন্ধুজন। তারাও আত্মীয়র চেয়ে কোন অংশে কম হয় না। অনেক সময় রক্তের সম্পর্ক ¯েœহের সম্পর্কের কাছে হার মানে। পরিধি বেড়ে যায় স্বজনের। সম্পর্ক ঠিক রাখতে চিঠি অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করে। মাধ্যম হয় পোস্ট অফিস। চিঠির আদান-প্রদান বেড়ে যায়। সেদিনের চিঠি মানেই সাদা কাগজে লিখে খামে ভরে পাঠিয়ে দেয়া অথবা পোস্টকার্ডে লেখা। কুটুম্বিতার প্রাথমিক অধ্যায় শুরু এখানেই। তারপর বছরের কোন এক সময় একে অপরের বাড়িতে পরিবার পরিজন নিয়ে যাওয়া। কে কখন কোথায় যাবে তার দিন তারিখ ঠিক করে চিঠি পাঠানো। চিঠি পাওয়ার পর শুরু হয় কাউন্ট ডাউন (ক্ষণ গণনা)। আত্মীয়স্বজন বেড়াতে আসার কথা শোনার পরই পরিবারের শিশু কিশোরদের সে কি আনন্দ। কর্তা-কত্রীর প্রস্তুতি নেয়ার পালা শুরু হয়। কে কোথায় কোন ঘরে থাকবে। কুটুম্ব বেশি এলে ঢালাও বিছানার আয়োজন করা হয়। খাবার দাবারের মেনু একেক দিন একেকটা। মাছ গোশত পোলাও কোর্মা থাকে মেনুতে। কাছে পুকুর থাকলে মাছ ধরা। শীতের সময় হলে পিঠা পুলি বানিয়ে সকলে একসঙ্গে বসে খাওয়া। কুটম্বরা যে শুধু বসে থাকবে তাও নয়। রান্নাবান্নায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় তারা। কাছে নদী থাকলে নৌকা ভ্রমন। আশেপাশে বেড়ানোর জায়গা থাকলে সকলে মিলে ঘুরে আসা। কেরাম লুডু ব্যাডমিন্টন কানা মাছি লুকোচুরি খেলা কোনটিই বাদ যায় না। পরিবারের সদস্যদের কেউ গান জানলে উঠানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। সেই অনুষ্ঠানে পড়শীদের আমন্ত্রন জানানো। কুটুম্বিতার আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়া। দিন কয়েক মহা আনন্দের পর এক পর্যায়ে চলে আসে বিদায়ের ক্ষণ। কাপড় চোপড় গোছানো শুরু হলেই বোঝা যায় ফিরে যাওয়ার পালা শুরু হয়েছে। শিশু কিশোররা লুকিয়ে কাঁদে। বড়দেরও চোখের কোণে নেমে আসে জল। বিদায়ের ক্ষণে একে অপরকে জড়িয়ে দু’ফোটা চোখের জল ফেলে। প্রতিশ্রুতি নিয়ে যায় ফিরতি কুটুম্বিতার। দিন কয়েকের হৈ হুল্লোরের রেশ সহজে কাটে না। বাড়িটি ফাঁকা মনে হয়। তারপর নিয়মের আপন গতিতে সব ঠিক হয়ে যায়। ইংরেজির সেই কথার মতো ‘টাইম হিলস অল সরোজ’। এভাবে কুটুম্বিতার রেশ চলতে থাকে কোন না কোন বাড়িতে প্রায় ভর বছর। পরিবার নিয়ে কুটুম্বিতা ছাড়াও নানা কারণে কোন কুটুমের আগমন ঘটে কোন বাড়িতে। সেদিনে গ্রামীন জীবনে মধ্যবিত্ত বাড়িতে কোন কুটুম গেলে আতিথ্য ছাড়া ফিরে আসতে পারেনি। নি¤œ পরিবারে আর্থিক কারণে তেমন আতিথেয়তা হয়ত ছিল না। তবে ঘরে যা সম্বল আছে তাই দিয়ে এমন কি গুড় চিড়া মুড়ি খাইয়ে কুটুম্বকে সন্মান করা হয়েছে। দুপুরের খাবারের সময় কুটুম এলে ঘরে মুরগীর ডিম থাকলে তা দিয়ে অথবা কোন বাড়ি থেকে ডিম ধার করে এনে কুটুম বিদায় করা হয়েছে। সেদিনের গ্রামীন জীবনে খাসি ও গরুর মাংস কিনতে হলে অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে হাটবারের জন্য। অর্থাৎ সপ্তাহের দুই দিন হাটে গরু ও খাসি জবাই হয়ে মাংস বিক্রি হতো। এমনও হয়েছে কুটুম্ব এসেছে বাজারে মাংস মিলছে না তখন শহরে গিয়েও মাংস আনা হয়েছে। আজকের প্রজন্ম এইসব কথা শুনে শুধুই হাসবে। প্রজন্মের অনেকে ‘কুটুম্ব’ শব্দের আভিধানিক অর্থ সহজে বলতে পারবে কিনা সন্দেহ। যারা কুটুম্ব শব্দটি শুনেছে তারা আগ্রহ ভরে বাবা মায়ের কাছে এর অর্থ জেনে নিয়েছে। আজকের দিনে সেদিনের সেই কুটুম্বিতা নেই। আছে ভিন্নভাবে। প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রযাত্রায় সেই কুটুম্বিতার সময় বা কোথায়! কোচে ট্রেনে নিজের গাড়িতে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া হয় সঙ্গে অনুষঙ্গের কাজ নিয়ে। কাজও হয়, দিন দুয়েক থাকাও হয়। এটাই আজকের যান্ত্রিক জীবনের অংশ। সময় করে ঘুরে বেড়ানোর সময় বুঝি এখন আর নেই। আত্মীয়তার বন্ধনও এখন অনেক শিথিল। কখনও এই বন্ধনে ঢুকে পড়ে স্বার্থ। যা অনেক সময় খালি চোখে দেখা যায় না। বিয়ে শাদীর বেলায় নতুন কুটুম্ব তৈরিতেও সেই হৃদ্য নেই। দূর থেকে কাছে টেনে নেয়ার পর ছোঁয়ার সময় অনুভব করা যায় অদৃশ্য কাঁচের দেয়ালের। বর্তমানের কুটুম্বিতা এই পর্যায়েই এসেছে। হৃদয়ের আবেগের মধুময় বন্ধনের আর্টারিগুলো ব্লক হয়ে যাচ্ছে। হৃদয়ের কুটুম্বিতা মূল আর্টারি থেকে সরিয়ে বাইপাস হয়ে সঞ্চালিত হচ্ছে। যেখানে হৃদয়ের মধুমাখা কথাগুলো কৃত্রিম। দেখা সাক্ষাত হচ্ছে, কথা হচ্ছে, আপ্যায়নও হচ্ছে। মনে হবে তার মধ্যে মেলোডির ছন্দ নেই। কুটুম্বিতা এখন ছন্দহীন...। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×