ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মহানন্দায় ১৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে রাবার ড্যাম হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ২২ অক্টোবর ২০১৬

মহানন্দায় ১৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে রাবার ড্যাম হচ্ছে

ডি.এম তালেবুন নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ মহানন্দা নদী পুরো চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভা ঘিরে রেখেছে। বিজিবি ক্যাম্পের সামনে থেকে শুরু হয়ে পুরান বাজার, চেম্বার ভবন, থানা, রেজিস্ট্রি অফিস, হাসপাতাল হয়ে শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর সেতুর নিচে শহরতলীর টিকরামপুরের কাছাকাছি বাঁক নিয়ে রাজারামপুর ডিঙ্গিয়ে শেখ হাসিনা সেতু পেরিয়ে নামনিমগাছি অতিক্রম করে এই পৌরসবার শেষ গ্রাম দ্বারিয়াপুর ছুয়ে মহানন্দা চলে গেছে পদ্মায়। তাই চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার অংশজুড়ে মহানন্দা নদীর অবস্থান। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার দেড় লাখ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে ও খরা মৌসুমে নদীর নাব্য ধরে রাখতে পানি উন্নয়ন বোর্ড এবার এগিয়ে এসেছে। শহরের এই অংশের নদীর ওপর দেশের বৃহত্তম রাবার ড্যাম নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫৬ কোটি টাকা। যা ইতোমধ্যেই একনেকে অনুমোদন হয়ে শুরু হয়েছে প্রাথমিক কাজ। এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনর একটি প্রতিশ্রুত প্রকল্প। তিনি এই ড্যাম তৈরির মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের খুবই অবহেলিত বরেন্দ্র অঞ্চল নিয়ে গঠিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহর বা নগরীকে বাঁচাতে চেয়েছেন, চেয়েছেন উন্নয়ন করতে। ৩২৬ মিটারের রাবার ড্যামটির নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত রাবার ড্যাম নির্মাণসহ শহর সংলগ্ন এলাকায় নদী খনন, সেচের আওতাভুক্ত জমির পরিমাণ, অগ্রণী সেচ প্রকল্প এই পৌরসভার মধ্যেই অবস্থিত। বিজিবি ক্যাম্পের ধার দিয়ে এই সেচ প্রকল্পটি বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এই অঞ্চলের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প। সেচের আওতাভুক্ত জমির পরিমাণ নিরূপণসহ পানির প্রাপ্যতা এবং জলাধারে পানির স্থায়িত্বকাল ও ধারণ ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শক নিয়োগসহ পাউবো কর্তৃক ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংকে (আইডব্লিওএম) পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিয়োগ দিয়ে সমীক্ষা ফলাফল সম্পন্ন করেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শেষ হলে পৌরসভা এলাকাসহ শহরের অপর পারের প্রায় আট হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসবে। বেসরকারী হিসাবে ১৫ হাজার হেক্টর জমি চাষের আওতায় আসবে। উপকৃত হবে শহর ও শহরতলী এবং সংলগ্ন এলাকার কয়েক লাখ হেক্টর আম বাগান। শহর সংলগ্ন নদীর ৩২৬ মিটার রাবার ড্যামের বদৌলতে নদীর উজান ও ভাটি মিলিয়ে ৯৫ কিলোমিটারে ফিরে আসবে নাব্য। উৎপন্ন হবে অতিরিক্ত দুইশত কোটি টাকার ফসল। পাশাপাশি রাবার ড্যামের কারণে নদীর উজানে শতাধিক বিল, ঝিল পুকুরে সারা বছর পানি ধরে রাখার কারণে মাছ চাষে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করবে। সব মিলিয়ে মাছ চাষ থেকে অতিরিক্ত প্রায় একশত কোটি টাকা আসবে। যা পৌরসভাসহ পুরো জেলার চাহিদার উদ্বৃত্ত হয়ে বাইরে পাঠাবার সম্ভাবনা দেখা দিবে। বাড়বে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। বিস্তৃত বরেন্দ্র ভূমির সেচ সুবিধা সম্প্রসারিত হলে চাপ কামে আসবে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর থেকে। পাশপাশি চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত দেশের সর্ববৃহৎ আর্সেনিক আক্রান্ত শহরতলী রাজারামপুরকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে মহারাজপুরের আর্সেনিকও হোঁচট খাবে। সাধারণ টিউবওয়েলে আর্সেনিক থাকবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টে প্রতি ঘণ্টার চাহিদা ৭৭ হাজার গ্যালন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে বড় ধরনের সুবিধা ভোগ করবে। ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লানটি শহরের পশ্চিমে নতুন হুজরাপুর এলাকাতে (খালঘাট) নির্মাণাধীন। আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে চালু হতে পারে। রাবার ড্যামটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর সংলগ্ন শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর বীরশ্রেষ্ঠ সেতুর উজানের খুবই কাছাকাছি নির্মাণের কারণে মহানন্দার উভয় তীরে এখন যে ৪৩টি সেচ প্রকল্প রয়েছে তা আরও বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে খরা মৌসুমে পানি নদীর তলদেশে চলে যাবার কারণে কৃষকদের যে বাড়তি পয়সা গুনতে হতো ড্যাম নির্মাণের ফলে তা আর হবে না। বহু সেচ প্রকল্প খরার কারণে বন্ধ হলে খাবার ফলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতো। খুবই কম রেটে এসব প্রকল্প পরিচালিত হবে বলে পাউবোর সমীক্ষা রিপোর্টে উঠে এসেছে। রাবার ড্যাম তৈরি হলে শহর সংলগ্ন প্রায় ৩২ কিলোমিটারসহ ভাটি ও উজানে পানি বেড়ে পাড় ছুঁই ছুঁই করবে। এমনকি খরা মৌসুমেও ড্যামের ভাটিতে প্রায় ২৮ কিলোমিটারে পূর্বের মাতা পদ্মার পানি মহানন্দায় প্রবেশ করবে। তবে মাঝে মধ্যেই ড্যামের ভাটিতে ড্রেজিং প্রয়োজন হবে বলে পাউবোর পরিকল্পনা পরিচালক জনকণ্ঠকে জানান। সমীক্ষা প্রকল্প পরিচালক জানান চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর সংলগ্ন ড্যামটি দেশের সর্ববৃহৎ (লম্বার দৈঃ) ৩২৬ মিটার ও উপরের স্তর ৩৫৩ মিটার) হওয়ার কারণে অর্থনৈতিক দিক দিয়েও লাভবান হবে দুটি শহর এলাকা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর পুরোপুরিভাবে এবং রাজশাহী মহানগর আংশিকভাবে উপকৃত হবে। বিশাল এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পূর্বে একাধিকবার সুবিধাভোগী জনসাধারণ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, বরেন্দ্র উন্নয়ন প্রকল্প বিভাগের প্রকৌশল শাখা, চাঁপাই পৌরসভার প্রকৌশল বিভাগ ও এলজিডির প্রকৌশল বিভাগের মতামত নিয়েছেন পাউবো। এসব মতামত গ্রহণে পাউবোর বিভিন্ন শাখার উর্ধতন কর্মকর্তারা বছরের পর বছর মাঠে নেমে কাজ করেছেন। তাই প্রকল্পের সমগ্র কারিগরি, পরিবেশেগত, আর্থ সামাজিক দিক বিবেচনা করে শহরবাসীর জন্য চিত্তাকর্ষক বিনোদন স্পট ও শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর বীরশ্রেষ্ঠ সেতু হয়ে বিজিবি ক্যাম্প পর্যন্ত দুই কিলো নদীর পাড়ে বাঁধ নির্মাণসহ তার ওপর দিয়ে পাকা সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। অনুরূপভাবে শহরের অপর পারের বারঘরিয়া-খালঘাট পর্যন্ত বাঁধটি সংস্কার করা হবে বলে জানা গেছে। যাতে করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের মানুষ সকাল সন্ধ্যাতে হাঁটাহাঁটি, ভ্রমণ, আড্ডা দেয়া ও মুক্ত বাতাস উপভোগ করতে পারবে। রাবার ড্যামের বিশাল প্রকল্পটি যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ও ইচ্ছাতে তৈরি হচ্ছে সেহেতু পাউবো কর্মকর্তারা প্রায়শ এলাকায় আসছেন। তবে প্রকল্প পরিচালকের অফিস এখানে নির্মাণ হবে না ঢাকা থেকে নিয়ন্ত্রণ হবে এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি। সবাই বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। রাবার ড্যাম প্রকল্পের অফিস চাঁপাইনবাবগঞ্জে অস্থায়ীভাবে নির্মাণ করা না হলে বড় ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের আশঙ্কা করছে অনেকেই। আর এই কারণেই প্রকল্প ব্যয় নতুন করে বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালে চাঁপাইয়ের এক জনসভায় রাবার ড্যাম নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিলে পাউবো নড়েচড়ে বসে। নির্মাণ কাজ ২০১৭ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।
×