ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

৬৭ বছরে আওয়ামী লীগ

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ২২ অক্টোবর ২০১৬

৬৭ বছরে আওয়ামী লীগ

(গতকালের পর) নতুন কাউন্সিলে যদি এদের মধ্য থেকেই অধিকাংশ নির্বাচিত নিযুক্ত হন, তা’হলে যে আওয়ামী লীগ এ পর্যন্ত দেখছি, তা আর থাকবে না। আদর্শ ও নীতিগত পরিবর্তন হবে। শেখ হাসিনার আমলে লিবারেল বা মধ্যবামের সমর্থকরা যে সমর্থনভিত্তি তৈরি করেছিলেন তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ক্ষেত্রে দলনেত্রী জঙ্গিদের ক্ষেত্রে যে রকম ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছিল সে রকম করলে, দল একরকম হবে। যদি সেটি না করেন তা হলে দলে টানাপোড়েন পড়বে বই কমবে না। এতদিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো [আইনে আছে রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠন থাকবে না। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর আইনের প্রতি শ্রদ্ধা আছে এমন মন্তব্য করা দুরূহ] ছিল মোটামুটি পরিচ্ছন্ন ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সহযোগী সংগঠনগুলোর স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার যোগ্যতা ও ক্ষমতা ছিল। কিন্তু সেটি ক্রমে হ্রাস পেয়ে এখন শূন্যের কোঠায়। দলের যেসব সহযোগী সংগঠন আছে বিভিন্ন স্বার্থের কারণে সেখানেও দ্বন্দ্ব আছে। লীগ আয়োজিত একটি সেমিনারে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনারা ছাত্রলীগ যুব বা মহিলা লীগদের আমন্ত্রণ জানাননি? শোনার কথা তো তাদের।’ অম্লানবদনে তারা বললেন, ছাত্রলীগকে আনতে চাই না। তাতে ঝামেলা বাড়বে। ছাত্রলীগের প্রচুর প্রশংসা করতে পারেন। উদ্দীপত সেøাগান তৈরি করে দিতে পারেন। কিন্তু কঠিন সত্য যা কোন নেতা বলবেন না, তা’হলো, ছাত্রলীগকে সবাই এড়িয়ে যেতে চায়। কেন চায়? সেটি কেউ জানেন না এমন কথা বললে বলতে হবে, তিনি জেগেও ঘুমিয়ে আছেন। কিন্তু এসব সংগঠনগুলো ছিল এক সময় অ্যাসেট বা সম্পদ। এখন অ্যাসেট হয় নেতাদের আর দল অর্জন করে দুর্নাম। এখন এগুলো কেন লাগেজ তার কারণ, এরা নানাবিধ অর্থনৈতিক কর্মকা-ে জড়িয়ে গেছে। ছাত্রনেতা হওয়া মানে এক বছরে গাড়ি বাড়ি হওয়া। সরকারের অনেক নীতি এসব অজস্র লীগের কারণে কার্যকর করা যাচ্ছে না। দলনেত্রী ও নেতৃত্ব চাইলে এক্ষেত্রে কিছুই করতে পারেন তা নয়। প্রাক ১৯৭১ সালের মতো এদের অর্থনৈতিক কর্মকা- থেকে বিরত রাখতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং এদের কাজ করার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দিতে হবে। ছাত্রলীগের শিক্ষা সংক্রান্ত কি কোন দাবি আছে বা ছিল গত এক দশকে? কাগজে কলমে সবারই কর্মসূচী আছে। ই-টেন্ডারের প্রচলন এদের দুর্বৃত্তায়ন অনেক কমিয়েছে। সব সংস্থায় ই-টেন্ডার হলে এবং কর্মকর্তারা সৎ হলে দুর্বৃত্তায়ন অনেক বন্ধ হবে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ ঘোষণা করেছে, যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানদের দলে নেবে না। এটি শুভ সংবাদ। তবে, এর সঙ্গে যদি যুক্ত হতো জামায়াত ও জঙ্গী পিতার সন্তানদেরও দলে নেবে না তা হলে তা আরও সম্পূর্ণ হতো। শেখ হাসিনার এ আমলে এত সাফল্য আছে যে, হিসাব রাখা মুশকিল ক্রমাগত সাফল্য ও কার্যকর বিরোধী দলের অভাবে দলীয় নেতৃত্বে অনেক বিষয়ে অতি সন্তুষ্টি ও মোহের সৃষ্টি করবে। এর ফলে, নেতৃত্বের মনে হয়, তারা যা করছেন তা-ই ঠিক। অন্যরা যদি বিপরীত বলে সমালোচনা করে, তার অর্থ তারা দেশের ভাল চায় না। এ মনোভাব কর্তৃত্বপরায়ণতার জন্ম দেয়। এবং কর্তৃত্বপরায়ণতার পরিণতি কি আমরা জানি। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সরকারের প্রধান এজেন্ডা এখন জঙ্গী দমন। দক্ষিণ এশিয়ার জঙ্গী দমনে শেখ হাসিনা নিঃসন্দেহে এগিয়ে আছেন। এ সাফল্য দলে ও সরকারের অতীব সন্তুষ্টির সৃষ্টি করেছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, শুধু নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কোথাও জঙ্গী দমন করা যায়নি। সাময়িকভাবে হয়ত নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। জঙ্গিত্বের বিষয়টি মূলত আদর্শের লড়াই, মনোজগত জয় করার লড়াই। এক্ষেত্রে শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। শিক্ষা ক্ষেত্রের সাফল্যে সবাই অস্থির। কিন্তু সরেজমিনে কেউ দেখেননি। নিম্ন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আসলে কী অবস্থা আগামী দশ বছরে বাংলাদেশে দক্ষ মানবশক্তি পাওয়া দুষ্কর হবে। একটি উদাহরণ দিই, উচ্চ মাধ্যমিকে প্রচুর জিপিএ ৫ সবাইকে হর্র্ষোৎফুল্ল করেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ পরীক্ষায় কেন ৩ থেকে ৫ ভাগ করল এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন কেউ করেননি। একদিকে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন জঙ্গীদের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স, অন্যদিকে এনসিটিবির কর্মকর্তা পাঠ্যবই থেকে জীবনানন্দ দাশের বাংলাদেশ বিষয়ক কবিতা বাদ দেন, অমুসলমান নাম সব কর্তন করেন এবং মাদ্রাসার সব পাঠ্য বইয়ে প্রথম পাঠ জিহাদই শ্রেষ্ঠ পথ। একদিকে দমন অন্যদিকে পৃষ্ঠপোষকতা কোথাও হয় না। এখানেই আত্মসন্তুষ্টি ও বাস্তবের ফারাক। এ ধরনের অনেক বিষয় আছে যার উল্লেখ করলাম না। বঙ্গবন্ধু হত্যার কারণ, তিনি নিরস্ত্রদের ক্ষমতায়ন করেছিলেন। পাকিস্তানীমনা সেনারা তা পছন্দ করেনি। যখন তারা ১৯৭১ সালে যুদ্ধে গেছেন সেখানেও আলোচনা করেছেন, দেশ স্বাধীন হলে তারা ক্ষমতায় থাকবেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ আছে আমার লেখা ‘বাংলাদেশী জেনারেলদের মন’ গ্রন্থে। সে কারণে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখলাম না। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৫ সালের পর ক্ষমতায় থাকতে সেনা প্রতিনিধিরা বিএনপি ও জাতীয় পার্টি গড়ে এবং জামায়াতকে সহযোগী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে ও জামায়াতের অনেক রিচ্যুয়াল ও আদর্শ মনে প্রাণে গ্রহণ করে। জিয়া-এরশাদ বা আরও পরে মইন সিভিল সমাজের বিপরীতে সামরিক সমাজ বা সামরিকায়ন করতে চেয়েছেন। এখন পরিস্থিতির খানিকটা বদল হয়েছে পাকিস্তানীমনারা অপসারিত। যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা বিএসএ থেকে প্রশিক্ষিত। এর অর্থ এ নয় যে, পাকিমনা কেউ নেই তারা এখন ক্ষমতা দখলে আগ্রহী নয় কারণ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তা এখন অপরাধ। তারা আগ্রহী থাইল্যান্ডের মতো সেনাবাহিনী গঠনে। সরকারকে সহায়তা দানের প্রতিশ্রুতিতে তাদের অধিক সুবিধা প্রদান ও সিভিল প্রশাসনের অনেক পদে তাদের পদায়ন সিভিল সমাজে অসন্তুষ্টি সৃষ্টি করেছে। বিষয়টি এত দৃশ্যমান যে বলার নয়। এটি এরশাদ আমলের মতো না হয়ে যায় এ বিষয়ে দল বা সরকারের সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়। সশস্ত্র বাহিনীর জন্যও। একইভাবে বড় বড় প্রকল্প কিছু বিজনেস হাউসের একচেটিয়া প্রভাব ও গ্রহণযোগ্য নয়। এদের অতি শক্তিশালী করা মানে সরকারকে দুর্বল অবস্থায় ফেলে দেয়া। আওয়ামী লীগ ইতিহাসের কথা বলে কিন্তু ইতিহাস সংরক্ষণে উৎসাহী নয়। ৬৭ বছর পর তাদের একটি স্থায়ী দলীয় অফিস হতে যাচ্ছে। তাদের কোন আর্কাইভ নেই। দলের একটা অ্যাকাডেমিক ব্যাপার থাকে সে সব ধারণা থেকে তারা মুক্ত। আজ আওয়ামী লীগের ইতিহাস লিখতে গেলে কোন কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। আপনারা কি কোথাও পাবেন ১৯৪৮-৪৯ সালে বঙ্গবন্ধু প্রকাশিত একটি পুস্তিকা, যেখানে পূর্ব ও পশ্চিমের এত ফারাক কেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। এই যে উন্নয়নের ধারা তার কোন দলিল সংরক্ষিত আছে অফিসে? বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস একদিকে আওয়ামী লীগেরই ইতিহাস এবং সে ইতিহাসের উপাদান সংরক্ষণের দায়িত্ব আওয়ামী লীগ নেতৃত্বেরই। বর্তমান কাউন্সিল সফল হবে এতে সন্দেহ নেই। শেখ হাসিনাই সভাপতি হবেন তাতেও কোন সন্দেহ নেই। কারণ তার কোন বিকল্প নেই। তবে পরবর্তী নেতৃত্ব গঠন করে যাওয়া তার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু আমরা আশা করব, দলের নেতৃত্ব যাতে দক্ষিণপন্থার দিকে না ঝুঁকে, আশা করব নেতৃত্ব হবে লিবারেল, প্রগতিবাদী কথায় কথায় ধর্মব্যবসায়ীদের হুমকিতে কাবু হয়ে সমঝোতা করবে না। এটি বিশেষভাবে বলার কারণ, লক্ষ্য করেছি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ‘কমিউনিস্ট হটাও’ সেøাগান যত জোরে হেজাবিদের হটাও সে সেøাগান তত জোরাল কেন শোনাও যায় না। কমিউনিস্ট হটাও সেøাগান ছিল মুসলিম লীগারদের আইয়ুব খানদের জামায়াতের। যারা বাম রাজনীতি থেকে এসেছেন তারা কমিউনিজমে বিশ্বাস করলে আওয়ামী লীগে আসতেন না। যে জাসদ বঙ্গবন্ধুর ‘চামড়া’ খুলে নিতে চাইত তাদের নিয়ে তো স্বচ্ছন্দে আছেন আওয়ামী লীগাররা। নতুন নেতৃত্বকে অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে বিশ্বাস করতে হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার অব্যাহত রাখতে হবে। জঙ্গীবাদ নির্মূলে সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। অর্থনৈতিক জিডিপির মতো শিক্ষা-সংস্কৃতির জিডিপি বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। আওয়ামী লীগ থেকে হেজাবি ও তার সমর্থকদের হটানোর উদ্যোগ নিতে হবে। ফিরিস্তি অনেক বড় করা যায় কিন্তু করে লাভ নেই। নতুন নেতৃত্ব প্রবীণ নবীন মিশিয়ে করাই বাঞ্ছনীয় তাতে ভারসাম্য থাকে। সবচেয়ে বড় কথা কাউন্সিলদের কথা বলার সাহস রাখতে হবে। শুভ এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখতে হবে। আগামী নির্বাচনে জয়ী হওয়ার চিন্তাও মাথায় রাখতে হবে। কারণ, বিএনপি-জামায়াত রেখে শুভ রাজনীতির সূচনা করা যাবে না। আওয়ামী লীগের বৃদ্ধি বাংলাদেশের সম্ভাবনা, আমাদের ভবিষ্যতের অনেক কিছুই নির্ভর করবে কাউন্সিলরদের ওপর, শেখ হাসিনার ওপর। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তৃণমূলের কথা শোনেন না এ কথা সমালোচকরাও বলবেন না। শোনেন কিন্তু কী করবেন সেটি তার এখতিয়ার। এখন অন্তত এটি বিশ্বাস করি, শেখ হাসিনা যখন আছেন নীতিগত অবস্থানের খুব একটা পরিবর্তন হবে না। সমাপ্ত
×