ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা সেতুর সুপার স্ট্রাকচার বসাতে মাওয়ায় আসছে ৪ হাজার টনের ক্রেন

প্রকাশিত: ০৬:১২, ২২ অক্টোবর ২০১৬

পদ্মা সেতুর সুপার স্ট্রাকচার বসাতে মাওয়ায় আসছে ৪ হাজার টনের ক্রেন

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মাওয়া থেকে ফিরে ॥ মাওয়া আসছে চার হাজার টন ক্ষমতার ক্রেন। পদ্মা সেতুর কর্মযজ্ঞে ব্যবহৃত এটিই সবচেয়ে ভাড়ি যন্ত্র। বিশাল এই ক্রেনই পদ্মা সেতুকে দৃশ্যমান করবে। পদ্মা সেতুর এক স্প্যান পরিমাণ (১৫০ মিটার) সুপার স্ট্রাকচার ক্রেনই তুলে নিয়ে পিলারের মধ্যে বসিয়ে দেবে। এক স্প্যান সুপার স্ট্রাকচারের ওজন প্রায় ২ হাজার ৯শ’ টন। আর এই ক্রেনের ধারণক্ষমতা চার হাজার টন। তাই সুপার স্ট্রাকচারটি অনায়াসেই বসিয়ে দিতে পারবে। গত ১২ অক্টোবর চীনের জোহাও থেকে মাদার ভেসেলে করে সমুদ্র পথে এটি রওনা হয়েছে। আগামী নবেম্বরের ৩য় সপ্তাহের দিকে ক্রেনটি মাওয়া পৌঁছার কথা রয়েছে। এদিকে এক হাজার টন ওজনের ভ্রাম্যমাণ ক্রেন বৃহস্পতিবার মাওয়ায় পৌঁছেছে। আর ২০ হাজার কিলোজুল ক্ষমতার হ্যামারও মংলা থেকে রওনা দিয়েছে। মঙ্গলবার এটি মাওয়া পৌঁছার কথা রয়েছে। জার্মানির এই হ্যামার আগেই সমুদ্র পথে ১৭ অক্টোবর মংলা পৌঁছে। এরপর আনলোড ও কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের পর লাইটার জাহাজে বৃহস্পতিবার বিকেলে মাওয়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। এই এসব আয়োজনই ডিসম্বেরের দিকে পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান করার প্রচেষ্টা। প্রথম স্প্যানটি স্থাপন করা হবে জাজিরা প্রান্তে। তাই এই প্রান্তের ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের চূড়ান্ত পর্যায়ের কাজ চলছে। দ্বিতীয় স্প্যানটি স্থাপন করা হবে মাওয়া প্রান্তে ৬ ও ৭ নম্বর পিলারে। সেখানেও কাজ চলছে। পদ্মা সেতু যে কাজ হয়েছে সেগুলোতেও নানা রকম কিছু দৃশ্যমান হলেও সেতুর অবয়ব বোঝা যায়নি। পানির নিচেই ছিল অনেক কাজ। আর এখন অবয়ব দৃশ্যমান করার আয়োজন চলছে। তাই মহূর্তটি যেন ফুলের বাগানে ফুল ফোটার আগ মুহূর্তের মতো। প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, দু’টি পিলারের ওপর স্প্যান-গার্ডার বসিয়ে দেয়া এখন সময় ব্যাপার মাত্র। আর এই স্প্যান বসিয়ে দেয়ার পরই পদ্মা নদীর ওপরে সেতু আকৃতি স্পষ্ট হবে। এভাবে একটার পর একটা করে মোট ৪২টি পিলারের ওপর ১৫০ মিটার দীর্ঘ ৪১টি স্প্যান বসবে। তৈরি হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু। মাওয়ায় কুমারভোগে পদ্মাতীরের অদূরে ট্রাস ফেব্রিকেশন ইয়ার্ডে সেতুর উপরিভাগের সুপার সন্ট্রাকচার (স্প্যান) জয়েন্টের কাজ চলছে। চীন এবং বাংলাদেশের শ্রমিকরা যৌথভাবে সেতুর জয়েন্ট, সেকশন, গার্ডার, টপকর্ড ও বটমকর্ড অংশের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এগুলোর বেশিরভাগ কাজই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে হচ্ছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের (মূল সেতু) নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের জানান, এ পর্যন্ত দুটি স্প্যান চীন থেকে এসেছে। যেগুলো মাওয়া অংশে ওয়ার্কশপে জয়েন্ট দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে একটির কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। অন্যটির কাজও পুরোদমে চলছে। সেতুর নক্সা পরিকল্পনা অনুযায়ী, উপরের অংশের সোনালি রঙের দু’টি স্প্যানের মধ্যে ৩৪টি জয়েন্ট হবে। ওয়ার্কশপে এখন পর্যন্ত ৪টি জয়েন্টের কাজ শেষ হয়েছে। একেকটি জয়েন্টের ওজন ৪৮ থেকে ৬০ টন। পদ্মা সেতুর প্রতিটি পিলারে ছয়টি করে মোট ২৪০টি পাইল থাকবে। আর দুই প্রান্তে আরও ১২টি করে ২৪টি পাইল থাকবে। যে দু’টি স্প্যানের কাজ চলছে সেগুলো মাওয়া অংশের ৬ ও ৭ নম্বর পিলারের মাঝামাঝিতে আর আরেকটি স্প্যান ৩৭ ও ৩৮ এর মাঝামাঝি বসবে। পদ্মা নদীর মধ্যে কয়েকটি পিলার দৃশ্যমান হয়েছে। আরও কয়েকটি পিলারের কাজ চলছে। নদীর দুই পাশে সংযোগ সড়কের কাজও প্রায় শেষের দিকে। তবে সংযোগ সেতুর কিছু কাজ উদ্বোধনের ঠিক আগে শেষ করা হবে, যাতে ফিনিশিং সুন্দর হয়। পদ্মা সেতুর কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ এখন পর্যন্ত সাড়ে ৩১ শতাংশ এগিয়েছে। জাজিরা অংশে সংযোগ সড়কের কাজ এগিয়েছে সাড়ে ৭৭ শতাংশ, মাওয়া অংশে সংযোগ সড়কের মাত্র ১ শতাংশ বাকি আছে- শেষ হয়েছে ৯৯ শতাংশ কাজ। আর সার্ভিস এরিয়ার কাজ ৯৯ শতাংশ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। তবে পদ্মা সেতুর ৫টি অংশের মধ্যে কেবল পিছিয়ে রয়েছে জাজিরা অংশের সংযোগ সড়কের নির্মাণ কাজ। তবে বাকি অংশ খুব দ্রুতই শেষ হবে বলে আশা করছেন সংযোগ সড়কের প্রকৌশলীরা। এদিকে পদ্মা সেতুর দোগাছি সার্ভিস এরিয়ায় প্রতিষ্ঠিত প্রাণী জাদুঘরটিও সমৃদ্ধ হচ্ছে। ১১৪ প্রজাতির প্রাণী এখন পর্যন্ত স্থান পেয়েছে। ঘরের ভেতরে কয়েকটি পার্টিশন করে প্রাণীগুলোকে এমনভাবে রাখা হচ্ছে, যেন মনে হয়, একেবারে জ্যান্ত। বিষধর পদ্ম গোখরা থেকে শুরু করে কুনো ব্যাঙ পর্যন্ত আছে এই জাদুঘরে। দিনে দিনে বাড়ছে জাদুঘরের সংগ্রহ। টার্গেট ৫ হাজার প্রাণীবৈচিত্র্য রাখা। জাদুঘরে প্রবেশ করে বা দিকে তাকালে ১০ থেকে ১২টি সাপের ভয়ঙ্কর আক্রমণাত্মক দৃশ্যের চোখে পড়বে। সাপগুলো কাচের বোতলের ভেতরে বন্দী। আর ভয়ঙ্কর বিষধর পদ্ম গোখরা সাপ তার শরীরের খোলস হারিয়ে শুধু সাদা হাড় নিয়ে কাচের বাক্সে বন্দী হয়ে আছে। প্রথম পর্যায়ে জাদুঘরটির সংগ্রহ বাড়ানো এবং তার সংরক্ষণ নিয়েই বেশি মনোযোগী কিউরেটরসহ মাঠকর্মীরা। আগামী ৫ বছর ধরে জাদুঘর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এখন মাত্র ৬ থেকে ৭ মাস পার হয়েছে। এরই মধ্যে জাদুঘরে এসেছে প্রায় ৫শ’ প্রাণীবৈচিত্র্য। তবে এখনই এটি উন্মুক্ত নয় সাধারণের জন্য। এটি দেখতে হলে আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা এবং তার আশপাশের নানা জীববৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখতে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে এগুলোর সঙ্গে পরিচিত করাতে জাদুঘরের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যমুনা সেতু গড়ে তোলার পর সেখানেও এরকম একটি জাদুঘর করা হয়েছিল। তবে পদ্মা সেতুর জাদুঘর আরও বড় এবং পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে। যেন ভবিষ্যতে দেশের যে কেউ এবং বিদেশীরা এগুলো দেখতে পারেন। জাদুঘরের কিউরেটর ড. আনন্দ কুমার দাস জানান, পদ্মা সেতু ও এ এলাকার প্রাণী জগত সংরক্ষণের তাগিদ থেকে তাদের সংগ্রহের একটি লক্ষ্য দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন বন্যপ্রাণী এবং সাপ, ব্যাঙ টিকটিকি, কচ্ছপ, হরিণ, ইঁদুর, পোকামাকড়, প্রজাপ্রতির পাশাপাশি এ এলাকার ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরার যন্ত্র ও বিভিন্ন ধরনের নৌকাও জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। প্রাণী জাদুঘরটিতে এখন জনবল ২৬ জন। এর মধ্যে ১৩ জন মাঠকর্মী। কনসালট্যান্ট যাঁরা আছেন সকলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক। এছাড়াও রয়েছেন রিসার্চ এ্যাসোসিয়েট, টেকনোলজিস্ট ও সাপোর্টিং স্টাফ। পদ্মা সেতু আশপাশে যেখানই কোন প্রাণী মারা গেছে, সেখান থেকে আমরা গিয়ে এটা নিয়ে আসা হয়। এদিকে পদ্মা সেতুর ঘিরে আশপাশের চিত্র যেন মন পাল্টে যাচ্ছে। চিত্র পাল্টাচ্ছে এই অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থারও। সেতু চালু হওয়ার আগেই এই অঞ্চলের এই পরিবর্তন আর পরে যে কি হতে তাই নিয়ে ভাবছেন অধিবাসীরা। পদ্মার এই কর্মযজ্ঞের প্রায় চার কিলোমিটাার দূরের বাসিন্দা মিজানুর রহমান ঝিলু। তিনি দীর্ঘদিন জাপান ছিলেন। কোরিয়াও কাজ করেছেন। বিশ্বের অনেক শহর সম্পর্কে তাঁর বেশ ধারণা রয়েছে। তিনি মনে করেন এই সেতু ঘিরে যে পরিবেশ এখানে তৈরি হচ্ছে সেটি বিশ্বের অন্যতম পর্যটন এলাকা হবে সহজেই। তবে প্রয়োজন পরিকল্পনা। সভ্যতার জনপদ হিসেবে পরিচিত মুন্সীগঞ্জ তথা বিক্রমপুরের প্রাচীন স্থাপত্য আর ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুন এই পদ্মা সেতু স্থাপনা এখানে বিশেষ গুরুত্ব বহন করবে। স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি বলেন, পদ্মা তীরের জীববৈচিত্র্য এবং বিশাল চর ও আশপাশ নিয়ে অনেক পরিকল্পনাই রয়েছে। সবই হবে পরিকল্পিত। যা বাঙালী জাতির অনেক স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। এদিকে পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে নিতে সেতু ও পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এখন যেন মাওয়ার বাসিন্দা। তিনি প্রায়শই এই নির্মাণযজ্ঞ পরিদর্শনে আসছেন অবস্থানও করছেন এখানে। এতে সেতুর কাজের গতি বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
×