ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জনগণের দোরগোড়ায় দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে প্রশাসনের সেবা

ডিজিটাল জেলা কুষ্টিয়ায় ফেসবুক আন্দোলন- ব্যাপক সাড়া

প্রকাশিত: ০৬:১১, ২২ অক্টোবর ২০১৬

ডিজিটাল জেলা কুষ্টিয়ায় ফেসবুক আন্দোলন- ব্যাপক সাড়া

জাহিদুল আলম জয়, কুষ্টিয়া থেকে ফিরে ॥ আধুনিক সময়ে ফেসবুকের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। ফেসবুক এখন শুধু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমই নয়, সামাজিক উন্নয়নের বাহন হিসেবেও কাজ করছে। ফেসবুকের জনপ্রিয়তা ও প্রচার কাজে লাগিয়ে কুষ্টিয়ায় শুরু হয়েছে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন ‘ফেসবুক পেজ’ ও ‘ফেসবুক লাইভে’র মাধ্যমে সাধারণ জনগণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হচ্ছে। এর মূল লক্ষ্যই হচ্ছে- জনগণের যেকোন সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসা। জেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগ ব্যাপক সাড়া ফেলেছে কুষ্টিয়ায়। জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনও ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি, সমস্যা, সম্ভাবনা, দুর্নীতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী তুলে ধরছে। এর মধ্যে অন্যতম কুমারখালীর ইতিহাস-ঐতিহ্য-সাহিত্য-সংষ্কৃতি পরিষদ। এই পরিষদের কর্মীরা ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে জনগণকে সরাসরি সম্পৃক্ত করছেন বিভিন্ন বিষয়ে। এ ধরনের কার্যক্রম গোটা দেশে এই প্রথম বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। কুষ্টিয়ার জনগণের সম্পৃক্ততায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় কুষ্টিয়া ফেসবুক পেজের প্রথম লাইভ ইভেন্ট করে গত ১২ অক্টোবর। এতে উপস্থিত ছিলেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আবদুস সামাদ, কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক জহির রায়হান ও কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার প্রলয় চিসিম। প্রায় ১০ মিনিটের লাইভ ইভেন্টে কুষ্টিয়ার বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়। এই কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে সহজেই জনগণকে সেবার আওতায় আনা যাবে বলে বিশ্বাস জেলা প্রশাসনের। ইতোমধ্যে এর সুফলও পেতে শুরু করেছে মানুষ। কুমারখালীর দৃষ্টি প্রতিবন্ধী রাজিব হোসেন এই উদ্যোগের মাধ্যমেই জেলা প্রশাসনের নজরে আসে। এরপর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তার চিকিৎসা করা হয় ভারতে। শুধু তাই নয়, ফেসবুক আন্দোলনের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট সংস্কার, বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরা, অবৈধ দখলদারদের দৌরাত্ম্য সম্পর্কে সহজেই প্রশাসনকে জানাতে পারছে সাধারণ মানুষ। জেলা প্রশাসনও বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছে। ফেসবুকের মাধ্যমে জনমুখী এই কাজে সাধারণ মানুষও খুব খুশি। তাদের দাবি, এই উদ্যোগ যেন থেমে না যায়। ফেসবুক শুধু গণযোগাযাগ মাধ্যমই নয় মানুষের আনন্দ, বিনোদনের পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-বাণিজ্য, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আলাপচারিতায় উঠে আসে নানামাত্রিক সমস্যা-সম্ভাবনা ও সংকট উত্তরণের নানা উপায়। সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ফেসবুক লাইভ শুরু হয়েছে গত ১০ অক্টোবর থেকে। ইতিহাস-ঐতিহ্য-সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদ মুক্তিযুদ্ধ, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যসহ সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরছে। ১৬, ১৭ ও ১৮ অক্টোবর ছেউরিয়ায় লালন শাহের ১২৬তম তিরোধান দিবস উদযাপন হয়েছে। তিন দিনের সেই অনুষ্ঠান ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন কর্মীরা। এতে সশরীরে লালনের মাজার প্রাঙ্গণে না থেকেও দেশ-বিদেশের অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী লালনের মানব ধর্মের স্পর্শ পেয়েছেন। ফেসবুক লাইভে দেশ ও দেশের বাইরের অনেক মানুষ সরাসরি অংশ নিচ্ছে এবং সুচিন্তিত মতামত রাখছে। কল্যাণমুখী এই টিমে কাজ করছেন কলামিস্ট ও নাট্যকার লিটন আব্বাস, রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী রেফুল করিম, সাংবাদিক দীপু মালিক, সাংবাদিক কাজী সাইফুল, হুমায়ুন কবিরসহ অনেক। গত ১২ অক্টোবর কুমারখালীতে প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনকারী স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক রেজাউল করিম হান্নানের ওপর দীর্ঘ লাইভ আড্ডা হয়। তিনি ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ কুমারখালীর গণমোড়ে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭১ সালের ২ মার্চ প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলিত হয়। ফেসবুক লাইভের একান্ত আলাপে রেজাউল করিম হান্নান বলেন, স্বাধীনতার আগে ও পরে আমরা সংগ্রাম, আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ করেছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে। স্বাধীনতার পর দেশে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা দেখে হতাশা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, দেশকে দুনীর্তিমুক্ত করতে এসব ভুয়া ও দুর্নীতবাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসহ নানা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও কলঙ্কিত হবে। নাট্যকার লিটন আব্বাস বলেন, রাষ্ট্রের একজন সচেতন ও সুস্থ নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক নাগরিকের রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে। স্বেচ্ছায় দেশের ও মানুষের জন্য নিজেকে নিবেদন করতে হবে। সেই সঙ্গে জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালন করে নতুন প্রজন্মের সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। আমাদের উদ্দেশ্য ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে দেশের সকল মুক্তিযোদ্ধার ইতিহাস, স্মৃতিচারণ ধারণ করে আর্কাইভে জমা রাখা। সাংবাদিক দীপু মালিক বলেন, ফেসবুক লাইভ রিপোর্টিং আস্তে আস্তে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে এলাকার সমস্যা, সম্ভাবনা, উন্নয়নের বিষয়ও উঠে আসবে। দেশ এগিয়ে যাবে, আমরা সত্যিকার উন্নত বিশ্বের কাতারে চলে আসব। এই উদ্যোগকে যুগাান্তকারী উল্লেখ করে একজন বলেন, এজন্য আমি প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তাঁর কারণেই বাংলাদেশে দ্রুতগতির ইন্টারনেট চালু হয়েছে। যে কারণে আজ ফেসবুক লাইভ করা সম্ভব হচ্ছে। এর ফলে সমাজের দুর্নীতি, সুবিধা-অসুবিধা কথা দেশ-বিদেশের মানুষ এবং প্রশাসনের কাছে খুব সহজে পৌঁছে যাচ্ছে। তরুণ লেখক রফিকুল ইসলাম বলেন, ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে শহরের রেললাইনের পাশে অবৈধ উচ্ছেদ অভিযান। আমরা অনলাইন পত্রিকা পড়ি, টেলিভিশন দেখি, তবে ফেসবুকের মাধ্যমে নিয়মিত বিভিন্ন বিষয় প্রচার সম্ভবত এটাই প্রথম। ফেসবুক লাইভের মূল লক্ষ্যই হলো জনগণের কল্যাণ সাধন। তাদের বিভিন্ন সমস্যার দ্রুত সমাধান। এ প্রসঙ্গে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক জহির রায়হান বলেন, কুষ্টিয়া একটা ডিজিটাল জেলা। এই জেলা অনলাইনে অগ্রগামী। এ কারণে আমরা ফেসবুক লাইভ শুরু করেছি। আমাদের ফেসবুক পেজও আছে। তবে এই সময়ে লাইভটাই বেশি কার্যকর। তিনি বলেন, জনগণের অনেক সমস্যা আছে। লাইভ করলে তারা সরাসরি তাদের সমস্যার কথা জানাতে পারছে। এতে দ্রুত কোন সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। আশা করছি এর ফলে জনগণ উপকৃত হবে, তাদের সময় নষ্ট হবে না। জনগণের সার্বিক উন্নয়নের জন্যই কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন ফেসবুক লাইভ শুরু করেছে। কুমারখালীর ইতিহাস-ঐতিহ্য-সাহিত্য পরিষদও ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে জনগণের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরছেন। তারাই প্রথম এই অঞ্চলে ব্যাপকভাবে শুরু করেছে এই কার্যক্রম। এর মধ্য দিয়ে জনগণের অনেক সমস্যার দ্রুত সমাধান হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিষদের সদস্যরা। তাদের এই কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক জহির রায়হান। তিনি বলেন, সিটিজেন জার্নালিজম এক্ষেত্রে পজিটিভ ভূমিকা রাখছে। তারাও বিভিন্ন আইডিয়া দিচ্ছে। সবাই একসঙ্গে কাজ করলে সাফল্য পাওয়া সহজ। আশা করছি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই উদ্যোগ জনগণের সার্বিক কল্যাণ বয়ে আনবে। ফেসবুক লাইভের মূল লক্ষ্যই হলো জনগণকে সরাসরি সম্পৃক্ত করা। তাদের অভিযোগ, সমস্যা, কষ্টের কথা শোনা। কুষ্টিয়ার নতুন জেলা প্রশাসক এ বিষয়ে আন্তরিক। তিনি জানান, আমাদের অনেক পরিকল্পনা আছে। এটা ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের একটা পথ। সরকার কাজ করে চলেছে, সেই পথে আমরাও চেষ্টা করছি। আশা করি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে আমাদের এই কার্যক্রম কাজে দেবে। এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র কুষ্টিয়া জেলাতেই ব্যতিক্রমী এই কার্যক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হয়ত শীঘ্রই অন্য জেলাতেও শুরু হবে এই কার্যক্রম। খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আবদুস সামাদও ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগে খুশি। তিনি বলেন, এ বছর ফেসবুক লাইভ শুরু হয়েছে। প্রথমেই জনগণের ভাল সাড়া মিলেছে। আগামীতে যেন সম্পৃক্ততা আরও বাড়ে এজন্য কাজ করব আমরা। কুষ্টিয়ার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে খুলনা বিভাগীয় কমিশনার বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই জেলার রয়েছে অসামান্য অবদান। আমরা কুষ্টিয়াকে পর্যটন নগরী হিসেবে দেখতে চাই।
×