ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাত মাসে রাবিতে ৫ লাশ

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ২২ অক্টোবর ২০১৬

সাত মাসে রাবিতে ৫ লাশ

রাবি সংবাদদাতা ॥ দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) গত কয়েক মাসে মিলেছে লাশ আর লাশ। একের পর এক অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলেছে মতিহারের সবুজ চত্বরে। গত সাত মাসে মতিহারের সবুজ চত্বর দেখেছে পাঁচ লাশ। জঙ্গীদের টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়ে খুন হয়েছেন নিরীহ অধ্যাপক, শয়নকক্ষে মিলেছে রাবি শিক্ষিকার লাশ, গাছ থেকে পড়ে মৃত্যু হয়েছে ছাত্রের ও ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয়েছে ছাত্রীর। এসব মৃত্যুর রক্তের দাগ না শুকাতেই বৃহস্পতিবার খুন হলেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মোতালেব হোসেন লিপু। জানা যায়, গত ২৩ এপ্রিল সকালে রাজশাহী নগরীর শালবাগান এলাকায় বাসা থেকে মাত্র ১৫০ গজ দূরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গীরা। এই হত্যাকা-ে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থী। এ ঘটনার ছয় মাস পেরোলেও এ হত্যা মামলায় এখনও চার্জশীট দিতে পারেনি পুলিশ। গাছ থেকে পড়ে আহত হয়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ৫ মে মৃত্যু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের মাস্টর্সের শিক্ষার্থী জারজিস হোসেনের। গত ২৮ আগস্ট বিকেলে মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে ট্রেনের ধাক্কায় মৃত্যু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সান্তনা বসাকের। এরপর গত ৯ সেপ্টেম্বর জুবেরী ভবনের একটি কক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষিকা আক্তার জাহান জলির লাশ উদ্ধার করা হয়। ময়নাতদন্তে জানা যায় বিষপানে মৃত্যু হয়েছে জলির। ওই রাতে আক্তার জাহানের কক্ষে পাওয়া এক চিঠি থেকে জানা যায়, শারীরিক ও মানসিক চাপে আত্মহত্যা করেন তিনি। এ ঘটনায় প্ররোচনার অভিযোগ ওঠে আকতার জাহানের সাবেক স্বামী এবং একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানভীর আহমদ। ঘটনার পরদিন আকতার জাহানের ভাই বাদী হয়ে নগরীর মতিহার থানায় আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। তবে ঘটনার দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও তদন্তের উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি হয়নি। এদিকে আকতার জাহান জলির রক্তের দাগ না শুকাতেই বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাব আব্দুল লতিফ হলের পেছনের নর্দমা থেকে উদ্ধার করা হলো একই বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মোতালেব হোসেন লিপুর রক্তাক্ত-বিবস্ত্র লাশ। লিপুর বন্ধুদের সন্দেহ, জালিয়াত চক্রের খপ্পরে পড়ে একটি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রক্সি দেয়ার একটি চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে লিপু । প্রক্সির টাকা নিয়ে ওই চক্রের সদস্যদের সঙ্গে দরকষাকষি চলছিল লিপুর। টাকা পয়সার লেনদেন কিংবা চক্রের সদস্যদের পরিচয় ফাঁস হওয়ার আশঙ্কায় ঘটতে পারে এ হত্যাকা-। সম্প্রতি এক নিয়োগ পরীক্ষায় বডি পরিবর্তন করে পরীক্ষা দিতে গিয়ে আটক হয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের (রাবি) নিহত শিক্ষার্থী মোতালেব হোসেন লিপু। পরে এই ঘটনায় সাজাও পেয়েছিলেন তিনি। তবে এই ঘটনার পর থেকে ওই পরীক্ষা জালিয়াতি চক্রের কে বা কারা তাকে নিয়মিত হুমকি দিয়ে যাচ্ছিলেন বলে জানান নিহত লিপুর সেজো চাচা মোঃ বশির। মোঃ বশির বলেন, ‘লিপুর সব ঘটনা তো আর জানতাম না। তবে কিছু দিন আগে সে (লিপু) আমাকে বলেছিল, লিপু যে নিয়োগ পরীক্ষার জালিয়াতি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল, ওই চক্রের কে বা কারা তাকে নিয়মিত ফোন করত। তাকে ফোনে বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধমকি দিত। এই বিষয়টা নিয়ে লিপু খুব টেনশন করত। সে আমাকে এরকম একটা ঘটনা বলেছিল।’ তবে এর বেশি কিছু আর বলতে পারেননি লিপুর চাচা। এই ঘটনায় জেরে মোতালেব হোসেন লিপু ‘হত্যা’র শিকার হতে পারে বলেও ধারণা করছেন লিপুর চাচা ও বন্ধু-বান্ধবরা। লিপুর প্রায় তিন বছরের ক্যাম্পাস জীবনে আর কার সঙ্গে কখনও দ্বন্দ্ব ছিল বলে জানেন না কেউই। এমনকি গ্রামবাসীর চোখে লিপু হলো নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা ‘সোনার টুকরো’ ছেলে। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে লিপুর গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের হরিণাকু-ু থানার মকিমপুর গ্রামে তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। লিপুর গ্রামের বন্ধু ও বাড়ির আশপাশের আত্মীয়স্বজন লিপুর কার সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল বলে ধারণা করতে পারছেন না। গ্রামবাসী জানায়, ‘লিপুর বাবা তাকে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করতে পাঠিয়েছিলেন। এমনকি লিপু নিজেও সেটা বুঝত। লিপু গ্রামে কারো সঙ্গে কখনও বাগ্বিত-ায় জড়ায়নি।’ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে নবাব আব্দুল লতিফ হল থেকে লিপুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন মহানগর পুলিশের কমিশনার শফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত কমিশনার সরদার তমিজউদ্দিন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, হল প্রাধ্যক্ষ, ছাত্র উপদেষ্টা, জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রমুখ। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য লিপুর রুমমেট মনিরুল ইসলাম, বন্ধু প্রদীপসহ হলের অন্য দুই কর্মচারীকে আটক করেছে পুলিশ। এছাড়া ঘটনাস্থল ও লিপুর কক্ষ থেকে কিছু আলামত সংগ্রহ করে পুলিশ। পরে নগরীর মতিহার থানায় অজ্ঞাতনামাদের নামে মামলা করেছেন চাচা মোঃ বশির। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে তিনি এ মামলা দায়ের করেন। লিপুকে মাথায় আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে বলে লাশের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট থেকে জানা যায়। কারা এই হত্যার সঙ্গে জড়িত সেই রহস্যও খুব তাড়াতাড়ি জানা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। রাবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর এরকম অপমৃত্যু বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা ড. মিজানুর রহমান বলেন, একের পর এক এভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অপমৃত্যু মেনে নেয়া আমাদের সকলের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হুমায়ুন কবির বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নিহত লিপুর চাচা বশির মোল্লা বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের আসামি করে থানায় হত্যা মামলাটি দায়ের করেন।
×