ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আশুলিয়ায় অভিযানের সময় নিহত আবদুর রহমান ছিল আমির, তার প্রকৃত নাম সারোয়ার জাহান

ভেঙ্গে পড়েছে নব্য জেএমবি নেটওয়ার্ক

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ২২ অক্টোবর ২০১৬

ভেঙ্গে পড়েছে নব্য জেএমবি নেটওয়ার্ক

আজাদ সুলায়মান ॥ একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে নব্য জেএমবির ভয়ঙ্কর নেটওয়ার্ক সম্পর্কে। অবিশ্বাস্য সব ধরনের অপরাধে জড়িত থাকার মতো তথ্য ফাঁস হচ্ছে। প্রায় ৩০০ সদস্য দিয়ে গঠিত হয় নব্য জেএমবি। তবে এর মধ্যে এখন মাঠে সক্রিয় রয়েছে মাত্র একুশ জন। নব্য জেএমবির সদস্যরা আরবী সাংকেতিক নাম ও বিশেষণ আবিষ্কার করে নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান প্রদান করত। যেমন পুলিশ ও র‌্যাবকে বলা হতো ‘তাগুত’, গ্রেনেডকে বলা হতো ‘আম’ ও পুলিশের হামলাকে বলা হতো ফিতনা। দাওয়াত, ইলেম ও তাসকীয়া, ইয়ানত, ইদাদ গ্রুপ, রিবাহ্ কিসাক ও ফিতনা নিরোধন ভিত্তিতে কার্যক্রমের নামেই চালানো হতো বিভিন্ন অপারেশন। এই সংগঠনের নেতা অর্থযোগানদাতা হিসেবে পরিচিত, আব্দুর রহমান গত ৮ অক্টোরব আশুলিয়ার একটি পাঁচতলা ভবন থেকে পালানোর সময় আহত হয়ে মারা যায়। এখন তার সম্পর্কে র‌্যাব খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে- তার নাম সারোয়ার জাহান। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) কথিত নেতা। এই আব্দুর রহমান ওরফে সারোয়ার জাহানই ইসলামিক স্টেটের (আইএস) কথিত বাংলাদেশ প্রধান শাইখ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফ। আইএসের মুখপাত্র ‘দাবিক’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে আবু ইব্রাহিমকে আইএসের বাংলাদেশ প্রধান বলে উল্লেখ করে। বাংলাদেশে নব্য জেএমবির হামলায় দেশী বিদেশী নাগরিক নিহত হবার পর এই শায়খ আবু ই্ব্রাহিম আল হানিফই তা তাৎক্ষণিক বিদেশে প্রচার করত। তারাই এ সব হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করত আইএস পরিচয়ে। র‌্যাব সূত্র জানায়, নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনটির সদস্যদের কেউ র‌্যাব-পুলিশের হাতে নিহত হয়েছেন, কেউ কারাগারে আছেন বা কেউ কেউ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। সংগঠনটিতে বর্তমানে আর মাত্র ২১ জন সদস্য সক্রিয়। এদের মধ্যে ২ জন সুরা সদস্য, ১৯ জন মিড লেভেলের। র‌্যাবের অভিযানে একে-২২ এবং হ্যান্ডগানগুলো উদ্ধার হওয়ার পর তাদের কাছে বর্তমানে কোন অস্ত্র নেই। সাংগঠনিকভাবে সংগঠনটি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবে এই রহমান গত ১৩ বছর ধরে সে জঙ্গি কর্মকা- চালিয়ে আসছে। ঘটনার পর আব্দুর রহমানের বাসা থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা, অস্ত্র-গোলাবারুদসহ সাংগঠনিক অনেক নথি উদ্ধার করা হয়। পরে তার পাসপোর্টের সূত্র ধরে প্রতীয়মান হয় যে আব্দুর রহমানের এ পরিচয় ভুয়া। এই আব্দুর রহমানের প্রকৃত নাম সারোয়ার জাহান। তার গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটের থুমরিভোজা এলাকায়। আশুলিয়ার বাসা থেকে উদ্ধার করা নথিপত্র বিচার-বিশ্লেষণ করে আব্দুর রহমানই আইএসের কথিত বাংলাদেশ প্রধান আবু ইব্রাহিম আল হানিফ বলে নিশ্চিত হয়েছে র‌্যাব। ২০০৩ সালে এই আব্দুর রহমান জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে পুলিশের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষ করেছিল। ওই সময় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং সে ৯ মাস ৪ দিন কারাভোগ করে জামিনে মুক্তি পায়। এরপর দেড় মাস বাড়িতে থেকে ফের আত্মগোপনে চলে যায়। তার মানে প্রায় ১৩ বছর ধরে জঙ্গী কর্মকাণ্ড চালায়। সর্বশেষ সে নব্য জেএমবি গঠন করে এবং আবু ইব্রাহিম আল হানিফ নামে এ সংগঠনের আমির হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ বিষয়ে কিছু নথিপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। নিজেকে আমির হিসেবে ঘোষণার একটি কাগজে আবু ইব্রাহিম অর্থাৎ আব্দুর রহমান ও তামিম চৌধুরী স্বাক্ষর করে। শেখ আবু নামটি তামিম চৌধুরীর সাংগঠনিক নাম। চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল আইএসের কথিত মুখপত্র দাবিক-এর ১৪তম সংখ্যায় আবু ইব্রাহিম আল-হানিফের একটি দীর্ঘ সাক্ষাতকার প্রকশিত হয়। সেখানে তাকে বাংলাদেশে আইএসের কথিত প্রধান বলে দাবি করা হয়। এই আবু ইব্রাহিম ওরফে সারোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমান ১৯৯৮ সালের পর থেকেই জেএমবির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। সে ইংরেজী, আরবি ও উর্দু ভাষায় কথা বলতে পারদর্শী ছিল। জানা যায়-বাংলা ভাই ও শায়খ আব্দুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পর জেএমবি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। এরপর ২০১৪ সালে নতুন ধারার ধর্মীয় উগ্রবাদের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পুরনো জেএমবি নব্য জেএমবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। নব্য জেএমবি পরবর্তীতে সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পরিকল্পনা করে এবং একই সঙ্গে দাওয়াতি কার্যক্রম চালাতে থাকে। এক পর্যায়ে নব্য জেএমবির সাধারণ সদস্যরা আব্দুর রহমানকে শূরা সদস্য হিসেবে মনোনীত করে। পরে অন্য শূরা সদস্যরা তাকে নব্য জেএমবির আমির হিসেবে ঘোষণা করে এবং তার সাংগঠনিক নাম দেয় শায়খ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফ। গত ৮ অক্টোবর আশুলিয়ায় আব্দুর রহমানের আস্তানা থেকে একাধিক চিঠি, মেইল এবং খুদেবার্তা পায় র‌্যাব। কয়েকটি চিঠিতে আব্দুর রহমান নিজেকে শায়খ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ নাম ব্যবহার করে স্বাক্ষর করেছে। এছাড়া , তার কাছ থেকে নব্য জেএমবির আমির হিসেবে জঙ্গীবাদে ব্যবহৃত অর্থ লেনদেনের কিছু হিসাবও পাওয়া গেছে। এসব নথিপত্র পর্যালোচনা করেই র‌্যাব নিশ্চিত হয়েছে যে, আব্দুর রহমানই আবু ইব্রাহিম। আবু ইব্রাহিমের নির্দেশে নব্য জেএমবির সদস্যরা ‘ইনগিমাস বা গুপ্ত হামলা’ শুরু“ করে। গত বছরের ৩০ আগস্ট চট্টগ্রামে মিরেরসরাইয়ে আওয়ামী লীগ নেতা ইমরানকে গুলি করে ৬০ লাখ টাকা ছিনতাই করে নেয়। ৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের বাংলাবাজারে তারা নেংটা বাবা ও তার এক সহযোগীকে হত্যা করে। মূলত এ দুটি অপারেশন সফলভাবে পরিচালিত হওয়ায় আব্দুর রহমানকে নব্য জেএমবির শূরা সদস্যরা বাংলাদেশের নব্য জেএমবিতে বায়াত দেয়ার জন্য অনুমতি দেয়। তারপর থেকে শুরু হয় অভিযান। একের পর রাজধানী ও ঢাকার বাইরে অভিযান চালাতে থাকে। বিশেষ করে গুলশান, বনানী, বারিধারায় বসবাসরত বিদেশী নাগরিকদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করে। এছাড়া, মন্দির, হোসনি দালান, শিয়া মসজিদসহ তাদের ভাষায় তাগুতের সৈনিক র‌্যাব, পুলিশের ওপর হামলা ও ডাকাতির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এদিকে র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ শুক্রবার সকালে রাজধানীর কাওরানবাজারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানান-নব্য জেএমবিতে বর্তমানে ২১ জন সদস্যের সক্রিয় থাকলেও তারা আর কিছুতেই কোন ধরনের অপরাধ করার সুযোগ পাবে না। তিনি বলেন- ওই আস্তানা থেকে উদ্বারকৃত চিঠিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ‘তাগুত’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। চিঠিতে লেখা ছিল- ৬ অক্টোবর পর্যন্ত তাদের ৩৩ জন সদস্য ছিল। বাকিরা ‘তাগুত’দের হাতে শহীদ হয়েছে এবং কারাগারে রয়েছে। তাদের ৫টি হ্যান্ডগান, ১টি একে-২২ রাইফেল এবং কিছু সংখ্যক ‘আম’ রয়েছে। চিঠিতে আম বলতে গ্রেনেডকে বোঝানো হয়েছে। তবে গত ৮ অক্টোবর র‌্যাব এবং কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটি) ইউনিটের অভিযানে গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও আশুলিয়ায় মোট ১২ জন নিহত হয়েছে। সেখান থেকে ১টি একে-২২ রাইফেল এবং ৫টি হ্যান্ডগান উদ্ধার করা হয়। তিনি বলেন, ২১ জনের সাংগঠনিক নাম পাওয়া গেছে। আমরা সেগুলো যাচাইবাছাই করে তাদের ধরার চেষ্টা করছি। বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর মতিঝিলে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে নব্য জেএমবির নিহত অর্থদাতা আব্দুর রহমানের দুজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে ২৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। আটককৃতরা হলো, আবদুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী নাফিস আহম্মেদ নয়ন ও হাসিবুল হাসান।
×