ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অভাবের সংসারে জীবন শঙ্কায় অবুঝ শিশু

প্রকাশিত: ২৩:২৭, ২১ অক্টোবর ২০১৬

অভাবের সংসারে জীবন শঙ্কায় অবুঝ শিশু

মেজবাহউদ্দিন মাননু, নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া ॥ পাঁজরের হাড়গুলো গননা করতে কোন সমস্যা হয়না। মাথাসহ শরীরের শীরাগুলো গাছের শেকড়ের মতো জেগে আছে। চামড়াগুলো বয়োবৃদ্ধ মানুষের মতো কুচকে গেছে। কান্না যেন থামছেই না। ছোট্ট শরীরটার হাড্ডিসার অবস্থা। নয় মাস বয়সী শিশু আব্দুর রহমানের ভবিষ্যত পরিণতি যে কী হবে তা কেউ বলতে পারছেন না। কিশোরী মা কারিমা নিজেই নিজের ভালমন্দ বুঝতে পারে না। সেই অনুভূতি পরিলক্ষিত হয়নি তার কথাবার্তায়। শুধু জানালো, বুকের দুধ পায়না তার একমাত্র সন্তান রহমান। বাইরে থেকে কিনবে তাও সঙ্গতি নেই। দেড় মাস হয়েছে স্বামী রুহুল আমিন কোন খোজখবর নেয়না। খাওন দেয়না। তিন মাস ধরে শিশু রহমানের এ অবস্থা চলছে। কারিমার দাবি, জন্মের পর থেকে ভালই ছিল। তার ধারনা জ্বর, টাইফয়েড কিংবা নিউমোনিয়া হয়েছে। নাকি চরম অপুষ্টির শিকার তাও স্পষ্টভাবে জানাতে পারেনি কিশোরী মা কারিমা। শুক্রবার দুপুরে গিয়ে চরচাপলী গ্রামে এ শিশু ও তার কিশোরী মায়ের চরম বিপদাপন্ন অবস্থা দেখা গেছে। ৫ম শ্রেণিতে পড়ার এক বছর পরেই বিয়ে দেয় বাবা মফেজ হাওলাদার। তাও আবার স্থানীয় বিয়ের রেজিস্টার (কাজী) আনম আনোয়ার হোসেন কাগজে-কলমে কারিমার বয়স ১৮ করে রেখেছেন। ২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর বিয়েটি ওই কাজী রেজিস্ট্রি করেন। সাত সন্তানের মধ্যে কারিমা তৃতীয়। চরচাপলী গ্রামে বাড়ি মফেজ হাওলাদারের। কামলা মানুষ। স্ত্রী মাহিনুর মাটি কাটার কাজ করে। এখন বেকার। ওই বয়সেই বিয়ে দেয়া হয় ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নের বরকতিয়া গ্রামের মন্নান জোমাদ্দারের ছেলে হারুন জোমাদ্দারের সঙ্গে। বিয়ের এক বছর তিন মাসের মধ্যেই জন্ম নেয় রহমান। শিশু বয়স না যেতেই কারিমা মা হয়ে যায়। দুর্ভাগ্য যেন তখন থেকেই তার পেছনে তাড়া করছিল। পাষন্ড স্বামী মারধর করত। বাবার দেয়া দুইটি গরু বিক্রি করে দিয়েছে। খাবার দিত না। অপরিনত বয়সে গর্ভধারন করলেও খাবার জুটত না পরিনত। মাঝে-মধ্যে শুধু আলু কিনে দিত হারুন। কারিমার ভাগ্যে স্বাস্থ্য বিভাগের মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কিমের কোন সুবিধা জোটেনি। জোটেনি মাতৃত্বকালীন ভাতা। জোটেনি সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর ছায়াতলে একটি ঠাঁই । সবশেষ ১০ টাকা কেজি দরের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির তালিকায়ও জোটেনি কার্ড। কিশোরী মেয়ে তার সন্তান নিয়ে এমন চরম দুরাবস্থায় পড়ায় বাবা-মা নিজের জোড়াতালি দেয়ার সংসারে নিয়ে আসেন। প্রায় এক মাস সেখানে। স্থানীয় চাপলী বাজারে একজন চিকিৎসককে দেখিয়েছেন। কিছু ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন। স্থানীয় যুবক মশিউর রহমান কিছু ওষুধ কিনে দিয়েছেন। কিন্তু মায়ের বুকের দুধ পায়না কঙ্কালসার শিশু রহমান। সবার জন্য ভাত জুটলে তা পিষে খাওয়ানোর চেষ্টা করেন কিশোরী মা কারিমা ও নানী মাহিনুর। কিন্তু রহমান তা খায় না। কিংবা খেতে পারে না। দুধ কোথায় পাবে। কীভাবে জোটাবে তা যেন ভাবতেও পারছে না অসহায় কিশোরী মা কারিমা। উল্টো চরম অভাবের বাবার সংসারে বাড়তি বোঝা হয়ে চেপে বসেছে মারাত্মক রোগাক্রান্ত শিশুকে নিয়ে। স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক ইয়াকুব মিয়া পর্যন্ত বলেছেন দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করানো প্রয়োজন শিশু রহমানকে। নইলে তার জীবন শঙ্কামুক্ত নয়। মৌলিক অধিকার খাদ্য, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত এ কিশোরী কারিমা ও তার নয় মাসের শিশু রহমানের জন্য যারা দায়ী সেই স্বাস্থ্য বিভাগের হেল্থ এসিস্ট্যান্ট, ফেমিলি ওয়েলফেয়ার এসিস্ট্যান্ট ও জনপ্রতিনিধিদের আইনের আওতায় আনার দাবি করেছেন সচেতন মানুষ। কেন না রাষ্ট্র কিংবা সরকার এসব অধিকার পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তারপরও কারিমার ভাগ্যে কেন জোটেনি এসব সেবা। কেনইবা তার শিশু সন্তান চরম অপুষ্টির শিকার। কারিমা জানান, কোন দিন তাদের বরকতিয়া গ্রামের বাড়ি কিংবা তার বাবার বাড়িতে তিনি কোন স্বাস্থ্যকর্মী দেখেননি। কেউ তাকে কোন ধরনের চিকিৎসা সহায়তা কিংবা পরামর্শ পর্যন্ত দেয়নি। এমনকি জন্মের পরে এ শিশুটি সব কয়টি টিকা দেয়ার সুযোগ পেয়েছে কী না তাও বলতে পারেনি কিশোরী কারিমা। এছাড়া অসংখ্য এনজিও শিশু এবং মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে তাদের ভূমিকাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ কারিমার কাছে। বর্তমানে একদিকে শিশু সন্তান মুমুর্ষ অবস্থায়। তার ওপর স্বামীর অত্যাচার-অবিচারের শিকার কারিমা যেন অনুভূতিহীন হয়ে গেছে। কোন কিছু বোঝার কিংবা সিদ্ধান্ত নেয়ার বয়স কিংব পরিণত অবস্থা এখনও তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। শুধু সব প্রশ্নের উত্তরে না বোঝা মুচকি হাসিতে জানা থাকলে উত্তর দেয়। নইলে চুপচাপ থাকা। তবে শিশু রহমানকে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা কিংবা পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা না করলে তাকে বাচানো নিয়ে শঙ্কা রয়েছে কারিমার মধ্যে। তার মন্তব্য টাকা পামু কই। হাসপাতালে ভর্তি করমু ক্যামনে। ধুলাসার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান কেন্দ্রের মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট খলিলুর রহমান জানান, ওই শিশু অপুষ্টির শিকার। তাকে যতদুর সম্ভব চিকিৎসা এখান থেকে দেয়া হয়েছে। তবে দ্রুত উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক ডাঃ আব্দুল মান্নানকে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য দুই দফা মোবাইল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি।
×