ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যৌন হেনস্থার অসুর দমনে ভরসা রুখে দাঁড়ানো দুর্গারাই

প্রকাশিত: ২২:০৭, ২১ অক্টোবর ২০১৬

যৌন হেনস্থার অসুর দমনে ভরসা রুখে দাঁড়ানো দুর্গারাই

অনলাইন ডেস্ক ॥ এমনটা তো হয়েই থাকে। নাটকে নয়, বাস্তবে। রোজ। দিনে-রাতে। ঘরে-বাইরে। কুপ্রস্তাব, অশ্লীল ইঙ্গিত, খারাপ স্পর্শ, নোংরা মন্তব্য— এ ধরনের অস্বস্তিকর হেনস্থার ভয়ে রোজের স্কুল-কলেজ-অফিসের পথটুকুও যেন নরক। তবে এই নরকেই রুখে দাঁড়াচ্ছেন অনেকে। এই প্রতিবাদটুকুই যে অনেক সময়ে অনেক বড় অপরাধকে গোড়ায় নির্মূল করে দেয়— এ বিষয়ে একমত পুলিশ-প্রশাসন থেকে সাধারণ মানুষ। যেমন অধ্যাপক শাশ্বতী ঘোষের বিশ্বাস, গলা উঁচু করলে সব ক্ষেত্রেই বিপদের আশঙ্কা খানিকটা কমে। ইদানীং এই প্রবণতা বেড়েছে মেয়েদের মধ্যে। তাঁর মতে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরে ঘুরে দাঁড়ানোটা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে। আলাদা করে আর চেষ্টা করতে হয় না। সমাজকর্মী হিসেবেও পরিচিত শাশ্বতী ঘোষ বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন মুখ বুজে থাকার পরে এখন মেনে না নেওয়াটা শিখেছেন তাঁরা। শিখেছেন প্রতিক্রিয়া জানাতে। আর এই প্রতিক্রিয়াই কোনও কোনও ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে প্রতিবাদ।’’ এ ভাবেই গলা তুলেছিলেন অর্পিতা বেরা। একটি হিন্দি সংবাদপত্রের আলোকচিত্রী হিসেবে শহরে কর্মরতা। শিয়ালদহ ওভার ব্রিজের নীচে একটি মোটরবাইক নিয়ে এসে তাঁকে কুপ্রস্তাব দিয়েছিল এক মাতাল। তিনি প্রতিবাদ করতেই পাল্টা গলা চড়ায় সে-ও। অশ্লীল মন্তব্য করে। তাকে সজোরে থাপ্পড় মেরে বাইকের চাবি খুলে নেন অর্পিতা। তখন অর্পিতার হাত মুচড়ে ধরে ফের নোংরা মন্তব্য করে সে। চলে যাননি অর্পিতা। কিছু ক্ষণ হাতাহাতির পরে অবশেষে স্থানীয় লোক জড়ো করে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। ঘটনাটি নাটকীয় হলেও খুব বিচ্ছিন্ন নয়। অন্তত এই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। তথ্য বলছে, অন্যায় ও হেনস্থা যেমন বাড়ছে, তেমনই চড়ছে প্রতিবাদের স্বরও। সমস্ত ঘটনাই যে পুলিশের দোরগোড়া পর্যন্ত গড়ায় বা আইনের পথে হাঁটে, তা হয়তো নয়। তবু প্রতিবাদ হচ্ছে, ছোট-বড় নানা মাপকাঠিতে। প্রতিবাদ করেছিলেন যাদবপুরের তরুণী সুপ্রিয়া সামন্তও। ভরা মেট্রোয় পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের হাতের চলাচল কিছুতেই যখন বাগ মানছিল না, ঘুরে দাঁড়িয়ে হাতটা সটান মুচড়ে ধরেছিলেন। যুবক চিৎকার করে উঠলেও ছাড়েননি। ‘‘ওর একটা আঙুল ভেঙে গিয়েছিল। সেটা হয়তো সেরে যাবে, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে এর পরে ভিড়ের মধ্যে নারী-শরীর ছোঁয়ার জন্য নিশপিশ করবে না ওই হাতটা,’’ বলেন সুপ্রিয়া। বর্ধমানের ফারহা কাজী নিজের পাড়াতেই বেরিয়েছিলেন, ভর দুপুরে। গা ঘেঁষে বেরিয়ে যাওয়া বাইকের গতি কমিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিত করে দুই যুবক। তাদের থামিয়ে জুতো খুলে ‘সবক’ শিখিয়েছিলেন। ২৭ বছরের ফারহা নিশ্চিত, ‘‘প্রতিবাদটা ওদের কাছে অপ্রত্যাশিত। এত দিন এমন হয়নি বলেই বেপরোয়া মনোভাবটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। তা ভাঙতে রুখে দাঁড়ানো জরুরি।’’ কিন্তু কোথা থেকে আসছে রুখে দাঁড়ানোর এই জোর? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী স্নেহ নন্দীর ব্যাখ্যা, ‘‘কিছু দিন আগে পর্যন্তও ‘জেন্ডার ভায়োলেন্স’ শব্দবন্ধটা সাধারণের আলোচনা ও তর্কের বিষয় ছিল না। কিন্তু এখন, গ্রাম-শহর-মফস্সল নির্বিশেষে সচেতন হয়েছে মানুষ।’’ কারণ হিসেবে দেশ জুড়ে ছাত্রসমাজের লাগাতার আন্দোলনের কথা বলছেন তিনি। নির্ভয়া-কাণ্ডে যে ভাবে পথে নেমেছিল সারা দেশ, তাতে এক ধাক্কায় প্রতিবাদের স্বরটা অনেক চড়ে যায়। নিত্যনৈমিত্তিক যৌন হেনস্থারও যে প্রতিবাদ হতে পারে, তা শিখতে শুরু করেছে মেয়েরা। তাঁর সহজ ব্যাখ্যা, মানুষ সচেতন হচ্ছে, তাই প্রতিবাদও করছে। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য প্রাক্তন তৃষা চন্দ স্পষ্ট জানালেন, মেয়েদের সাহস কোনও দিনই কম ছিল না। প্রতিবাদও হতো। তবে সে কথা বলার প্ল্যাটফর্ম ছিল না। সকলকে জানানোও সহজ ছিল না। এখন যা সহজ করে দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। তাঁর কথায়, ‘‘আজ যদি একটা মেয়ে যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা লিখে ফেসবুকে পোস্ট করেন, তবে তা শেয়ার হয়ে হয়ে যত মানুষের কাছে পৌঁছয়, সেই সংখ্যাটা ফেলে দেওয়ার নয়। ওই ঘটনার কথা জানার পরে আরও অনেকে প্রতিবাদের সাহস পাচ্ছেন বা পাবেন।’’ প্রতিবাদের অভ্যাস যে বাড়ছে, মানছে প্রশাসনও। কলকাতা পুলিশের ওসি র্যাঙ্কের এক মহিলা অফিসার জানালেন, অনেক মেয়েই এখন সরাসরি থানায় আসেন। অভিজ্ঞতার কথা জানান, সাহায্য চান। কয়েক বছর আগেও এই সংখ্যাটা বেশ কম ছিল। এখন খারাপ পরিস্থিতিতে পড়ে মেয়েদের রুখে দাঁড়ানোর ঘটনা আর তত বিরল নয়। কিছু দিন আগেই একটি বাসে পুরুষ সহযাত্রীর অস্বস্তিকর স্পর্শে অন্য একটি মেয়েকে সিঁটিয়ে যেতে দেখে গলা তুলেছিলেন পর্বতারোহী মহুয়া বিশ্বাস। কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ালেও ভয় পাননি তিনি। আশ্চর্যের বিষয়, এত ক্ষণ যে মেয়েটি সিঁটিয়ে থেকে ঘটনাটি সহ্য করছিলেন, তিনিও মহুয়ার সঙ্গেই প্রতিবাদ করেন। এগিয়ে আসেন সহযাত্রীরাও। মহুয়ার কথায়, ‘‘একটু গলার আওয়াজই অনেক সময়ে অনেক বড় প্রতিবাদ হয়ে ওঠে। কেবল সাহস করে শুরু করতে হয়।’’ বুধবারের রাতের শহরও তো দেখল এমনই একটা ঘটনা। প্রাণপণে ছুটে পালাচ্ছে এক যুবক। ছুটছে পিছনের মেয়েটিও। তেইশ বছর বয়স। রোগা চেহারা, ক্ষিপ্র গতি। কিন্তু দূরত্ব বেড়েই যাচ্ছে। এমন সময়ে, সাঁ করে অটো নিয়ে পাশে আসা চালকের আশ্বাস, ‘‘দিদি উঠে পড়ুন, দেখে নিচ্ছি।’’ এঁকে বেঁকে, উল্টো পথ ধরে অটো যখন যুবকের কাছাকাছি, তত ক্ষণে পথ চলতি একটি বাসে উঠে পড়েছে সে। তাতে কী! চলন্ত বাসের পাদানি থেকে টেনে নামিয়ে ওই যুবককে বেধড়ক পেটালেন তরুণী। এগিয়ে এলেন পথচারীরাও, এল পুলিশ। কিন্তু তখনও কেউ জানেন না, একটু আগে ওই অটোর ভিতরেই তরুণীকে যৌন হেনস্থা করেছেন অভিযুক্ত ওই যুবক। বুধবার সন্ধ্যায় বেলগাছিয়ায় অটোয় ঘটনাটি ঘটার পরে তরণী প্রতিবাদ করতেই চলন্ত অটো থেকে নেমে পালায় অভিযুক্ত। ঠিক তখনই, সেই মুহূর্তে তরুণীর সিদ্ধান্ত ছিল, ‘‘মেনে নেব না। ছেড়ে দেব না।’’ তাতেই নাটকীয় ভাবে ধরা পড়ল অভিযুক্ত। দীর্ঘ দিনের অবদমন ও সয়ে নেওয়ার আড়ালে সব সময়েই বারুদ জমে। অপেক্ষা শুধু স্ফুলিঙ্গের। ফারহা, সুপ্রিয়া, অর্পিতা, মহুয়ারা এই স্ফুলিঙ্গেরই অন্য নাম। মনোবিদ প্রশান্ত রায় জানালেন এমনটাই। তাঁর কথায়, ‘‘এ সব ক্ষেত্রে সাধারণত বড় সমস্যার ভয়ে চুপ থাকেন মেয়েরা। ভাবেন এটা তো তবু ছোট ব্যাপার। কিন্তু এই ‘ছোট ব্যাপার’গুলোই উপর্যুপরি রোজকার নিয়ম হয়ে উঠলে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে সাধারণ নিয়মে।’’ বাঁধ ভাঙুক। আরও জ্বলে জ্বলে উঠুক স্ফুলিঙ্গরা। মেনে নেওয়া নয়, বরং অভ্যাস হোক রুখে দাঁড়ানোর। অভ্যাস হোক গলা ছাড়ার। সেটাই যৌন হেনস্থার মতো ঘটনা এড়ানোর প্রথম ধাপ। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
×