ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সৌম্য সালেক

আধুনিক বাংলা কবিতা উচ্চ-শিল্প বিবেচনা

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ২১ অক্টোবর ২০১৬

আধুনিক বাংলা কবিতা উচ্চ-শিল্প বিবেচনা

‘ইভেলিন তুমি প্রেমের দাহনে আমার চিত্তকে গ্রীষ্মের মতো প্রোজ্বল কর/আমি শব্দকে শাণিত করতে চেয়েছি আমি প্রস্তর খ- হতে চেয়েছি বন্যার অভিমুখ যখন বাস্তবকে আর সহ্য করা যায় না তখন স্বপ্ন হয় খোলা চোখের প্রহেলিকা হে ভীষণ জাগ্রত স্বপ্ন মঞ্জুরী হে অসম্ভব স্বপ্নের কুয়াশা- নিবিড় অন্তঃসার দিবস কি সব মুছে শুধু প্রেমের তাপে অগ্নি হবে না?’ শিল্প-সাহিত্য পূর্ণতা ও অপূর্ণতার সমন্বিত অভিব্যক্তি; সে দৃষ্টি শিশুর মতো যে কখনও চিত্র প্রদর্শন করেনি, যার কোন বুদ্ধিগত অভিঘাতক্রিয়া নেই এবং যে রূপ আদিম উন্মেষের মতো। শিল্পীর দৃষ্টি ও বীক্ষা সম্পর্কে উল্লেখিত কবিতাংশের মতো চিত্রশিল্পী ও কবি পল ক্লী’র নিম্নোক্ত মন্তব্যটিও প্রণিধানযোগ্যÑ ‘ও ধিহঃ ধং ঃযড়ঁময হবি নড়ৎহ শহড়রিহম হড় ঢ়রপঃঁৎবং, বহঃরৎবষু রিঃযড়ঁঃ রসঢ়ঁষংবং, ধষসড়ংঃ রহ ধহ ড়ৎরমরহধষ ংঃধঃব.’ জীবনক্ষেত্রে সত্যের উপলব্ধিকে প্রকাশ করার প্রক্রিয়াই শিল্পসাধনা। পূর্ণতার কামনা করা কিন্তু প্রাপ্তিতে অপূর্ণ থাকার মধ্যে যে আসক্তি এবং অসঙ্গতি রয়েছে সেটাকে আপনমতো উদযাপনের সংগ্রামই একজন জাত-শিল্পীর যাপনধর্ম, ভিন্ন ভিন্ন বিবেচনায় কখনও তা আত্মঘাতী কখনও বা অভীপ্সিত। এই স্বেচ্ছাচার, আত্ম-অভিঘাত কিংবা বর্বর মর্মপীড়ায় প্রকা- হিমবাহ গলে ফুলে ওঠে সমুদ্র, তবু তার-স্বরে উড়ে যায় শঙ্খচিল, অশ্রান্ত মেঘমালা। প্রকৃতির তাৎপর্যের মতোই শিল্পের নির্মাণকলা। অঙ্কুরের আকাক্সক্ষা হচ্ছে পূর্ণ-ফলনের, স্রোতের টান সমুদ্রে, আকাশ অসীমে বস্তুত সব কিছুই প্রসারমুখী। প্রতিটি ক্ষণকাল বৃত্তান্তই চিরকালে স্তূপ স্তূপ জমে আছে। কালের এবং উপযোগিতার স্থূলতাকে বাদ দিয়ে কলা-কীর্তির যা কিছু মহার্ঘ-নির্যাস থাকে, তাই উচ্চ-শিল্পের (ঐরময-অৎঃ) মর্যাদায় চিরকাল চর্চিত হতে থাকে। সুর, চিত্রকলা এবং কবিতা এই তিন কলাকর্মই উচ্চ-শিল্পের অধিগমনে অধিক সাবলীল। নাটক, নৃত্য, আবৃত্তি, চলচ্চিত্রসহ প্রদর্শন-শিল্পের চবৎভড়ৎসরহম অৎঃ এর অপরাপর অনুষঙ্গসমূহে অধিচৈতন্য (ইনটিউইশন) ততোধিক প্রয়োগযোগ্য নয় যতটা সহজ কবিতা ও চিত্রশিল্পে , কেননা দ্রুত পালাবদলের চঞ্চলতা ওই ধারাসমূহকে প্রভাবিত করে চলে এমনকি কথকতা কিংবা চরিত্র চিত্রণের চটুলতা থেকে শিল্পী অনেক সময় নিজেও মুক্তি পেতে পারে না। যদিও শেক্সপিয়ার, বার্নাড শ, ব্রেখট, ব্যাকেট, ইবসেন, হেরল্ড প্রিন্টারসহ আরও কতক মহৎ নাট্যকার আছেন যাঁদের নাটক উচ্চ-শিল্প মানে উত্তীর্ণ এবং বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সমাদৃত। আমাদের লক্ষ্য সঙ্গীত, নাটক বা চিত্রকলা নয়; কবিতা এবং বাংলা কবিতার পালাবদল ও নির্ণিত, অনির্ণিত নির্দেশ সম্পর্কে দু’কথা বলেই বিদায় দেব। ইংরেজী রোমেন্টিক কবিতার অন্যতম সারথি ঝ.ঞ ঈড়ষবৎরফমব একমত হচ্ছে- ‘উৎকৃষ্ট শব্দের উৎকৃষ্ট পদবিন্যাস কবিতা’। এ্যারিস্টটল মনে করতেনÑ ‘কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি, ইতিহাসের চেয়ে বড়।’ কবিতা কী সে সম্পর্কে এমন ভিন্ন ভিন্ন বহু মত থাকলেও কোন মন্তব্যই আসলে চূড়ান্ত নয়। তবে বোধ করি অনুভূতি যখন হৃদয়কে স্পর্শ করে তার নিপুণ শব্দনিব্যাস কবিতা। প্রায় সবটুকু লাল এখনও অন্তরীণ গোলারের শীর্ষবিন্দুর ওই সৌন্দর্যটুকু কবিতা। চিতল হরিণী তার দ্রুতগামী ক্লান্তির শেষযামে যখন প্রশ্রবণে পিপাসায় মুখ নামায় সেই জলপান-শব্দ কবিতা। মানুষের হাজার বছরের নুয়েপড়া ইতিহাস, বুকফাটা মাতম, ধসেপড়া সভ্যতার প্রত্ম-নির্যাস, বিরহীর আশাহত আননের অশ্রুব্যঞ্জন আর শ্রান্ত-স্বেদবিন্দুর কলরোল কবিতা। বাংলা কবিতার ইতিহাস হাজার বছরের, হাজার বছরের নানা ধরন ও পরিবর্তন শেষে প্রথম আধুনিকতার ছোঁয়া লাভ করে মাইকেল মধুসূদনের হাতে; এই ছোঁয়া তাঁর অমিত্রাক্ষর প্রবর্তন, মহাকাব্য রচনা বা সনেট আমদানির জন্য নয়। বরং দেব-দেবী, হিরে-জহরত ছেড়ে মানুষের মাঝে বসে, মানুষের মতো বেদনায়, পীড়ায় ও আত্মদহনে উচ্চারণ প্রক্রিয়ার প্রারম্ভকরণেরÑ ‘মুকুতা ফলের লোভে ডুবে রে অতল জলে যতনে ধীবর/শতমুক্তাধিক আয়ু কাল-সিন্ধু জল তলে ফেলিস, পামার/ফিরে দিবে হারাধন কে তোরে অবোধ মন/হায় রে, ভুলিবি কত আশার কুহক ছলে।’ রবীন্দ্রনাথ আমাদের জনগণের মধ্যে উজ্জ্বল ও সর্বোচ্চ সৃজনশীল। কবিতায় কখনও তিনি ফিরেছেন উজ্জয়িনী নগর, বন-তপোবন শেষে কখনও স্নান সেরেছেন লুকনো ঝর্ণার জলে আবার মাটির পৃথিবীতে এসে আফ্রিকার কালো মানুষকেও চিনলেন, আবার ভুলে গেলেন না মাছিমারা হরিপদ কেরানিকেও। তবু রবীন্দ্রনাথ স্বপ্নচারীদের দলেরই সঙ্গ, এই সন্ধান লুকানো আছে তাঁর গীতিগুচ্ছেÑ এক সংক্ষুব্ধ আত্মার পাখা ঝাপটানি, আর্তনাদ সেখানে অবিরাম রোল তুলে যায়; চিরদিন যেন তাকে বন্দী রাখা হয়েছে কোন নিরন্ধ্র গুহাঘরে। রবীন্দ্র কবিতার এই রূপ অবশ্য গভীরভাবে অন্তরীণ। কাজী নজরুল ইসলামকে শিল্প-চেতনা যতটা না নাড়িয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি তিনি কেঁপেছেন স্বাধিকার ও মানবতা-মর্মে। শিল্প যে অস্ত্রের চেয়ে শাণিত হতে পারে ভাষা যে শাসনের লৌহ-বেদীকে ধুলায় নামাতে জানে বিশ্ব-সাহিত্যে তেমন নজির আছে, বাংলা সাহিত্যে সেই শাণিত কলম নজরুল ইসলামের। মানুষের মননশীলতার বিবর্তনের জন্য, বুদ্ধিবৃত্তি ও মানবতা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে আগে চাই স্বাধীনতা; এই স্বাধীন চেতনার সংহত ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশগুণে নজরুল বড় কবি। বাস্তববাদ তথা শরীরবাদীতাকে আশ্রয় করে প্রেম ও বিপ্লবাত্মক কবিতা রচনার মাধ্যমে নজরুল স্বল্পসময়ের মধ্যেই তরুণ ও বোদ্ধা মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হন। ‘নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়- আরও এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে; আমাদের ক্লান্ত করে’ যেখানে ব্যক্তিÑ বিষাদ, বিপন্নতা, বিসম্বাদ কিংবা অকস্মাৎপ্রাপ্তির দোলায় ক্রমাগত পাঁকখায়, জীবন যেখানে অবসরহীন সেখানে নিজের অগোচরেই এক ধরনের নৈরাজ্য বা নৈরাশ্য দানা বাঁধে এই বাস্তবতাÑ যান্ত্রিক পৃথিবীর। দ্রুত উত্থান-পতনে ক্রিয়াশীল জীবনের হাহাকার, বিপন্নতা ও বিস্ময়বোধের আধুনিক উচ্চারণই জীবনানন্দের কবিতা। নগর জীবনের যান্ত্রিকতার চেয়ে রূপসী বাংলার অমল প্রকৃতি চিরদিন তাঁর কাছে মহার্ঘ মনে হয়েছে। কবিতায় তিনি যন্ত্র-শাসিত জীবনের হতাশা, নৈরাজ্য ও অনিশ্চয়তাকে বাঙ্ময় করে তুলেছেন অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন প্রতীক ও উপমায়। শিল্প সামর্থ্যরে এবং নিবিড় বীক্ষণের বিশুদ্ধ ভাষাগুণে জীবনানন্দ দাস আমাদের আরেক মহৎ কবি প্রতিভা। নজরুল পরবর্তী বাংলা কবিতায় অত্যন্ত স্বল্পকালের জীবন নিয়ে আগমন ঘটেছে আরেক উচ্চ-কণ্ঠ কবির; সুকান্ত ভট্টাচার্য কবিতায় বিপ্লব, মানবতা ও আত্মবিশ্বাসের বাণী ফুটিয়ে অল্পসময়ের মধ্যেই সুধী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিলেন। ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি’Ñ উচ্চারণের মাধ্যমে তাঁর যে সুদূর চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে তাই তাঁর কবি হিসেবে পৌঢ়ত্ব কিংবা সম্পন্নতার অন্যতম স্মারক। কবিগান, পালাগান, জারি, পুঁথি এবং কথকতা বাঙালীর লৌকিক সংস্কৃতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গতিধারা। এই ধারাসমূহ যুগ যুগব্যাপী অত্যন্ত সাবলীলভাবে বাঙালী সমাজে প্রচলিত আছে। কোন আরোপিত কলাকৌশল এখানে কোনকালেই যুক্ত ছিল না। কবি জসীম উদ্দীন তাঁর কবিতায় যুগ যুগ ধরে প্রবহমান লোকজ কলারীতিকে আত্মস্থ করে কবিতায় চমৎকারভাবে প্রয়োগ করেছেন। গ্রামীণ মানুষের স্বর, জীবনের নানা আচার-অভিঘাত অত্যন্ত সুনিপুণভাবে জসীম উদ্দীনের কবিতায় ওঠে এস্ছে। গ্রামীণ বিষয়ানুষঙ্গের বাইরেÑ ‘মুসাফির’ ‘নিমন্ত্রণ’ ‘প্রতিদান’ সহ আরও বেশকিছু আধুনিক বিশুদ্ধ কবিতা তিনি রচনা করেছেন। শব্দচয়ন ও ভাষাভঙ্গির দিক দিয়ে ফররুখ আহমেদ রোমান্টিক কবি। মধ্যপ্রাচ্যের উপকথা ও শব্দের সঙ্গে নিজস্ব চিন্তার সংমিশ্রণে বাংলা কবিতায় তিনি নতুন আঙ্গিক পরিবেশনে সচেষ্ট ছিলেন। রূপক ধর্মিতা তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ‘সিন্দাবাদ’ ‘পাঞ্জেরী’ ‘ডাহুক’, ‘লাশ’, ‘সাত সাগরের মাঝি’ এবং ‘স্বর্ণ-ঈগল’ ফররুখ আহমেদের কবি প্রতিভার সার্থক নিদর্শন। বিনয় মজুমদার সব ছেড়ে-ছুড়ে সর্বান্তকরণে কবিতা লিখতে এসেছেন এবং কবিতাই লিখেছেন। ‘ফিরে এসো চাকা’ এবং ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’র কবি বিষয় ও ঘটনাকে ভেঙে এক সাধারণ ও সার্বিক আবহ নির্মাণ করে কবিতায় অত্যন্ত ঋজু বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, যেন তাঁর প্রতিটি শব্দই যথার্থ এবং অনঢ়। তিনি কবিতায় অতিরিক্ত মিথ ও বর্ণনার ঘনঘটাকে সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছেন। মানুষের নির্মিত ঐতিহ্যের চেয়ে প্রকৃতিক ঐতিহ্যকে তিনি কবিতায় অধিকমাত্রায় প্রতিস্থাপন করেছেনÑ ‘অনেক ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণে জেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে, কাকে বলে নীল- আকাশের, হৃদয়ের কাকে বলে নির্বিকার পাখি।’ উপস্থাপিত কবিতাংশের দিকে তাকালে, আরেকবার দেখতেও হয়; বোধে উপলব্ধিতে বিক্ষত হতে হতে কবির মতোই জানা যায় ‘বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে।’ বিরহ দিয়ে আরম্ভ হয়ে বিনয় মজুমদারের কবিতা প্রেম-অপ্রেমের অগম পাথারে এক বিচিত্র ঢেউ তোলেÑ নিজে যেমন দোলে, পাঠককেও দুলতে হয়। বাংলা সাহিত্যের অতি প্রজননশীল কবিদের অন্যতম শামসুর রাহমান। জীবিতকালেই তাঁর প্রকাশিত কাব্যের সংখ্যা ছিল ৬৫টি। হাজার হাজার কবিতার মধ্যে তাঁর শিল্পসম্মত কবিতার সংখ্যাও কম নয়। দ্বন্দ্বমুখর সময়, বস্তুব্যবস্থা, জাতিসত্তার পরাধীনতা ও প্রতিবেশ-ভাবনা তাঁর কলমকে জীবনসংলগ্ন কাব্যনির্মাণে উৎসাহিত করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধ-পরবর্তী ভাঙান ও স্খলনের চিত্র অত্যন্ত নিবিড় ও বস্তুনিষ্ঠভাবে ওঠে এসেছে তাঁর কবিতায়। অবশ্য অতিমাত্রায় সমকালীন বিষয়মুখিতা তাঁর কবিতাকে ভারাক্রান্ত করেছে কখনও, আবার কখনও বা এমনক্ষেত্রে তাঁর পারঙ্গমতা বা শিল্প সামর্থ্য যথারূপে বিকাশের অবসর পায়নি। আমরা শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্য থেকে তাঁর শিল্পবীক্ষার নন্দনলোক একটু ঘুরে আসিÑ ‘হাজার যুগের তারার উৎস ঐ যে আকাশ তাকে ডেকে আনি হৃদয়ের কাছে, সোনালি অলস মৌমাছিদের পাখা-গুঞ্জনে জ্বলে ওঠে মন, হাজার হাজার বছরের ঢের পুরনো প্রেমের কবিতার রোদে পিঠ দিয়ে বাসি’ (প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে/ শামসুর রাহমান ) ‘প্রথম রাত্রিতে তার বীর্যবান সন্তানের বীজ সযতেœ ধারণ করে আমি হবো ক্লান্ত ফলবতী আবার করাবো পান বুকের এ উৎসধারা হতে জারিত অমৃত রস, যা ছিলো একদিন সঞ্চিত এই সঞ্চারিত শরীরের কোষে, হে নূহ সন্তান দেবো, আপনাকে পুত্র দেবো আমি।’ (নূহের প্রার্থনা/ আল মাহমুদ) আল মাহমুদ বাঙালী জাতিসত্তা, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও লোকাচারের প্রধান ধারক কবি। তাঁর প্রধান সামর্থ্যরে জায়গা-সৌকর্যম-িত ভাষাভঙ্গি। লোকজ শব্দানুষঙ্গের সঙ্গে মিথ ও নানা উপকথার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি জন্ম দিয়েছেন এক ধ্রুপদী কাব্যভাষার; জীবনানন্দ দাস পরবর্তী আল মাহমুদের কাব্যভাষাই সব থেকে মৌলিক ও নান্দনিক। প্রেম ও প্রকৃতি তাঁর কবিতার প্রধান অবলম্বন হলেও প্রাচীন ভারতের কৃষিভিত্তিক জীবন, আরব্য রজনী, জুলেখার কাহিনী, সক্রেটিসের মোরগ, ঈশপের গল্প, বাংলাদেশের লোকলোকান্তরসহ নানা কিংবদন্তির কল্প-কথা অত্যন্ত নিবিড় শব্দসজ্জায় গাঁথা আছে তাঁর কবিতায়। লৌকিক শব্দানুষঙ্গের ভেতর দিয়ে সৈয়দ শামসুল হক এক রকম ঘোরলাগ যাদুময় আবেশ সৃষ্টি করেছেন কবিতায়; তিনি কখনই হতাশাবাদী নন বরং যুগযন্ত্রণা, জীবন জিজ্ঞাসা ও নানারূপ অন্তরীণ আকাক্সক্ষার কথা খুব বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের সঙ্গেই তিনি ব্যক্ত করেছেন কবিতার শব্দচক্রে। বাঙালীর ইতিহাস চেতনাকে আশ্রয় করে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ রচনা করেছেন বলিষ্ঠ এক কাব্য-আখ্যান, ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’। ‘বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা’Ñ কবিতায় তিনি শুনিয়েছেন ব্যক্তির ভূমিকায় জনসমষ্টির আকাক্সক্ষা ও অগ্রযাত্রার অভিজ্ঞান। ভাব, বিষয়, শব্দসৌকর্য এবং উপস্থাপনার প্রসাদগুণে তাঁর দীর্ঘ কবিতা দুটিই বাংলা কবিতার অনিবার্য পাঠ। শক্তি চট্টপাধ্যায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যুগলনন্দি বাংলা কবিতার বিষয়-সংকীর্ণতাকে অন্দরের কীট-মাছি পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছেন, জীবনের দৃষ্টিপাত যে দৃশ্য-সমষ্টির অণু-উপসর্গ পর্যন্ত প্রসারিত তাই তাঁরা দারুণ ঝরঝরে গদ্য-গীতলতায় উপস্থাপনে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। নির্মলেন্দু গুণ গণমানুষে কণ্ঠস্বর, আশা-নিরাশার ধ্বনি, প্রেম, যৌনতা ও সংগ্রামকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। মানুষের নিত্য-সংগ্রামের নিবিড়-নির্মেদ প্রতিচ্ছবি গুণ’-এর কবিতা, যা তাঁর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। আধুনিক বাংলা কবিতার বিকাশ ও বিবর্তণের সঙ্গে আরও অনেক কবির চিন্তা, জাগরণ, শ্রম-ঘামের ফলশ্রুতি গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। আমাদের স্থূলবুদ্ধি সাময়িকভাবে হয়ত সেই মধুকুঞ্জে হানা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু সূক্ষ্ম শিল্প-সচেতনতায় বাংলা কবিতাকে উন্নত-শিল্প-সম্পদে রূপান্তর কারণে আরও যে সকল কবিগণের ভূমিকা অনন্য তাঁদের মধ্যেÑ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, গোলাম মোস্তফা, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, সমর সেন, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, আহসান হাবীব, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, জয় গোস্বামী, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, উৎপল কুমার বসু, শহীদ কাদরী, ওমর আলী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, রফিক আজাদ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, আসাদ চৌধুরী, মুহাম্মদ নূরুল হুদা, আবুল হাসান, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কামাল চৌধুরী, হেলাল হাফিজ, আবু হাসান শাহরিয়ার, অসীম সাহা, হাসান হাফিজ এবং রেজাউদ্দিন স্টালিন উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেনÑ ‘আর্ট (শিল্প) হলো সত্যের ডাকে মানুষের সৃষ্টিমুখর অন্তরের সাড়া দেয়া।’ স্পর্শকাতরতা, অনুভূতি ও অভিঘাত প্রতিজন মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান তার মধ্য থেকে নান্দনিক সৃষ্টিলীলায় যাঁরা অনুভূতিতে সঠিক ভাষাদানে পারঙ্গম তারাই মহৎ শিল্পী। যে কোন উন্নত-শিল্পে অনুভূতি প্রকাশে স্বতঃস্ফূর্ততার পাশাপাশি পরিচ্ছন্ন বাঁক ও ব্যঞ্জনা থাকতে হয়। উন্নত-শিল্পের পাটভূমে কালের গ্রাস কখনই বড় আঁচড় কাটতে পারে না। কেননা সত্য ও সুন্দরের নিবিড় সমাবেশের গভীরে নিরন্তর মনোময় স্বর তোলেÑ বেদনার ও আশ্বাসের। কবি ও শিল্পীরা সেই পরিশ্রুত রাগ, রং, শব্দ ও ব্যঞ্জনার খোঁজে আজীবন আগম সন্ধানে ছুটে চলে।
×