ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হাবিবুর রহমান স্বপন

প্রথম বাঙালী নারী গ্র্যাজুয়েট কবি কামিনী রায়

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ২১ অক্টোবর ২০১৬

প্রথম বাঙালী নারী গ্র্যাজুয়েট কবি কামিনী রায়

করিতে পারি না কাজ সদা ভয় সদা লাজ সংশয়ে সংকল্প সদা টলে পাছে লোকে কিছু বলে। আমরা সেই ছোট সময় থেকে যার রচিত কবিতা ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ আবৃত্তি করি তার জন্ম এই দেশেরই বরিশাল জেলার বাসন্ডা গ্রামে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ অক্টোবর। তিনি কবি কামিনী রায়। ব্রিটিশ ভারতের প্রথম বাঙালী গ্র্যাজুয়েট। পিতৃ প্রদত্ত নাম কামিনী সেন। বিয়ের পর স্বামী কেদার নাথ রায়ের পদবি যুক্ত হয়ে হন কামিনী রায়। পিতা চ-িচরণ সেন ছিলেন তৎকালীন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, বিচারক। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী। তার কাকা নীতিশ রায় ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের জাঁদরেল ব্যারিস্টার। পরে যিনি কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। কামিনী রায়ের বোন যামিনী সেন ছিলেন তৎকালীন সময়ের প্রখ্যাত চিকিৎসক। তিনি নেপালের রাজ পরিবারের চিকিৎসক ছিলেন। অতি শৈশবেই কামিনী রায়ের পিতামহ নিমচাঁদ সেন কামিনী রায়কে কবিতা এবং স্ত্রোত্র পাঠ করতে শেখান। ছয় বছর বয়সে কলকাতার কেশবচন্দ্র সেনের ‘ভারত আশ্রম মহিলা বিদ্যালয়ে’ তার প্রাথমিক পাঠ শুরু হয়। মাইনর পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে কিছুদিন ‘কুমারী এফ্রয়েডের হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে’ পড়েন। এরপর ভর্তি হন কলকাতার বিখ্যাত বেথুন স্কুলে। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিভাগে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৮৩-তে এফএ পাস করেন। এবং ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রথম নারী যিনি স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি পড়েন সন্মানসহ সংস্কৃতি ভাষা সাহিত্য নিয়ে। পাস করেই তিনি শিক্ষক হিসেবে ‘বেথুন’ কলেজে যোগদান করেন। দীর্ঘদিন তিনি এই কলেজে অধ্যাপনা করেন। কবি হেমচন্দ্রের মানসকন্যা ছিলেন, কবি কামিনী রায়। দুঃখী মানুষের সেবায় আর্তপীড়িত মানুষের পাশে তিনি থাকতেন সর্বদাই। মানবতাকে তিনি গুরুত্ব দিতেন হেতু দরিদ্রদের পাশে থেকে তাদের যতটুকু সাধ্য সাহায্য সহযোগিতা করতেন সর্বদাই। তাই তো তার লেখনীতে ‘সুখ’ কবিতা রচিত হয়েছে, নাই কিরে সুখ? নাই কিরে সুখ?/এ ধরা কি শুধু বিষাদময়? যতনে জ্বলিয়া কাঁদিয়া মরিতে/কেবলী কি নরজনম লয়?/কাঁদাইতে শুধু বিশ্বরচয়িতা/সৃজন কি নরে এমন করে?/মায়ার ছলনে উঠিতে পড়িতে/মানবজীবন অবনীপরে?... পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি,/হে জীবন মন সকলি দাও। তিনি জীবনবৃত্তের মাঝে থাকতে থাকতে আবার লিখলেন, ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’। মাত্র ৮ বছর বয়সে কামিনী রায় কবিতা রচনা করেন। তার কবিতায় জীবনের সুখ, দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, আশা-আকাক্সক্ষার কথা সহজ সাবলীল ভাষায় পরিস্ফুটিত হয়েছে। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে ২৫ বছর বয়সে তার প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘আলো ও ছায়া’ প্রকাশিত হয়। কিন্তু কাব্য গ্রন্থে কবির নাম অজ্ঞাত কারণে উহ্য রাখা হয়। কাব্য গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছিলেন কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ত্রিশ বছর বয়সে সাত সন্তানের পিতা বিপতœীক কেদার নাথ রায়ের সঙ্গে কামিনী রায়ের বিয়ে হয়। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে কামিনী সেনের (বিয়ের পূর্বে) ভালবাসা হলেও বিয়ে হয়নি। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় কামিনী রায়কে ভালবাসতেন। তবে এই ভালবাসা ছিল এক তরফা। জীবনসঙ্গিনী হিসেবে কামিনী রায়কে না পেয়ে প্রফুল্লচন্দ্র রায় চিরকুমারই থেকে যান। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে স্ট্র্র্যাটুটারি সিভিলিয়ান কেদার নাথ রায়ের সঙ্গে কামিনী রায়ের বিয়ে হয়। এক পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিয়ের ১২ বছর পর (১৯১০ খ্রি) স্বামীর মৃত্যু হয়। এর তিন বছর পর শিশুসন্তান অশোকের মৃত্যু হয়। স্বামী এবং পুত্রের মৃত্যুর পর দুঃখ বেদনা নিয়েই পরবর্তী জীবন অতিবাহিত করেন। দুঃসহ শোক ও অসীম বেদনা নিয়েই তিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন। পুত্রের অকাল মৃত্যুর পর তিনি ‘অশোক সঙ্গীত’ নামে সনেট রচনা করেন। হে অনাদী হে অনন্ত,/হারায়ে সন্তান, বিশ্বহেরি মাতৃহীন।/শিশু বুকে ধরি, জননী কি স্বপ্নাবেশে নিজে/দেয় হরি মাতৃস্নেহে মহাবিশ্ব?’ আজীবন তিনি সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। তার কাব্য গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘আলো ও ছায়া’, ‘গুঞ্জন’, ‘মাল্য নির্মাল্য’, ‘অশোক সঙ্গীত’, ‘অম্বা নাট্য কাব্য’, ‘ঠাকুমার চিঠি’, ‘দীপ ও ধূপ’, ‘জীবন পথে’,। তৎকালীন সময়ে তিনি অত্যন্ত আধুনিক মনস্কতার প্রতীক ছিলেন। তিনি নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিয়েও আন্দোলন করেন। নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন তিনি। তাদের আন্দোলনের ফলেই তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে বাঙালী নারীর ভোটাধিকার প্রদান করে। কামিনী রায়কে ব্রিটিশ সরকার ‘নারী শ্রম তদন্ত কমিশন’ এর সদস্য মনোনীত করে। তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের ভাব শিষ্য ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তার সাহিত্যচর্চার প্রেরণা। তিনি রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে ‘রবীন্দ্র পরিচয়’ কবিতাটি রচনা করেন, ‘হে বাণী পুত্র করি নমস্কার/ধন্য তুমি পেয়েছ যে ভার বিলাবার,/ জগতে আনন্দ আলো, সত্য কবি তুমি,/তুমি ভারতের রবি, ধন্য জন্মভূমি’। ‘নির্মাল্য’ কাব্য গ্রন্থের ‘সাজাহান’ কবিতাটি তিনি সনেটের রূপে রচনা করেন। ‘এই সৌধরাজি প্রাণে চাহি যতবার/অতুল বিস্ময় মাঝে ততো ডুবে যাই।/সৌন্দর্যের পূর্ণবাস। ভাবিয়া না পাই...।’ এই কবিতাটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারমিডিয়েট কোর্সে বাংলা সংকলনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ‘অশোক সঙ্গীতের’ সনেটগুলোতে কবি কামিনী রায় তার ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখ ব্যথা বেদনার প্রতিচ্ছবি অঙ্কন করেন। ‘অতিথি সে এসেছিল বেলা দ্বিপ্রহরে,/স্নাতদেহে গেহে মোর করিল প্রবেশ,/ সুধাতে ছিল না মনে কোথা তার দেশ,/কোন কাজে এসেছিল, ক’দিনের তরে।’ কামিনী রায়ের কবিতায় মাতৃস্নেহ এবং শিশু মনের আকুতি প্রকাশ পেয়েছে ‘কত ভালবাসি’ কবিতায়। ‘জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে আসি/মা তোমারে কত ভালবাসি/কত ভালবাস ধন? জননী সুধায়/এ-তো-বলি দুই হাত প্রসারী দেখায়/তুমি মা তুমি আমারে কতখানি?/মা বলেন, মাপ তার আমি নাহি জানি/তবু কতখানি বল। যতখানি ধরে/তোমার মায়ের বুকে নহে তার পরে।/ তার বাড়া ভালবাসা পারি না বাসিতে/ আমি পারি। বলে শিশু হাসিতে হাসিতে। নারীবাদী ছিলেন কবি কামিনী রায় তবে উগ্র ছিলেন না। বাঙালী ললনাদের মতোই ছিল তার শান্ত স্বভাব। তবে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সব আন্দোলন সংগ্রামের অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিতেন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কবি কামিনী রায়কে তার অসামান্য কবি প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘জগত্তারিনী’ স্বর্ণপদক প্রদান করে। তিনি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের ২৯তম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। শেষ বয়সে তিনি ঝাড়খ-ের হাজারীবাগে বসবাস করতেন। ১৯৩৩-এর ২৭ সেপ্টেম্বর ৬৯ বছর বয়সে এই বিদুষি বাঙালী কবির মৃত্যু হয়।
×