ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রেজওয়ানা আলী তনিমা

খনার বচন এখনও গ্রামীণ কৃষিতে প্রাসঙ্গিক

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২১ অক্টোবর ২০১৬

খনার বচন এখনও গ্রামীণ কৃষিতে প্রাসঙ্গিক

প্রাচীন ভারত উপমহাদেশের বিদুষী নারী খনা। প্রাচীনকালে এ অঞ্চলে কৃষি, জ্যোতিষ, গণস্বাস্থ্য ও প্রাত্যহিকজীবন সংক্রান্ত ছোট জ্ঞানবাক্য/ বচন রচয়িতা ব্যক্তিত্ব ছিলেন অসমের ডাক পুরুষ, বাংলার ডাক, মিথিলার ঘাঘ, রাজস্থানের ঢংক, ভডডরী, পরাশর ও খনা। শেষেরজন খনা বিশেষত কৃষিতত্ত্ববিদ হিসেবে ভীষণ প্রভাবশালী। আজও অসম থেকে কেরালা পর্যন্ত -ভারত মহাদেশের পূর্বে অর্থাৎ অসম, উভয় বঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যাতে- এত দীর্ঘকাল ধরে বিস্তৃত জায়গাজুড়ে তার মতো আর কারও বচন এত জনপ্রিয় নয়। নারীপরিচয় নিয়ে সেকালে এত পরিচিত হয়ে ওঠাও বিস্ময়কর। একজন নারীর কথা যে এতটা সারগর্ভ হতে পারে তা অনেকেই বিশ্বাস করতে চায়নি। কিন্তু এ কথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি নারী। নিজের কথাতেই তিনি নিজেকে অটনাচর্যের কন্যা, বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহের পুত্রবধূ ও তার পুত্র আরেক জ্যোতির্বিদ মিহিরের পতœী হিসেবে পরিচয় দিয়ে গেছেন। কালক্রমে তিনি অবশ্য জ্যোতির্বিদ্যা, হোরা শাস্ত্র, কৃষিতত্ত্ব, স্বাস্থ্যবিধি ইত্যাদিতে এতই খ্যাতি অর্জন করেন যে, নিজের প-িত শ্বশুরকেও পেছনে ফেলে দেন। জ্যোতিষ ও হোরাবিদ্যায় এখন আর আধুনিক মানুষ বিশ্বাস করেন না। কিন্তু কৃষকদের মধ্যে কৃষি সংক্রান্ত তাঁর জ্ঞানগর্ভ বাণীগুলো আজও প্রচলিত। খনার বচনের উপর পিএইচডি ডিগ্রীধারী ড. আলি নওয়াজ তার ‘খনার বচন কৃষি ও কৃষ্টি’ বইতে লিখেছেন, ‘ডাকের কথা ও খনার বচন কৃষিকেন্দ্রিক বাঙালী সংস্কৃতির বুনিয়াদ ও বাঙালীর মননশীলতার আদল রচনা করেছিল বললেও অত্যুক্তি হয় না।’ একজন প্রাচীন নারীর পক্ষে কৃষিকাজে কিভাবে এতখানি প্রজ্ঞা রাখা সম্ভবপর হয়েছিল? আসলে অন্তত এই অঞ্চলে কৃষি মেয়েদের দ্বারা সূচিত হয়েছিল। প্রাচীন বাংলার মেরুদ-ও ছিল কৃষি। অভিজাত সুশিক্ষিত মানুষ কৃষিকাজ করতেন। কৃষিসম্পদ ছিল অহঙ্কারের বিষয়। ঔপনিবেশিক শাসনের সময় কৃষি মর্যাদা হারায়। এর প্রমাণ আছে, কৃষিভিত্তিক সমাজ নিয়ে খনার নিজেরই বচন, ‘ধান ধন বড়ো ধন, আর ধন গাই। সোনারূপা কিছু কিছু আর সব ছাই।’ - ধান ও গাভীই বড় সম্পদ, তুলনায় সোনারূপাও নগণ্য। খনার সহস্রাধিক বচন এখনও টিকে আছে। কাব্যগুণ ছাড়াও প্রায়োগিক প্রয়োজনে মানুষ এগুলোকে মনে রেখেছে। বিশেষত উড়িষ্যায় তাঁর বচন মেনেই কৃষিকার্য হয়। নমুনা জরিপে কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও দিনাজপুর জেলার ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের গ্রামে গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে তিনটি জেলাতেই খনার বচন সম্পর্কে জানেন কমবেশি শতকরা ৯৭ জন। বলা চলে, খনার বচন আজ আর কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির পরিচয় না বরং গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের অংশ। খনার কিছু বাক্য পল্লীবাসীর জীবনের নিত্যসঙ্গী। এগুলো একসময় সঙ্কলন আকারে পাওয়া যেত, গান হিসেবে গাওয়া হত, এখনও উড়িষ্যায় গাওয়া হয়। ‘কার্তিকের উনজলে। খনা বলে দুনো ফলে।’ , ‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজার পুণ্য দেশ’- ইত্যাদি এখনও কৃষকরা বিশ্বাস করেন মুখস্থ অনেকের না থাকলেও। যখন আধুনিক কৃষিজ্ঞানের প্রসার ছিল না তখন কৃষকরা এসব থেকে উপকৃত হয়েছেন কিন্তু এযুগেও এসব কতটা প্রাসঙ্গিক? কৃষি, উদ্যান ও পশুবিদদের মতে অনেকগুলোই যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক। তার ‘নারিকেল গাছে দিলে লুনে মাটি। শীঘ্র শীঘ্র বাঁধে গুটি ‘মানে নারিকেল গাছের গোড়ায় লোনা মাটির প্রয়োগ সুফলন দেয় অথবা ‘ফাগুনে আগুন চৈতে মাটি। বাঁশ বলে শীঘ্র উঠি।’ মানে ফাল্গুন মাসে বাঁশের ঝাড়ে শুষ্ক ঝরাপাতা পুড়িয়ে চৈত্র মাসে মাটি চাপা দিলে বাঁশ তাড়াতাড়ি বাড়ে, এসবের সঙ্গে আধুনিক বিশেষজ্ঞরাও একমত। শেষোক্তক্ষেত্রে তারা অভিমত দেন যে, এটা ফসফেট সারের কাজ করে। আমরা ঐতিহ্যসমৃদ্ধ জাতি এবং সাম্রাজ্যবাদী শাসন আমাদের শেকড় থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে নিয়েছে। তবে এখন যখন আমরা ধীরে ধীরে আবার নিজেদের সংস্কৃতি নিয়ে মনোযোগী হচ্ছি তখন খনার মতো প-িতরা আমাদের অতীত হয়ে যাওয়া দিনের সঙ্গে মূল যোগসূত্র। মনে রাখা দরকার, খনা হচ্ছেন সেই সদূর সময়ের মানুষ যখন বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক কৃষির সূত্রপাতই হয়নি। ফসলবিন্যাস অন্যরকম ছিল। ধান ও কলা ছিল অন্যতম প্রধান শস্য, ব্যাপক আকারে হতো কার্পাসচাষ- যা থেকে উৎপন্ন উন্নতমানের কাপড় সেদিন পর্যন্ত বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে। অতীতের সুদিন মনে করিয়ে দেয় খনার একটি বচন, ‘শতেক ধেনু হাজার কলা। কি করবে আকাল শালা।’ এতে ধারণা করা যায় একজন গৃহস্থের তখনকার দিনে একশ গাভী (ধেনু) ও হাজার কলাগাছ থাকাও অসম্ভব ছিল না। খাজনা দিয়ে কৃষক অপরিমেয় জমি চাষ করতে পারতেন। এগুলোতে প্রাচীন ভাষা ও জীবন অভ্যাসের সূত্র থাকায় ভাষাবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকদের গবেষণার উপাদান আছে। স্বাস্থ্য ও বাস্তুবিদ্যা সম্পর্কেও তিনি মূল্যবান কথা বলে গেছেন। ড. নওয়াজ বলেছেন, খনা এ ব্যাপারে প্রাচীন গ্রীসের মহিলা চিকিৎসাবিদ হাইজিয়ার সঙ্গে তুলনীয়। তার, ‘আলো হাওয়া বেঁধো না। রোগে ভোগে মরোনা।’- আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও স্বীকার করে। খনার সহজ ছন্দের কথাগুলো বৃহৎ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীতে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এখনও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু পাশ্চাত্যশিক্ষার প্রভাবে আমরা এ সম্বন্ধে উদাসীন। আমরা বিজাতীয় ‘আরলি টু বেড আরলি টু রাইজ মেকস এ ম্যান হেলদি ওয়েলদি এ্যান্ড ওয়াইজ।’ মনে রেখেছি কিন্তু ভুলে গিয়েছি খনার, ‘সকালে শোয় সকালে ওঠে। তার কড়ি না বৈদ্য লুটে।’ তবে দেরিতে হলেও যেহেতু আমরা ঐতিহ্যসচেতন জাতি তাই আশা করা যায়, খনাকে নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হবে, আবিষ্কার হবে তার যুক্তির বৈজ্ঞানিক প্রমাণ। বিস্মৃতি অন্ধকারে হারাবার আগেই আমরা এই বিদুষী ব্যক্তিত্বের যথাযোগ্য সমাদর করব।
×