ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

কন্যা সন্তান আজও সামাজিক অভিশাপে...

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২১ অক্টোবর ২০১৬

কন্যা সন্তান আজও সামাজিক অভিশাপে...

১১ অক্টোবর পালন করা হলো ‘আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস।’ প্রতিটি দেশের কন্যাশিশুদের সামগ্রিক অবস্থার ওপরই নির্ভর করে দিবসটির তাৎপর্য। সেখানে এমন অনেক সামাজিক সূচক নির্ণীত হয় যেখান থেকে বের হয়ে আসে কন্যাশিশুদের বর্তমান অবস্থা। শুধু বাংলাদেশই নয় উন্নত বিশ্বসহ পৃথিবীর অনেক দেশে কন্যাশিশুদের সামগ্রিক চিত্র আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে অনেকটা বেমানান। সমাজ কর্তৃক আরোপিত বৈষম্যকরণ অনেক দেশে কন্যাশিশুদের জন্য বয়ে আনে এক ভয়াবহ সামাজিক অভিশাপ, যে অভিশাপের সঙ্গে বিশ্বের কন্যাশিশুরা রীতিমতো জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে কন্যাশিশুদের ওপর নির্মমতার এক চিত্র ফুটে ওঠে। সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে পাঁচটি সামাজিক সূচককে নির্ধারণ করে কন্যাশিশুর ওপর এক জরিপ চালানো হয়। বিশ্বজুড়ে চালানো এই গবেষণা উপাত্তে ১৪৪টি দেশকে এর আওতায় আনা হয়। সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে আফগানিস্তান ছাড়া আর সবাই বাংলাদেশের ওপরে। আর বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান ১১১তম। কন্যাশিশুদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশ নাইজার। আর শীর্ষে রয়েছে সুইডেন। অর্থাৎ সুডেনেই কন্যাশিশুর শৈশব থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত জীবনযাত্রার মান বিশ্বের বহু উন্নত দেশের চাইতেও অনেকখানিই এগিয়ে। এই ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের অবস্থান ১৫ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩২। জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংক কর্তৃক সংগৃহীত এসব তথ্য-উপাত্ত গত এক বছরের নমুনা জরিপের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। এতে দেখানো হয় বিশ্বে প্রতি সাত সেকেন্ডে ১৫ বছরের নিচে একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। মেয়ে শিশুদের জন্য সবচেয়ে নিম্নমানের দেশ নাইজার ৭৬% কন্যার বাল্যকালেই বিয়ে হয়ে যায়। তথ্য প্রদানকারী সংস্থাটির নির্বাহী কর্মকর্তা জানান বাংলাদেশেও এক-তৃতীয়াংশ কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক অপসংস্কারে নিগৃহীত হচ্ছে। এ তো বিয়ে নয়, বিয়ের নামে নির্মম পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া। নিজেকে বোঝার আগেই, শরীর মনকে তৈরি না করেই একটি অবোধ, অবুঝ বালিকাকে চরম সর্বনাশের মুখোমুখি করা হয়। যে পাঁচটি সামাজিক সূচকে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয় সেগুলো হলেÑ ১. বাল্যবিয়ে ২. কিশোরী বয়সে মাতৃত্ব ৩. প্রসূতি মৃত্যুর হার ৪. সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব এবং ৫. স্কুলে ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হারের ওপর। এ জরিপ থেকে আরও বেরিয়ে আসে প্রতিটি সমাজেই একটি নির্দিষ্ট কাঠামো থাকে। তারই আলোকে সে দেশের সামগ্রিক কর্মকা- নির্ধারিত। কোন সমাজের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আবহ সে দেশের প্রতিটি নাগরিকের সামনে চলার গতি নির্ণয় করে। তারই ওপর নির্ভর করে বিয়ে থেকে আরম্ভ করে সমস্ত সামাজিক অনুষ্ঠান নির্ধারিত পথেই চলতে থাকে। যান্ত্রিক সভ্যতার ক্রমান্বয়েও এসব সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আচারবিধি তার ঐতিহ্যিক গতিপথের ব্যত্যয় ঘটাতে পারে খুব কমই। অর্থাৎ যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা সামাজিক নিয়মশৃঙ্খলা, বিধি-নিষেধ কাঠামোর গভীরে একেবারে শক্তভাবে গেঁথে আছে। গ্রাম-গঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসহায় বালিকাদের পক্ষে এসব অবিচার, অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়াই করাও সম্ভব হয় না। কারণ যেখানে তার বাবা-মাই বালিকা মেয়েটিকে পাত্রস্থ করার জন্য দিশেহারা হয়ে ওঠেন। সামাজিক নিন্দার ঝড়, নিয়ম ভাঙ্গার অপরাধ, নির্দেশিত ঐতিহ্যিক মূল্যবোধের ব্যত্যয় ঘটানো আসলে বাবা-মায়ের পক্ষেও অসম্ভব হয়ে পড়ে। গঁৎবাধা সামাজিক অনুশাসনকে দুর্বার গতিতে অতিক্রম করতে না পারলে বাল্যবিয়ের মতো এমন পর্বত প্রমাণ সমস্যাকে ডিঙানো আসলেই মুশকিল। কোন নেতৃত্ব নয়, কোন হুজোগও নয় সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ঠা-া মাথায়, নীরব লড়াইয়ে, যৌক্তিক সমাধানে এ ধরনের সামাজিক অব্যবস্থা থেকে মুক্ত হতে না পারলে কন্যাশিশুদের অপরিণামদর্শী পরিণতি থেকে বের করা যাবে না। বিদ্যমান সমাজ, শ্রেণী বিভক্ত সমাজ এমনভাবে অসাম্য-বৈষম্য তৈরি করে যার সমস্ত নেতিবাচক ফলগুলো বর্তায় অসহায় এবং দুর্বল শ্রেণীটির ওপর। আর এই দৌর্বল্যের মাপকাঠিতে কন্যাশিশুরা তো বেশ খানিকটা এগিয়েই। বাল্যবিয়ের কারণে নারী শিক্ষার হার কমতে থাকে যার প্রভাব পড়ে সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর। উন্নয়নের গতিধারা যতই অবাধ ও নিরন্তর হোক না কেন অর্ধাংশ নারী জাতিকে পেছনে ফেলে তা যথার্থভাবে এগুতে পারে না। সে কোন উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষা প্রচলন, বাল্যবিয়ে রদ এবং বিধবা বিবাহের সপক্ষে জোর আন্দোলন চালিয়েছিলেন। কিন্তু আজ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের ক্রান্তিলগ্নেও যদি এই ধরনের কন্যাশিশু নিপীড়নের চিত্র জনসম্মুখে স্পষ্ট হয় তাহলে সভ্যতার সামগ্রিক উৎকর্ষতার মাত্রা কি বিঘিœত হয় না? মানবিক মূল্যবোধ কি অসম্মানে জর্জরিত হয় না? মনুষ্যত্বকে কি অপমান করা হয় না? নারী জাতির অধিকার, স্বাধীনতা, ইচ্ছা-অনিচ্ছার আকাক্সক্ষা ও বিরোধকে কি নির্মমভাবে কণ্ঠরোধ করা হয় না? সভ্যতার চরম সমৃদ্ধির যুগে, প্রযুক্তি বিদ্যার ক্রমান্বয়ের এই ক্রান্তিলগ্নে এমন অসম বিকাশ যে কোন দেশকে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে দীর্ঘসূত্রতা অবলম্বন করা ছাড়া উপায়ও থাকে না।
×