ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৬৭ বছরে আওয়ামী লীগ

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২১ অক্টোবর ২০১৬

৬৭ বছরে আওয়ামী লীগ

মুনতাসীর মামুন (২০ অক্টোবরের সম্পাদকীয় পাতার পর) গত কয়েক দশকে আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সেক্টরে অসংখ্য কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন। দেশ ও জাতি তাতে উপকৃত হয়েছে। শেখ হাসিনার আমলে দেশের সার্বভৌমত্ব চিহ্নিত হয়েছে অর্থাৎ সীমান্ত চুক্তি হয়েছে, ছিটমহল সমস্যা মিটেছে যা ১৯৪৭ থেকে মেটানো যায়নি। মিয়ানমার ভারতের সঙ্গে ১৯৭২ থেকে সমুদ্রসীমা নিয়ে যে দ্বন্দ্ব তার সমাধান হয়েছে, অবকাঠামোর প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে, গ্রামগুলো টাউনশিপে পরিণত হয়েছে, মানুষের আয় রোজগার বেড়েছে, জিডিপি বেড়েছে। তবে, ৫০ বছর পর মানুষ এগুলো ভুলে যাবে। কারণ, তখন তারা উন্নত দেশের বাসিন্দা, পূর্বসূরিদের কথা তখন মনে থাকে না, এটি স্বাভাবিক হিসেবেই ধরে নেয়া হবে। কিন্তু ইতিহাসে থাকবে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছিলেন প্রচলিত ধারায় এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় এমনকী চীন, জাপান, কোরিয়াও যা পারেনি বাংলাদেশ তা পেরেছে এবং এ কৃতিত্ব বলবো, সম্পূর্ণ শেখ হাসিনার। শেখ হাসিনাবিহীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে আর যাই হোক বঙ্গবন্ধু হত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতো না। আওয়ামী লীগের নেতাদের একটি বড় অংশ এ বিচার চায়নি। এখন এটি অনেকেই অস্বীকার করতে পারেন কিন্তু এটি সত্য। আওয়ামী লীগের আরেকটি বড় কৃতিত্ব এবং শেখ হাসিনার পাকিস্তানীকরণ প্রতিরোধ। জিয়া এরশাদ খালেদা নিজামীরা বাংলাদেশের যে পাকিস্তানীকরণ করতে চেয়েছিলেন তা প্রতিরোধ করা হয়েছে। ঐ দুই বিচার ও ইনডেমনিটি বাতিল ছিল পাকিস্তানীদের দুর্গে প্রথম তোপ। অন্যান্য বিষয় তো আছেই। এ কারণে বঙ্গবন্ধু সমর্থক যদি হন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যদি শরিক হন, তা হলে আপনাকে চিহ্নিত করা হবে আওয়ামী লীগের সমর্থক/দালাল হিসেবে। আর যদি এর বিরোধী হন তা’হলে চিহ্নিত হবেন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বা বিএনপি হিসেবে। সমাজে এই ধারণার সৃষ্টি ইতিবাচক বলেই আমি মনে করি। আমাদের অনেককে আওয়াগী লীগ/ভারতের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। আমি বা আমার বন্ধুরা তাতে বিচলিত হইনি। বরং বলেছি, পরাজিত পাকিস্তানের সমর্থক বা দালাল হওয়ার মধ্যে গৌরবের কিছু নেই। আর সংস্কৃতিমনা এবং যথার্থ অর্থে শিক্ষিত [উচ্চশিক্ষা বা পিএইচডি থাকলে শিক্ষিত বলা চলে কিন্তু সত্যিকার অর্থে শিবির শব্দের নামে অন্য]। দলের পক্ষে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক হওয়া দুরূহ। ॥ দুই ॥ বাংলাদেশের সবচেয়ে সোজা কাজ রাজনৈতিক দলের বা নেতৃত্বের সমালোচনা করা। কিন্তু প্রশংসায় সবাই স্ব-কৃপণ। অন্যান্য দেশে রাজনৈতিক দল ভালো কাজ করলে যেমন যোগ্য বলে বিবেচিত হয়, তেমনি ভুল করলে প্রচ- সমালোচনা শুধু নয়, দায়হীনতার কৈফিয়তও দিতে হয়। আমাদের রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রশংসা ভালোবাসেন আর তা যদি দেশের বাইরে থেকে হয় তা’হলে আরও ভালো। সমালোচনা নৈব নৈব চ। আওয়ামী লীগ তবুও সমালোচনা একটা পর্যায় পর্যন্ত মেনে নেয় যেমন রামপাল বিতর্ক, অন্যদলগুলোর সে ঐতিহ্য নেই। তবে, সামগ্রিকভাবে কোন রাজনৈতিক নেতা [বা দল] সমালোচনা পছন্দ করেন না। যদি কেউ মুখর হয় তখনই তাকে বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে বলা হয় বিএনপি-জামায়াত সমর্থক অথবা চীনাপন্থী। বিএনপির থেকে বলা হয় আওয়ামী দালাল বা ভারতীয় দালাল। এখন অবশ্য আওয়ামী লীগের পক্ষে কাউকে চীন বা ভারতীয় দালাল বলা দুরূহ হয়ে উঠবে। চীন যেভাবে সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছে তাতে বিএনপি নেতারাই অসুবিধায় পড়ে গেছেন। রাশেদ খান মেনন বা দিলীপ বড়ুয়াকেও চীনাপন্থী বলে গালি দেওয়ার আগে তাদের এখন দুবার ভাবতে হবে। যাক সে সব কথা। আগামীকাল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল। এ নিয়ে নানা গুজব। নেতৃত্বের পরিবর্তন আসবে কিনা? এলে তা কেমন হবে? জয়ের বয়সী বা তাকে ঘিরে যে বলয় তারাই এবার ক্ষমতাবান হয়ে উঠবে নাকি সব গ্রুপেরই ব্যালান্স থাকবে? বয়সীরা কি একেবারে বাদ যাবেন? সব বয়সী চলে গেলে শেখ হাসিনাই বা কিভাবে থাকবেন? দলে কী হবে না হবে সেটি শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ জানেন না, বাজারে যত গুজবই থাকুক না কেন। খবরের কাগজে যত স্পেকুলেশনই ছাপা হোক না কেন। ১৯৭২ সাল থেকে দেখা গেছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে সরকার ও দল এক হয়ে যায়। এক পদ নীতি গ্রহণ না করা এর কারণ। অর্থাৎ দলে যিনি পদে আছেন সরকারেও তিনি পদে থাকেন। এটি শুধু আওয়ামী লীগ নয় বিএনপি-জামায়াত থেকে জাসদ [ইনু] জাসদ [বাদল], ওয়ার্কার্স পার্টি সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সরকার ও দল সে কারণে একীভূত হয়ে যায়। সাংগঠনিকভাবে দল দুর্বল হয়ে যায়, সরকারী সহায়তা ও প্রতিপত্তির কারণে দল টিকে থাকে। অনেকে বলেন, আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে না তখন দলে সংহতি থাকে, পরস্পরের বিরোধিতা কম থাকে। নেতারা কর্মীদের প্রতি অশেষ মনোযোগ দেন। দল সাহসী থাকে। কথাটি হয়ত অনেকাংশে সত্য। যদিও দলীয় নেতৃত্ব কখনও প্রকাশ্যে তা স্বীকার করে না। করবেও না। আরেকটি কথা প্রচলিত ব্যাপকভাবে যে, আওয়ামী লীগের জন্য যারা জান দেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা নিগৃহীত হবে। যারা ‘নিরপেক্ষ’ থাকবে, সঙ্কটের সময় ‘প্রবাসী’ হবে তারাই পুরস্কৃত হবে। যদি ভালোভাবে শেখ হাসিনার সমালোচনা করা যায় তা’হলে মেয়র থেকে মন্ত্রী সবই যাবে এবং তার উদাহরণ অজস্র। এ বিকৃত নীতি বোধগম্য নয়। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার আগে যখন সংস্কৃতি থেকে রাজনৈতিক, সামাজিক কর্মীরা মাঠে রাস্তায় নিপীড়িত নিগৃহীত, যখন আজকের বিভিন্ন পদাধিকারী ও সরকারের মহব্বতজানরা বিদেশে বা আমাদের ঠেঙাচ্ছে, তখন আওয়ামী লীগের অতি প্রভাবশালী এক নেতা আমাকে বলেছিলেন, মুনতাসীর জানটা তো দিয়ে দিলেন, কিন্তু ক্ষমতায় গেলে তো আপনাকে চিনতে আমাদের কষ্ট হবে। আমি বললাম, সেটিই আপনাদের ঐতিহ্য, কিন্তু আমি বা আমরা জান দিচ্ছি আপনারা আমাদের চিনবেন বলে নয়, জানটা দিচ্ছি ‘ক’জ’ বা আদর্শের জন্য। কারণ আমরা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র চাই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে একেবারে ১০০ ভাগ না হলেও অসাম্প্রদায়িকতা মূলনীতি হবে। এক্ষেত্রে অবশ্য বলতে হয় মূল নেতৃত্বই দলের চরিত্র নির্ধারণ করেছে। বঙ্গবন্ধুর কথা আগেই বলেছি। এখন বলি শেখ হাসিনার কথা। এখন দলে নানা ভিড়, নানা টানাপোড়েন এবং এমন অনেক কর্মকা- দল করছে, সরকারও, যে শেখ হাসিনা না থাকলে দক্ষিণপন্থী দলই বলা হতো। আওয়ামী লীগকে কিন্তু তার চরিত্রই প্রগতির পথে রেখেছে। সে কারণে অন্যান্য দলের তুলনায় আওয়ামী লীগকে লিবারেলই বলা যেতে পারে। দলে যারা সক্রিয় হয়ে বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছেন বা নিচ্ছেন তাদের মতে, সরকার ও দল ঠিকঠাক চলছে, কোন সঙ্কট নেই। মনে আছে এরশাদ পদত্যাগের দু’তিন দিন আগে টঙ্গীতে এক সমাবেশে ঘোষণা করেছিলেন, কোন সঙ্কট নেই। কিন্তু একটি বড় অংশ মনে করে, সঙ্কট আছে। প্রথম হলো, নব্যধনী প্রচুর এমপির দলে আগমন। গত নির্বাচনে শেখ হাসিনা খুব সম্ভব সংখ্যা চেয়েছেন, ব্যক্তি নয়। কে জিতে আসবেÑ যে সেই হোক। তাতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে কিন্তু সে দল আর নেই। একেকটি এলাকায় নতুন এমপিরা নতুনভাবে দল সাজিয়েছেন। এই নতুন সাজানোর বিএনপি-জামায়াতকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করা হয়েছে অথবা নীরবে লুটপাটে মনোযোগী, আদর্শে নয়। যারা দীর্ঘদিন কাজ করেছেন তারা পাশে নেই অথবা আউট। অনেক এলাকায় গেলে দেখবেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজন নাম ধরে ধরে বলবেন, এমপি জামায়াত-বিএনপি থেকে টাকার বিনিময়ে কাদের এনেছেন, স্থানীয় সরকারে মনোনয়ন দিয়েছেন। এমনও শুনেছি, নামডাক আছে তার, মেয়র নমিনেশনের জন্য একজন থেকে দু’কোটি নিয়েছেন। একথা শুনে আরেকজন এক কোটি বাড়িয়ে দিলেন। নমিনেশন তিনিই পেলেন যিনি দু’কোটি দিয়েছিলেন তিনি টাকাও ফেরত পাননি। আসলে, স্থানীয় পর্যায়ে নতুন নবাবরাই দলের সব নিয়ন্ত্রণ করেন। দলের স্থানীয় নেতার কোন ক্ষমতা নেই। এভাবে, অগোচরে আওয়ামী লীগে একটা পরিবর্তন এসেছে যা কেন্দ্র অবগত নয়। কেন্দ্রে যারা আছেন শোনা যায় তাদের অনেকে নমিনেশন বাণিজ্যে যুক্ত। সম্পাদক/যুগ্ম/সাংগঠনিক বা বিভিন্ন সম্পাদক গত তিন বছরে কয়টি জেলা সফর করে খোঁজখবর নিয়েছেন? দলনেত্রী কিছু জানেন না তা তো নয়। কিন্তু তার করার কিছু নেই। কেননা দলীয় নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গিই বদল হচ্ছে। যে কারণে, মাঠপর্যায়ে সে রমরমা অবস্থা এখন আর নেই। চলবে...
×