ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

যুগশ্রেষ্ঠ মহা মনীষী আল ফারাবী

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২১ অক্টোবর ২০১৬

যুগশ্রেষ্ঠ মহা মনীষী আল ফারাবী

৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর দর্শন জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী আবূ নসর মুহম্মদ আল ফারাবী দামেস্কে ইন্তেকাল করেন। দার্শনিক ছাড়াও তিনি চিকিৎসাবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, কবি হিসেবে মশহুর ছিলেন। পাশ্চাত্য জগতে তিনি আলফারাবিয়াস বা এ্যাভেননসর বলে পরিচিত হন। জ্ঞানের রাজ্যে তিনি এমন এক আলোকবর্তিকা প্রজ্বলিত করেন যা তাকে জগতজুড়ে খ্যাত করে দেয়। তাকে মুআল্লিম আসসানী খিতাবে ভূষিত করা হয়। মুআল্লিম আসসানী অর্থ দ্বিতীয় শিক্ষক। মুআল্লিম আউয়াল অর্থাৎ প্রথম শিক্ষক বলতে বোঝানো হয় গ্রীক মনীষী এরিস্টোটল। এতেই বোঝা যায় আল ফারাবীর মর্যাদা জ্ঞানরাজ্যে কত সমুন্নত। আল ফারাবী আনুমানিক ৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি স্থানের ফারাব নগরীর ওয়াসীজ মহল্লার এক সেনা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আব্বাসীয় খলিফার তুর্কি দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান ছিলেন। আল ফারাবী যে বছর জন্মগ্রহণ করেন সেই বছরে আব্বাসীয় খিলাফতের ত্রয়োদশ খলিফা মুতাজবিল্লাহ রাজধানী সামারা নগরীতে তুর্কি সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন এবং এই বছরেই আব্বাসীয় চতুর্দশ খলিফা মুহতাদি বিল্লাহ খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এই বছরেই হাদিস শরীফ সঙ্কলক ইমাম আবূ মুহম্মদ আল দারামী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ইন্তেকাল করেন। এরই পরবর্তী বছর ৮৭০ খ্রিস্টাব্দে কুরআন মজীদের পরেই যে গ্রন্থের উল্লেখ করা হয় সেই হাদিস শরীফ গ্রন্থ বুখারী শরীফের সঙ্কলক ইমাম আবদুল্লাহ মুহম্মদ ইসমাইল বুখারী রহমাতুল্লাহি আলায়হি মাত্র ৬২ বছর বয়সে সমরখন্দ নগরে ইন্তেকাল করেন। আল ফারাবী যে ফারাব নামক অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন সেই ফারাব সম্পর্কে জানা যায় যে, এককালে ফারাবে বহু জ্ঞানী-গুণীর জন্ম হয়। সির দরিয়া ও আরিস নদী যে স্থানটিতে মিলিত হয়েছে তুর্কিস্তানের সেই জায়গাটিতেই ফারাব অবস্থিত। আল ফারাবী নিজের নামের সঙ্গে ফারাবী আল তুর্কি পদবি ব্যবহার করতেন। আল ফারাবীর লেখাপড়ার সূচনা হয় ফারাবেই। এখানে নানা বিষয়ে পা-িত্য অর্জনের পর তিনি কিছুকাল বুখারায় কাজী পদে নিযুক্ত থেকে বিচারকার্যে প্রভূত পারদর্শিকতার স্বাক্ষর রাখেন। ছোটবেলায় একবার বাগদাদ শরীফে পিতার কর্মস্থলে তিনি এসেছিলেন। কিছুকাল বুখারায় কাজীর দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় তার অন্তরে আরও জ্ঞান অর্জনের তাকীদ প্রবলভাবে দেখা দেয়। তিনি কাজীর দায়িত্ব ত্যাগ করে বাগদাদ শরীফে চলে আসেন। বাগদাদ সেকালের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ছিল। এই বাগদাদ যেমন ছিল খিলাফতের রাজধানী, তেমনি ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রস্থল। এখানে এসে তিনি বিভিন্ন ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে প্রথমে পা-িত্য লাভের জন্য ব্যাপক পড়াশোনা করেন। আরবী, গ্রীক ও লাতিন ভাষায় রীতিমতো গভীর পা-িত্য অর্জন করেন। তিনি আবূ বিশর মারতা ইবনে ইউনুস নামের এক বিখ্যাত অনুবাদক ও ভাষ্যকারের কাছ থেকে এরিস্টোটলের দর্শন ও তর্কবিদ্যা অধ্যয়ন করেন। এই আবূ বিশর মাততা ইবনে ইউনুসের ৯৪০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু হয়। আল ফারাবী প্রায় সত্তরটি বিশাল নোটবইয়ে দর্শনবিদ্যার সারসংক্ষেপ লিখে এক পরিশ্রমী জ্ঞান আহরণকারী হিসেবে নতুন আদর্শ স্থাপন করেন। তিনি আবূ বকর ইবনে সররাজের কাছ থেকে ভাষাতত্ত্ব¡ ও ব্যাকরণ বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। আল ফারাবী জ্ঞান রাজ্যের প্রতিটি শাখায় অবাধে বিচরণ করেন। তিনি বহু ভাষাবিদ ছিলেন। কমপক্ষে ৮টি ভাষার ওপর তার অগাধ পা-িত্য ছিল। অঙ্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিদ্যা, চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রভৃতি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর তার মৌলিক জ্ঞান ছিল। দর্শনের ওপর তিনি যে সমস্ত শিক্ষকের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ইউহান্না ইবনে হায়লান। আল ফারাবী জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করলেও প্রধানত তিনি দার্শনিক। আর এক মনীষী ইবনে খালিকান আল ফারাবীর জ্ঞানের পরিধি নির্ণয় করতে গিয়ে বলেন : ফারাবী একজন বিশ্বস্ত জ্ঞানপাঠক ছিলেন। তিনি এরিস্টোটলের লেখা আত্মা বিষয়ক লেখাটি এক শ’রও বেশিবার পাঠ করেন এবং এরিস্টোটলের পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ক লেখাটি চল্লিশেরও অধিক বার পড়েন। এ তথ্য থেকেই এটা বোঝা যায় যে, আল ফারাবীর জ্ঞানের স্পৃহা ও জ্ঞান লাভের পিপাসা অত্যন্ত গভীর ছিল। আল ফারাবী দর্শন চর্চার বিভিন্ন স্তর ও পাঠ্যক্রম বিন্যাস করেন। তিনি মনে করতেন অলঙ্কারশাস্ত্র ও কাব্য সত্যকে অনুধাবন করার সহজতর মাধ্যম। আল ফারাবী চল্লিশ বছরেরও অধিককাল অর্থাৎ ৯০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৯৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাগদাদে ছিলেন। এই সময়ে তিনি এরিস্টোটলের তর্কশাস্ত্র ও দর্শনশাস্ত্রের বিস্তৃত ভাষ্য রচনা করেন। বাগদাদ অবস্থানকালে তিনি বেশ কয়েকজন আব্বাসীয় খলিফার শাসন আমল প্রত্যক্ষ করেন। এই খলিফারা হচ্ছেন : আব্বাসীয় ষোড়শ খলিফা মুতাজিদ বিল্লাহ (মৃত্যু ৯০২ খ্রিস্টাব্দ) আব্বাসীয় সপ্তদশ খলিফা মুকতাফী বিল্লাহ (মৃত্যু ৯০৮ খ্রিস্টাব্দ), অষ্টাদশ খলিফা মুকতাদির বিল্লাহ (তিনি তার স্ত্রীর ষড়যন্ত্রে এক বিদ্রোহী বারবারের হস্তে ৯৩২ খ্রিস্টাব্দে নিহত হন), ঊনবিংশ খলিফা কাহির বিল্লাহ (নিহত ৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ), বিংশ খলিফা আল রাজিবিল্লাহ (মৃত্যু ৯৪০ খ্রিস্টাব্দ)। বাগদাদের খিলাফতের ঘন ঘন খলিফা বদলের ফলে সেখানে অরাজকতা ও গোলযোগের নিত্য নতুন অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই পরিবেশে তিনি বাগদাদে থাকাটা সমীচীন মনে করলেন না। যে কারণে তিনি তার জন্মভূমি তুর্কিস্তানে চলে আসেন এবং সেখানকার শাসক আল সামানের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। আল সামান তাকে একটা গ্রন্থ রচনায় উদ্বুদ্ধ করেন। তখন ফারাবী একটি উপদেশমূলক গ্রন্থ রচনা করেন, যার নাম আল-তালিমুল সানী। এই গ্রন্থের নাম তালিমুল সানী অর্থাৎ দ্বিতীয়ের তালিম হওয়ার কারণ ছিল আল ফারাবীকে বলা হতো মুআল্লিম সানী বা দ্বিতীয় শিক্ষক। তিনি জন্মভূমি তুর্কিস্তানে কিছুদিন অবস্থান করে আবার বের হন জ্ঞানের সন্ধানে। চলে আসেন সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে। দামেস্কের শাসনকর্তা আকশীদ তাতার তাকে অভ্যর্থনা জানান। দামেস্কে কিছুদিন অবস্থান করে তিনি মিসর গমন করেন। মিসর পরিভ্রমণ সমাপ্ত করে তিনি সিরিয়ার আলেপ্পো নগরীতে বসবাস করতে থাকেন। ৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে আমির সায়ফুদৌলা সিরিয়ার শাসককে পরাজিত করে সিরিয়ার শাসক হন এবং আলেপ্পোতে রাজধানী স্থাপন করেন। আলেপ্পো অল্পদিনের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়। আল ফারাবী একদিন সায়ফুদ্দৌলার দরবারে উপস্থিত হলে তিনি ফারাবীকে বিপুল সংবর্ধনা জানান। তিনি সায়ফুদ্দৌলার কাছে শুধু একটু মাথা গোঁজার মতো ঠাঁই এবং প্রতিদিন খাওয়া পরার জন্য মাত্র চার দিরহাম বরাদ্দের জন্য আবেদন করেন। সায়ফুদ্দৌলা সঙ্গে সঙ্গে তা মঞ্জুর করেন। ৯৫০ খিস্টাব্দে সায়ফুদ্দৌলা দামেস্কে অভিযান পরিচালনা করেন। সঙ্গে ছিলেন আল ফারাবী। বয়সের ভারে ন্যুব্জ আল ফারাবী দীর্ঘ পথ চলার এই ধকল সইতে পারলেন না। দামেস্কে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই ৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর এই শীতিপর জ্ঞানতাপস আবূ নসর মুহম্মদ আল ফারাবী পৃথিবীর ওপরে পাড়ি জমালেন। তাকে দাফন করা হলো অত্যন্ত আড়ম্বরের সঙ্গে দামেস্কের বাবুল সগীর এলাকার গোরস্তানে। এখানেই দাফন করা হয়েছিল উমাইয়া খলিফা হযরত আমির মুআবিয়া রাদিআল্লাহ তায়ালা আনহুকে। আল ফারাবী শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা। তিনি আরবী ভাষায় তার গ্রন্থাবলী রচনা করেছিলেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ভাষায় সে সব অনূদিত হয়েছে। তিনি বিশ্বের সেরা দার্শনিকদের অন্যতম। তিনিই সর্বপ্রথম ইসলামী বিশ্বকোষ রচনা করেন। ফারাবী মনে করতেন জ্ঞান বুদ্ধিপ্রসূত নয়, জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে মানবাত্মার চরম উৎকর্ষের মধ্য দিয়ে। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নতুন ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি আন্তর্জাতিকতাবাদের নতুন ব্যাখ্যায় বলেছিলেন যে, সমগ্র পৃথিবী একটি রাষ্ট্র। তিনি অখ- পৃথিবীর ধারণা পোষণ করতেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে তিনি কয়েকখানি গ্রন্থ রচনা করেন। যেমন : সিয়াসাতুল মাদানীয়, আরাউয়াল আহলিল মাদানিতুল ফাযিলাহ, জওয়ামিনুস সিয়াসাত, ইজতিমাউ মাদানিয়া। তার লেখা ফুসুসুল হিকাম দার্শনিক মহলে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। আল ফারাবীর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : আল-তামবীহ আলা সাবীলিস সা’আদা, আল জামা’আ বায়নার রায়ায়ি আল হাকীম আফলাতুন আল-ইলাহী ওয়া আরিসতুতালিস জওয়ার মাসাইল সুইলা আনহা। আল ফারাবী জ্ঞান রাজ্যে এমন নতুন মাত্রা সংযোজন করেন যা পাশ্চাত্যে মনীষীদের তাক লাগিয়ে দেয় এবং তারা নির্দ্বিধায় আল ফারাবীকে নতুন চিন্তা রাজ্যের অগ্রপথিক হিসেবে গণ্য করেন। তিনি বলেন : গাছের সার্থকতা যেমন ফল ধারণে তেমনি নৈতিকতার সার্থকতা পরম শান্তি লাভে, অতএব চরম ও পরম শান্তি লাভের একমাত্র পথ ক্রমাগত সৎ জীবনযাপনে। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশনস বাংলাদেশ
×