ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাবি হলের নর্দমা থেকে ছাত্রের রক্তাক্ত বিবস্ত্র লাশ উদ্ধার

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২১ অক্টোবর ২০১৬

রাবি হলের নর্দমা থেকে ছাত্রের রক্তাক্ত বিবস্ত্র লাশ উদ্ধার

স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী/রাবি সংবাদদাতা ॥ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) নবাব আব্দুল লতিফ হলের পেছনের নর্দমা থেকে মোতালেব হোসেন লিপু নামে এক ছাত্রের রক্তাক্ত-বিবস্ত্র লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে হলের নিচতলায় ডাইনিংয়ের পাশের নর্দমায় ওই শিক্ষার্থীর লাশ পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে এ ঘটনাকে হত্যাকা- বলে মনে করছে পুলিশ। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই ছাত্রকে আটক করেছে পুলিশ। নিহত লিপু গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি নবাব আব্দুল লতিফ হলের ২৫৩ নম্বর রুমে থাকতেন। তিনি ঝিনাইদহের হরিণাকু-ু থানার মুকিমপুর গ্রামের বদরউদ্দিনের ছেলে। রাজশাহী মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (পূর্ব) আমীর জাফর বলেন, মাথায় বড় ধরনের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। প্রাথমিকভাবে সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে তাকে খুন করা হয়েছে। ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক জানিয়েছেন তার বুকের পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে গেছে। হত্যার পর উঁচু স্থান অথবা ছাদ থেকে লাশ নিক্ষেপ করা হয়ে থাকতে পারে। রিনা নামে হলের এক ডাইনিং কর্মচারী বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল আটটায় ঝাড়ু দেয়ার জন্য উত্তরদিকের গেটের তালা খুলে ডাইনিংয়ে ঢোকার পর বাইরে তাকিয়ে দেখেন ড্রেনের মধ্যে লুঙ্গিপরা একটি ছেলের লাশ। সঙ্গে সঙ্গে হলের অন্য কর্মচারীদের তিনি বিষয়টি অবহিত করেন। রাবির লতিফ হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক বিপুল কুমার বিশ্বাস বলেন, হলের ডাইনিংয়ের পাশের নর্দমায় প্রথম লাশটি পড়ে থাকতে দেখেন হলের কর্মচারীরা। পরে তারা জানালে পুলিশকে খবর দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মজিবুল হক আজাদ খান বলেন, খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোরিয়াল বডির সদস্য ও পুলিশ এসে তার লাশ উদ্ধার করে। ঘটনাটি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে তদন্ত করার বিষয়ে পুলিশ প্রশাসনকে আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দু’শিক্ষার্থীকে নিয়ে গেছে পুলিশ। এরা হলো লিপুর রুমমেট মনিরুল ইসলাম ও পাশের কক্ষের ছাত্র প্রদীপ কুমার বিশ^াস। লিপুর মোবাইলফোনের সিম প্রদীপের কাছ থেকে জব্দ করে পুলিশ। আটকের আগে ২৫৩ নম্বর রুমে থাকা লিপুর রুমমেট মনিরুল ইসলাম জানান, রাত ১২টার দিকে ঘুমানোর জন্য তিনি রুমের লাইট বন্ধ করে দিতে বলেন। এরপর ১২ টা ৪৫ পর্যন্ত টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়াশোনা শেষ করে আমিও ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে উঠে দেখি রুমের দরজা খোলা। এরপর সবার চেঁচামেচি শুনে বাইরে গিয়ে দেখি আমার রুমমেটের লাশ পড়ে আছে। ও প্রতিদিন সকালে হাঁটতে বের হতো। কিন্তু পরনে তো প্যান্ট কিংবা গেঞ্জিও নেই। সরেজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে হলের নিচতলায় ডাইনিংয়ের পাশের নর্দমায় প্রায় বিবস্ত্র লাশটি পড়ে থাকতে দেখা যায়। হলের উত্তর দিকের কর্মচারীদের যাতায়াতের গেটটি বাইরে থেকে তালাবদ্ধ ছিল। এছাড়া ডাইনিংয়ের ভেতর দিয়ে যেখানে লাশটি পড়ে আছে সেই রাস্তাও তালাবদ্ধ ছিল বলে জানিয়েছেন হলের কর্মচারীরা। লাশ ড্রেনের ভেতরে কাদাপানিতে পড়েছিল। মাথায় আঘাতের চিহ্ন। ছোপ ছোপ রক্তে মেখে গেছে কপাল। পরনে লুঙ্গিটি অগোছালো অবস্থায় কাদায় মাখা আর রক্তশূন্য মুখ। রাতে হলের ছাদে যাওয়ার গেটটি ছিল তালাবদ্ধ। লাশ ওখানে কিভাবে পৌঁছল তা এখনো রহস্যেঘেরা। এদিকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডাঃ এনামুল হক ময়নাতদন্ত সম্পন্নের পর জানিয়েছেন, লিপুর মাথায় গভীর ক্ষত রয়েছে। বুকের পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে গেছে। তাকে পরিকল্পিত হত্যার পর ছাদ কিংবা উঁচু স্থান থেকে নর্দমায় নিক্ষেপ করা হয়ে থাকতে পারে। হত্যার নেপথ্যে সন্দেহ জালিয়াত চক্র ॥ গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী লিপু কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না বলে জানিয়েছেন তার সহপাঠীরা। তবে গত বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে গিয়ে মহানগরীর রাজপাড়া থানা পুলিশ আটক করে লিপুকে। মাসতিনেক জেলহাজতে থাকার পর জামিনে মুক্তি পায় লিপু। নাম প্রকাশ না করার শর্তে লিপুর কয়েক সহপাঠী জানান, একটি জালিয়াত চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে পরীক্ষায় প্রক্সি দেয়ার প্রস্তাবে রাজি হয় লিপু। কিন্তু পরীক্ষা দিতে গিয়ে গ্রেফতার হওয়ায় পূর্বশর্ত অনুযায়ী টাকা তাকে দেয়নি জালিয়াত চক্রটি। এ ঘটনার পরে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষায় তিনটি বিষয়ে অকৃতকার্য হয় লিপু। সহপাঠীদের ধারণা, প্রক্সির টাকা নিয়ে ওই চক্রের সদস্যদের সঙ্গে দরকষাকষি চলছিল লিপুর। টাকাপয়সার লেনদেন কিংবা চক্রের সদস্যদের পরিচয় ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা ঘটতে পারে এ হত্যাকা-। বুধবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে রুমমেটকে রাবির মাদার বক্স হলে নোট নেয়ার কথা বলে বের হলেও ওই হলের কোন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করেননি লিপু। রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি ড. প্রদীপ কুমার পা-ে বলেন, নিহত শিক্ষার্থীর ময়নাতদন্ত শেষে বিকেল চারটায় রাবির কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে তার পরিবারের সদস্যদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। খুনীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা, ঝিনাইদহ থেকে জানান, অভাবের সংসার অনেক কষ্ট করে রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে লেখাপড়া করছিলেন মোতালেব হোসেন লিপু। বাবা-মা, ভাইবোন সবার ইচ্ছে ছিল লিপু সাংবাদিক হবে। তাদের সেই ইচ্ছে পূরণ হলো না। সন্তানের মৃত্যুর খবর পেয়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে পরিবারসহ সারা গ্রামে। ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার মুকিমপুর গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। শান্ত, নিরীহ প্রকৃতির ছেলে মোতালেব হোসেন লিপু। তার কোন শত্রু নেই। তার এই মৃত্যুর খবর কেউই মেনে নিতে পারছেন না। ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার মুকিমপুর গ্রামের বদরউদ্দিনের ছেলে মোতালেব হোসেন লিপু। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করতেন। তারা দুই ভাই এক বোন। লিপু বড়, ছোট ভাই লিয়নের বয়স ৩, বোন লিমা বঙ্গবন্ধু কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রী। সন্তানের মৃত্যুর খবর পেয়ে পিতা ছুটে গেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। লিপুর মা হোসনেয়ারা বলেন, লিপু পুজোর ছুটি কাটিয়ে গত মঙ্গলবার বাড়ি থেকে ৪ হাজার টাকা নিয়ে ফর্ম ফিলাপ করার কথা বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। বৃহস্পতিবার ছেলের মৃত্যুর খবর জানতে পারেন তারা। তিনি বলেন, অভাবের সংসার; তার পরও অনেক কষ্ট করে ছেলেকে লেখাপড়া করাচ্ছিলেন। আশা ছিল, ছেলে বড় সাংবাদিক হবে। সে আশা পূরণ হলো না তাদের। বাড়িতে সাংবাদিক দেখে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তার দাবি, লিপুর এভাবে মৃত্যু হতে পারে না। তিনি মৃত্যুর কারণ উদঘাটনের দাবি জানান। বোন লিমা বলেন, আমার ভাই আমাকে ঢাকায় পড়াতে চেয়েছিলেন। তাকে নিয়ে আমাদের কত স্বপ্ন। সব শেষ হয়ে গেল। এখন আমাদের কে দেখবে? লিপুর নানা জামালউদ্দিন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। কথা বলতে পারছেন না। মামাত ভাই সাজ্জাদ হোসেন সোহেল বলেন, খুব কষ্ট করে তাদের সংসার চলে। পিতা বদরউদ্দিন পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে ট্রাক চালকের কাজ করেন। যা রোজগার হয় কোন রকমে সংসার চলে। ছেলে লেখাপড়া শেষ করে সংসারের হাল ধরবেন। কিন্তু তাদের সব আশাই ছাই হয়ে গেল। লিপুর গ্রামের বন্ধু হিমেল, সাইদ ও অনি বলেন, লিপু খুব সরল একটা ছেলে। সে ড্রেনের ভেতর মরে থাকতে পারে না। এটা অস্বাভাবিক। তারা বন্ধুর মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটনের দাবি জানান। তারা বলেন, হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে। গ্রামের বাসিন্দা মকছেদ আলী বলেন, গরিবের ছেলে লিপু। সে পড়াশোনা নিয়েই থাকে। কোন রাজনীনীতি করে না। কারো সঙ্গে ঝগড়াবিবাদ নেই। কেন এমন হলো। আমি এ মৃত্যুর কারণ উদঘাটনের দাবি করছি। লিপুর মৃত্যুতে হরিণাকু-ুর মুকিমপুর গ্রামবাসী হতবা। সবার দাবি, মৃত্যুর কারণ উদঘাটন করে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার করা হোক। এদিকে রাবি শিক্ষার্থী মোতালেব হোসেন লিপুর মৃত্যুর ঘটনায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নগরীর মতিহার থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। মতিহার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হুমায়ুন কবির বলেন, নিহত লিপুর চাচা বশির বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের আসামি করে থানায় হত্যা মামলাটি দায়ের করেন।
×