ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

নদ্দিউ নতিম

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ২০ অক্টোবর ২০১৬

নদ্দিউ নতিম

সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী বর ডিলানের নামকরণ যেমন তার পিতৃদত্ত নাম নয়, ঠিক তেমনি একক প্রচেষ্টায় তিনি যে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছালেন তাও না। বাবা-মায়ের দেয়া নাম রবার্ট আলেন জিমারম্যার। কবিতা পড়তে গিয়ে ভাল লেগে যাওয়া ইংরেজ কবির নাম ডিলান টমাস।অত:পর নিজেই নিজের নামকরণ করলেন বব ডিলান। বব ডিলান বব ডিলান হয়ে ওঠার পথে পেলেন জন হ্যামন্ডেরকে, যিনি তার মেধাকে মূল্যায়ন করেছিলেন। লু লেভিকে যিনি বলেছিলেন, তুমি তোমার সময়ের গান গাইবে। পেলেন আর্টি মগুলকে যিনি বলেছিলেন, এখন থেকে তুমি শুধু লিখবে। পেলেন পারভিস স্ট্যাপলর্সকে যে বলেছিলেন, তুমি তোমার বুদ্ধিতে গাইবে। পেলেন বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত ও আধুনিক সঙ্গীতের ফিউশানের মতো সঙ্গীতশিল্পী মমতাজ বেগমরূপী জোয়ান বায়েজকে যিনি তার নির্ধারিত শ্রোতার সামনে তুলে ধরলেন বব ডিলানকে আর আত্মায় প্রবৃষ্ট করে দিলেন আমেরিকান লোকসঙ্গীতের আবহমান ধারাকে। নিজের যোগ্যতা আর এ রকম অসংখ্য ব্যক্তি আর সংগঠনের সাহচর্যে পুষ্টি লাভ করেই তো মার্কিন কবি-গীতিকার ও গায়ক বব ডিলান আজকের নোবেল বিজয়ী বব ডিলান। আর সে কারণে বিগত সময়ে তার উচ্চারিত সংলাপই আজ হয়ে ওঠে নবপ্রজন্মের দিকনির্দেশনা, ‘আমি হয়ে ওঠা ছাড়া আমার পক্ষে আর কিছুই করা সম্ভব নয়, তাই আমিটা যা-ই হোক না কেন।’ আমিত্বের বিজয় গাথায় স্ট্রাগেল যেমন সত্য বব ডিলানের জীবনে, তেমনি সত্য তার অর্জিত বিজয়। কিন্তু এমনতো হয় যোগ্য কবিত্বসত্তা নিয়েও সম্পাদক-প্রকাশকদের অবিবেচনার কারণে কেউ একজনের জীবনে কবি হয়ে ওঠা হলো না। প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় আবৃত্তি শিল্পীরা তার কাব্য জনসমক্ষে আবৃত্তির মাধ্যমে তুলে ধরল না বলে কবির স্বীকৃতি পেল না সে । স্বীকৃতির সিন্ডিকেট প্যানেলের সহযোগিতা না পেয়ে কবিসত্তার আমিত্ব নিয়ে হারিয়ে গেল কবি অতলেই । আবার সেই হারিয়ে যাওয়া কবি তার আমিত্বকে বিসর্জন দিয়ে তুমিত্বে অবগাহন করে বিদেশী উজবেকীয় কবির ছদ্মাবরণে ফিরে এল সম্পাদক-প্রকাশকদের সুনজর পেয়ে। আবৃত্তি শিল্পীদের পরিবেশনার মধ্যে দিয়ে। পেঙ্গুইনের মতো আন্তর্জাতিক প্রকাশনায় প্রকাশিত হওবার গৌরব নিয়ে। এই কবি এক কাল্পনিক চরিত্র, যার নাম মতিন উদ্দিন। সাহিত্যের যাত্রা পথে স্বনামে-স্বগৃহে পরিত্যক্ত অথচ উজবেক কবি নদ্দিউ নতিম নামে পরদেশী হয়ে-পরবাসী হয়ে সেই একই গৃহে সকলের দ্বারা আদৃত। একজন কবির বিকাশ ও প্রকাশের প্রহসন-প্রহেলিকা আর বাস্তবতার টানাপোড়েনের মঞ্চনাটক ‘নদ্দিউ নতিম।’ হুমায়ূন আহমেদের ‘কে কথা কয়’ উপন্যাস অবলম্বনে কবি-নাট্যকার-নির্দেশক ও অভিনেতা আসাদুল ইসলামের নাট্যরূপ ও নির্দেশনায়, ম্যাড থেটার প্রযোজিত নাটক ‘নদ্দিউ নতিম’ মঞ্চস্থ হলো গত ১৫ অক্টোবর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে, দলটির এক বছর পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে। পাশাপাশি বন্ধুর পথে বন্ধুরা শিরোনামে চলতি পথের শুভনাধ্যায়ীদের বরণ করে নেয়া হলো মঞ্চায়নের সমাপ্তিক্ষণে। শুরু থেকে সমাপ্তিক্ষণের দূরত্ব পথে অভিনেতা আসাদুল ইসলামের মতিন উদ্দিন ও নদ্দিউ নতিম চরিত্রদ্বয়ের বহুমাত্রিক চরিত্র বৈশিষ্ট্য অন্বেষণে রূপকল্প ও দৃশ্যকল্পের যে অবতারণা, তা এক কথায় সারল্য-বলিষ্ঠ ও নান্দন্দিকতায় মূর্তর মাঝে বিমূর্ততা। হুমায়ূন আহমেদের কল্পিত চরিত্র মুনাকে তুলে ধরতে বাহ্যত যে আভিজাত্য আর অন্তর্নিহিত যে মেজাজটা দরকার, তা ষোলো আনা নিয়েই মঞ্চে উপস্থিত মঞ্চের রূপবতীখ্যাত অভিনেত্রী সোনিয়া হাসান। অপরদিকে শারীরিকভাবে ২১ বছর বয়সী কিন্তু মানসিক বুদ্ধি বিবেচনায় ১৫ বছর বয়সী সিয়ামুল করিম অটিস্টিক হয়েও ব্রিটিশ কাউন্সিলের অধীনে এ বছর এ লেভেল পরীক্ষা দিয়ে যেমন ইতিহাস গড়লেন, অপর অটিস্টিক শিশুদের সাহস যোগালেন অনেকটা; তেমনি কমলরূপী অটিস্টিক শিশু চরিত্রে শিশুশিল্পী আর্য মেঘদূতের অভিনয় সেই অটিস্টিক শিশুর অভিভাবকদের সাহসের জায়গায় পৌঁছে দেয়, যেখান থেকে উপলব্ধি হয়, তাদের কিছু ঘাটতি নেই, বরং বাড়তি মাপার সঙ্গতি চাই। যথার্থকে যথার্থভাবে চিনিয়ে দেয়ার নাটক নদ্দিউ নতিম মানুষের বিবেচনাকে জাগ্রত করতে শেখায় বৈকি।
×