ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আকিল জামান ইনু

সাহিত্যে নোবেলজয়ী মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু বব ডিলান সঙ্গীতের কবি

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ২০ অক্টোবর ২০১৬

সাহিত্যে নোবেলজয়ী মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু বব ডিলান সঙ্গীতের কবি

বিশ্বের সব সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় বইছে। সবাই সরব। যাকে কেন্দ্র করে এই ঝড়, কেবল তিনিই নীরব। তিনি বব ডিলান। এ বছর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন। ১৯০১ থেকে প্রচলিত ১০৯ বার প্রদত্ত পদকপ্রাপ্ত ১১৩ জনের তালিকায় এ বছর যোগ হলো নতুন নাম বব ডিলান। বব ডিলান যেন এক ঝড়ের নাম। তার বাণী গত ছয় দশক ধরে ঝড় তুলেছে প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের মনোজগতে। রাষ্ট্রীয় অন্যায়, সামাজিক বৈষম্য, আর যুদ্ধবিরোধী তার কণ্ঠ ঝড় তোলে প্রতিবাদের। তার বাণী মানুষকে মনে করিয়ে দেয় মানবিক ঠিকানা। তিনি ঝড় তোলেন ফ্যাশনে কিংবা বিজ্ঞাপনে। বলাবাহুল্য, তার গান আর গানের সঙ্গে একাত্ম দেহভঙ্গিমা ঝড় তোলে লাখো কোটি অনুরাগীর মনে। বব ডিলান- শিল্পীদের শিল্পী। কবিদের কবি। এক জীবন্ত কিংবদন্তি। জন্ম ২৪ মে ১৯৪১। পৈত্রিক নাম রবার্ট এলেন জিমারম্যান (হিব্রু নাম সাবটাই জিসি বেন আব্রাহাম)। জন্মস্থান ভুলথ, মিনেসোটা। ১৯৫৯ এ ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটায় ভর্তি হন। ইউনিভার্সিটি থেকে কয়েক ব্লক দূরে ‘টেন ও ক্লক স্কলার’ নামক কফি হাউসে পারফর্মেন্সের মাধ্যমে ১৯ বছর বয়সে সঙ্গীত জীবনের শুরু। এরপর ডিলান পেরিয়েছেন অনেক পথ। বর্তমানে তার স্টুডিও এ্যালবামের সংখ্যা ৩৭। লাইভ এ্যালবাম ১১টি আর সিঙ্গেলসের সংখ্যা ৫৮। এ ছাড়াও রয়েছে সংগৃহীত ও যৌথ প্রযোজনার কিছু এ্যালবাম। প্রাপ্ত পুরস্কারের তালিকাটি বিশাল। ১২ বার পেয়েছেন গ্রামী এ্যাওয়ার্ড। ২০০০ সালে জিতে নেন একাডেমি এ্যাওয়ার্ড। ২০০১-এ গোল্ডেন গ্লোব এ্যাওয়ার্ডস। রক এ্যান্ড রোল হল অব ফেমে ঠাঁই করে নেন ১৯৮৮তে। অর্জিত সম্মান ১৯৬৩তে টম পেন এ্যাওয়ার্ড। ১৯৭০ ও ২০০৪ এ যথাক্রমে প্রিন্সটন ও সেন্ট এন্ড্রু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান সম্মানসূচক ডক্টর অব মিউজিক। ২০০৮-এ লাভ করে বিশেষ পুলিৎজার। ২০১২তে লাভ করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান প্রেসিডেনসিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম। ২০১৩তে লাভ করেন ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ফ্রেঞ্চ লিজিয়ন অফ অনার। প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ছয়। টারানটুলা প্রথম গ্রন্থ, রচনাকাল ১৯৬৫-৬৬। গবেষণামূলক গদ্য ও পদ্যের সংগ্রহ। লেখায় জ্যাক কেরুয়াক, ইউলিয়াম এস বুরোস ও এলেন গীনসবার্গের প্রভাব স্পষ্ট। এ-৪ কাগজে প্রথম প্রকাশ মাত্র ৫০ কপি। এরপর ১৯৭১-এ অফিসিয়াল প্রকাশের আগ পর্যন্ত কালোবাজারে ব্যাপক বিক্রি হয়। অনূদিত হয়েছে ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, রোমানিয়ান, ক্রোয়েশিয়ান ও চেক ভাষায়। ১৯৭৩-এ প্রকাশিত হয় রাইটিং এ্যান্ড ড্রয়িং। ৫ অক্টোবর, ২০০৪-এ প্রকাশিত হয় তার আত্মজীবনীর প্রথম অংশ ক্রনিকলস ভলিউম-১। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩০৪। তার আঁকা ছবি প্রদর্শিত হয়েছে পৃথিবীর প্রায় সব বড় গ্যালারিতে। ডিলানের চরিত্রের ব্যাপ্তি বোঝাতে তার ওপর নির্মিত চলচ্চিত্রের কথা না বললেই নয়। টড হেইনস পরিচালিত ‘আইএম নট দেয়ার’ মুক্তি পায় আগস্ট ২০০৭-এ। যার ট্যাগ লাইন ছিল, ওহংঢ়রৎবফ নু ঃযব সঁংরপ ধহফ সধহু ষরাবং ড়ভ ইড়ন উুষধহ.’ তার চরিত্রের বহুমুখিতা ফুটিয়ে তুলতে প্রয়োজন হয়েছে ছয়জন অভিনেতার- ক্রিশিয়ান বেল, কেট ব্ল্যাঙ্কেট, মার্কাস কার্ল ফ্রাঙ্কলিন, রিচার্ড গিয়ার, হিথ লেজার ও বেন ইউশহ। তাঁর ‘টুগেদার থ্রু লাইফ’ (এপ্রিল ২৪, ২০০৯) তাকে দিয়েছে সবচেয়ে বেশি বয়স্ক (৬৭) শিল্পী হিসেবে ইউএস চার্টের শীর্ষে অবস্থানের সম্মান। তার প্রথম এ্যালবামটি প্রকাশিত হয় মার্চ ১৯, ১৯৬২তে। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কলম্বিয়া রেকর্ডসের ব্যানারে ১১টি ফোক, এর পাশাপাশি মাত্র দুটো মৌলিক গান নিয়ে। ‘টেকিং নিউইয়র্ক’ এবং ‘সং টু উডি’। সং টু উডি লেখা ডিলানের অনুপ্রেরণার উৎস উডি গুথ্রিকে উদ্দেশ্য করে। এ্যালবাম মুক্তির পর তার কনসার্ট ও প্রথম টেলিভিশন উপস্থিতি ১৯৬৩-তে। প্রথম এ্যালবামের বিক্রি সংখ্যা প্রায় ২৫০০। তার শুরুর কণ্ঠ শুনে জ্যাকব কারল ওটস লিখেছেনÑ ‘ড্রামাটিক এবং ইলেকট্রিফায়িং’ যা এখনও সমান প্রাসঙ্গিক। দ্বিতীয় এ্যালবামে তার পরিচয় উল্লিখিত হয় সঙ্গীত রচয়িতা ও গায়ক। তা তাকে দেয় নতুন মাত্রা। ১৯৬৩-এর মে ২৭-এ প্রকাশিত এই এ্যালবামে ডিলান প্রশ্ন তোলেন সামাজিক ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিয়ে। হয়ে ওঠেন প্রতিবাদের প্রতীক জেনেট মসলিন লেখেন, ‘এই এ্যালবামের গানগুলো তাকে পরিণত করে তার প্রজন্মের কণ্ঠস্বরে।’ প্রথম বৈদ্যুতিক বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেন ১৯৬৫-এর মার্চের শেষে তার এ্যালবাম, ‘ব্রিংগিং ইট অল ব্যাক হোম’-এ। এ্যালবামের গানগুলো ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে বিট প্রজন্মের কবিতাকে। তৃতীয় এ্যালবামটি তাকে পরিণত করে সমাজের বিবেকে। জুলাই ১৯৬৫-তে ছয় মিনিটের একটি গান ‘লাইক এ রোলিং স্টোন’ হয়ে ওঠে পপ মিউজিকের শেষ কথা। ব্রুস স্প্রিংটন গান শুনে তার অনুভূতি ব্যক্ত করেন এভাবে, ‘কেউ যেন লাথি মেরে খুলে দিয়েছে আপনার মনের দরজা।’ এরপর কেবলই এগিয়ে চলাÑ যার আপাত শেষ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ে। এত বর্ণনাতেও ডিলান চরিত্রটি কি উন্মোচিত? না। কেবল প্রেক্ষাপটটি বিবেচনায় রাখুন। সঙ্গীত ভুবনে তখন সৃষ্টিশীলতার জোয়ার বইছে। জোয়ার বইছে পরিবর্তনের। এলভিস প্রিসলি, বিটলস, রোলিং স্টোন, নফলার ব্রাদার্স, লেড জেপলিন, ডেনভার, জর্জ হ্যারিসন, ম্যাককার্টনি এমন অসংখ্য নাম। এলেন গীনসবার্গ প্রথম বার তার গান শুনে খুশিতে ফুঁপিয়ে কান্নার কথা বলেছেন আর জন লেনন তো প্রকাশ্যেই বলেছেন তার অনুপ্রেণার নাম বব ডিলান। তিনি কাজ করেছেন সবার সঙ্গে। তার পরও তিনি একা। গলায় হারমোনিকা, কাঁধে গিটার, পাশে পিয়ানো নিয়ে তিনি এক একাকী যোদ্ধা। তার রচিত গান কে গায়নি? অথবা তার গাওয়া গান গেয়ে মঞ্চ মাতায়নি কে? তার পরও সিবিএস টেলিভিশন তাকে নিয়ে শিরোনাম করে ‘নো বডি সিংস ডিলান লাইক ডিলান।’ বর্তমান ও গত শতাব্দীর সঙ্গীত ভুবনের সেরা সৃজনশীল প্রজন্মের থেকে তিনি এক ধাপ এগিয়ে। তিনি তাদের পতাকাবাহীÑ তিনি যে সুর ও বাণীতে পাল্টে দিয়েছেন সঙ্গীত ভুবনের মৌলিক কাঠামো। প্রসঙ্গ যখন ডিলানের বাণী তখন তার গভীরতা বোঝাতে একটি উদাহরণ বোধকরি যথেষ্ট। ২০০৭-এ ইউএস লিগ্যাল স্টাডিজ থেকে জানা যায়, ডিলানের বাণী মার্কিন বিচারক ও আইনজীবীদের দ্বারা উচ্চারিত হয়েছে ১৮৬ বার; যা যে কোন গায়কের জন্য আদালতে সর্বোচ্চ উদ্ধৃতির রেকর্ড। তার বাণী উদ্ধৃত করেছেন মার্কিন সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস। বিচারপতি এন্টনিও সুলিয়া। বহুল উদ্ধৃত দুটো উক্তি, ‘ইউডোন্ট নিড এ ওয়েদারম্যান টু নো হুইচ ওয়ে দ্য উইন্ড ব্লোজ’ এবং ‘হয়েন ইউ এইন্ট গট নাথিং, ইউ গট নাথিং টু লুজ।’ ডিলানের রচনা এখন বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত। নিউইয়র্ক টাইমস ডিলানের লিরিক তুলনা করেছে সিভিল ওয়ারের কবি হেনরী টিমরডের সঙ্গে। তার ৭০তম জন্মদিনে পৃথিবীর অন্যতম সেরা তিন বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজন করে তার রচনার ওপর সেমিনার। আহ্বান করে গবেষণামূলক রচনার। আরকানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফ্রান্সের ডাউনিং, যিনি ডিলানের কবিতা পড়ান তার ছাত্রদের, তার ভাষায়, ‘ব্যক্তিগত বেদনা অতিক্রম করে তার কবিতা এখন বিশ্বজনীন। অনেক বেশি পরিণত তার লেখনী’। ডিলানের লেখনী ও বাণীর প্রভাব নিয়ে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনের একটি উক্তি খুব বেশি প্রাসঙ্গিক। ডিসেম্বর, ১৯৯৭ হোয়াইট হাউসের পূর্ব রুমে ডিলানকে কেনেডী সেন্টার পুরস্কার প্রদান করতে গিয়ে ক্লিনটন বলেন, ‘আমার প্রজন্মের মানুষের ওপর যে কোন সৃষ্টিশীল শিল্পীর চেয়ে তার প্রভাব অনেক বেশি। তার কণ্ঠ এবং বাণী কানে সহজ শোনায় না। কিন্তু তিনি কাউকে খুশি করতে ব্যাকুল নন। শক্তিমানদের আঘাত করায় তিনি ওস্তাদ’। বারাক ওবামাও একমত। নিউইয়র্ক টাইমস তাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে শতাব্দীর সেরা একশ’ প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের তালিকায়। যেমন তিনি আঘাত করেছিলেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশে’ অংশ নিয়ে নিজ রাষ্ট্রশক্তিকে। রবি শঙ্করের উদ্যোগে বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের আমন্ত্রণে তিনি কনর্সাটটিতে। তার অংশ নেয়া নিয়ে শঙ্কা ছিল। কিন্তু তিনি যে, বব ডিলান। গন মানুষের মুক্তির সংগ্রামে তিনি পাশে দাড়াবেন না তা কি হয়। দু বছরের নীরবতা ভেঙ্গে তিনি অংশ নেন ‘কনর্সাট ফর বাংলাদেশে’। আমরা ঋণী আমাদের জন্মলগ্নের এই অকৃত্রিম সুহৃদের কাছে। এ লেখার উদ্দেশ্য শিল্পী ডিলানকে ফুটিয়ে তোলা। তার লেখনীর আলোচনা বা নোবেলের যথার্থতা প্রমাণ করা নয়। তার পরও প্রিয় কবি টমাস ডিলানের অনুকরণে বব ডিলান নামধারী মানুষটি কেন কবি, কেন সাহিত্যে পেলেন নোবেল? জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ যখন কবিতা, তখন বব ডিলান তার উচ্চারিত বাণী নিয়ে অবশ্যই নিজ সময়ের প্রধান কবিদের একজন। এর পরও যদি কারও সন্দেহ থাকে তবে উত্তরটি ডিলানের ভাষাতেই জানাই : The answer, my friend, is blowinÕ in the wind The answer is blowinÕ in the wind.
×