ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সম্ভাব্য গন্তব্য ইরাক-লিবিয়া হয়ে ইউরোপ

শাহ আমানতে তিন মাসে ৩৫ হাজার আদম পাচার

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২০ অক্টোবর ২০১৬

শাহ আমানতে তিন মাসে ৩৫ হাজার আদম পাচার

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে গত তিন মাসে ৩৫ হাজারেও বেশি আদম পাচারের ঘটনা ঘটেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, শারজা হয়ে পাচারকৃতদের গন্তব্য হয় প্রথমে লিবিয়া ও ইরাক। এরপর যে যার সুবিধা মতো ইউরোপের দেশগুলোতে ঢোকার চেষ্টা চালায়। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন, জনশক্তি রফতানি বিভাগ, এয়ারলাইন্সগুলোর বোর্ডিং কার্ড ইস্যু ক্ষেত্রে নিয়োজিতরা এবং দালাল ও কিছু ট্রাভেল এজেন্সির একটি সিন্ডিকেট অবৈধভাবে আদম পাচারের এ রুট তৈরি করেছে। গত ১২ অক্টোবর এ বিমানবন্দরে লিবিয়াগামী ৩৯ জনকে র‌্যাব সেভেন আটক করার পর যেসব চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তা নিয়ে এখন তদন্ত চলছে। বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালনকারী সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে ফ্লাই দুবাই, এয়ার এরাবিয়া ও ওমান এয়ারলাইন্স প্রতিদিন যাত্রী পরিবহন করছে। এর মধ্যে এয়ার এরাবিয়া দিনে-রাতে তিনবার ও ফ্লাই দুইবার আসা-যাওয়া করে থাকে। মূলত এ দুটি এয়ারলাইন্সযোগে মানবপাচার হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তা (পুলিশের এডিসি) থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত নির্দিষ্টহারে পাচারের বিপরীতে আর্থিক মাসোয়ারা পেয়ে থাকে। এর পাশাপাশি পাচারের জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ আনার জন্য দালাল চক্র নিয়োজিত। আবার এদের কাছ থেকে ইমিগ্রেশন বিভাগের জন্য নির্ধারিত অর্থ আদায় করে থাকে ছবিরুল খান নামের এক এএসআই। এ বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগের জন্য একজন এসএস নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু যোগদানের একদিন পরই তাকে চলে যেতে হয়েছে এই সিন্ডিকেট চক্রের ষড়যন্ত্রের কারণে। সূত্র জানায়, দুবাইয়ের ভুয়া ভিসা বানিয়ে মূলত আদমপাচারের ঘটনা ঘটে। পাচারকৃতদের অধিকাংশ চট্টগ্রামের বাইরের এলাকার। সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ রয়েছে, জনশক্তি বিভাগের জহিরুল ইসলাম ও আশরাফ বিদেশগামীদের যোগাড় করে থাকে আর ইমিগ্রেশন বিভাগের ছবিরুল, নুর আলম ও জিয়া নামের তিন এএসআই মানুষপ্রতি নির্দিষ্টহারে অর্থ আদায় করে থাকে। এর মধ্যে নুর আলম ও জিয়াকে টপকে শীর্ষস্থানে রয়েছে ছবিরুল। সম্প্রতি লিবিয়াগামী যে ৩৯ জনকে আটক করা হয়েছে এরা অধিকাংশ সিলেটের অধিবাসী। ইমিগ্রেশন বিভাগ বলেছে, এদের বিমানবন্দরের বাইরে থেকে ধরা হয়েছে। অথচ র‌্যাব সেভেনের কমান্ডিং অফিসার প্রকাশ্যে জানিয়েছেন ৩৯ জনকেই বিমানবন্দরের ভেতর থেকে আটক করা হয়। যাদের মধ্যে ১৯ জন ইমিগ্রেশন ক্রস করে চলে যেতে সক্ষম হয়। ওই দিন ১৩০ জনের একটি দল পাচার প্রক্রিয়ায় ছিল। একটি অংশ এর আগেই ফ্লাইটে উঠে যাওয়ায় তাদের আর নামানো সম্ভব হয়নি। তাদের সংখ্যা ২১ জন বলে জানা গেছে। বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, এয়ার এরাবিয়া ও ফ্লাই দুবাইতে মূলত আদমপাচারের ঘটনাই বেশি ঘটছে। পাচারকৃতদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ন্যূনতম ৪ লাখ, উর্ধে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকাও গ্রহণ করা হয়ে থাকে। দালাল ও ট্রাভেল এজেন্টগুলোর মাধ্যমে এ অর্থ তুলে তা পরবর্তীতে বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দুর্নীতিবাজরা অংশ অনুপাতে পেয়ে থাকে। এর মধ্যে ইমিগ্রেশন বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তার (এডিসি) হিস্যা সর্বোচ্চে বলে জানা গেছে। এ বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ বিমানের আন্তর্জাতিক ফ্লাইটও চলাচল করে থাকে। এ ফ্লাইটগুলোতেও পাচারের ঘটনা রয়েছে, তবে তা একেবারেই সামান্য। গলাকাটা পাসপোর্টের (পিসি) মাধ্যমে মাঝে মধ্যে দুই-একটি ঘটনা ঘটে থাকে। এছাড়া ওমান এয়ারলাইন্সযোগে আদমপাচারের ঘটনা তেমন একটা নেই বলে সূত্রে জানা গেছে। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সরকারী দুটি গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রম রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এ সংস্থার চিহ্নিত কয়েকজন এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। তবে সিভিল এভিয়েশন বিভাগের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের আদমপাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নেই বললেই চলে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইতোমধ্যে যে পরিমাণ আদমপাচার হয়ে গেছে তাদের মধ্যে লিবিয়া থেকে কয়েক দফায় কেউ কেউ ফেরতও এসেছে। ফেরত আসার পর সাধারণত এদের আটক না করে ছেড়ে দেয়ার কথা স্বীকার করেছে ইমিগ্রেশন বিভাগ। সিএমপির একাধিক কর্মকর্তা বিস্ময়ের সঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ইমিগ্রেশন বিভাগের ক্লিয়ারেন্স ছাড়া কারও ফ্লাইটে উঠার সুযোগ নেই। এর আগে বডিং পাস প্রদান করা থেকে শুরু করে পরবর্তীতে ফ্লাইটে ওঠা পর্যন্ত যে কয়েকটি পয়েন্ট রয়েছে প্রতিটিতে অবৈধ এসব ভুয়া ভিসা ধরা পড়ার কথা। কিন্তু এ পর্যন্ত যেসব যাত্রী অবৈধভাবে বিদেশী এয়ারলাইন্সযোগে চলে গেছে, তা ইমিগ্রেশন বিভাগের জ্ঞাতসারে যাওয়া ছাড়া অসম্ভব। একটি গোয়েন্দা সংস্থার লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত কয়েক দিন আগে উচ্চপর্যায় থেকে একটি তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টের পর থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে নাকি ধামাচাপা পড়ে যাবে, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। চট্টগ্রামের বাইরে বিভিন্ন এলাকার নিরীহ যুবকদের মোটা অঙ্কের আয়ের লোভে ফেলে দালাল চক্রের একটি সিন্ডিকেট ট্রাভেলিং এজেন্সির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হচ্ছে। এদের কারও কারও কাছ থেকে অগ্রিম আবার কাউকে কাউকে বাকিতেও পাচার করা হচ্ছে।
×