ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সার্টিফিকেট দিয়ে গেলেন স্বয়ং বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট কিম

সেদিনের মরা কার্তিক এখন জাদুঘরে ॥ আজকের কার্তিক উন্নয়নের প্রতীক

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২০ অক্টোবর ২০১৬

সেদিনের মরা কার্তিক এখন জাদুঘরে ॥ আজকের কার্তিক উন্নয়নের প্রতীক

সমুদ্র হক ॥ সেদিনের সেই কার্তিককে অনেক দূরে ফেলে রেখে আজকের কার্তিক গর্বিত বিজয়ী উপাখ্যান হয়ে আরও এগিয়ে যাচ্ছে। একদা যে কার্তিক ছিল বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের লজ্জা ও বিব্রতকর, বিশ্বের সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে এসে দারিদ্র্যের চিহ্নের ছবি তোলার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে যেতেন, তারাই এখন লজ্জা পেয়ে এ দেশে আসেন না। এই কার্তিকেই বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বাংলাদেশে এসে দেখে গেলেন কি অসাধারণ সাফল্য এনেছে দেশটি। বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংস্থার দক্ষিণ এশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট এ্যানেট ডিকসন, বাংলাদেশ প্রধান চিমিয়াও ফান, আইএফসির দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক মোনগিসু আলিমাইয়ো দেখে গেলেন বাংলাদেশকে। বুঝে গেলেন বিশ্বব্যাংকের অর্থ ছাড়াও এই দেশ উন্নয়নের পথে পা বাড়াতে পারে। বিশ্বব্যাংক যে দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশের প্রভু হতে পারবে না তাও বুঝে গেলেন পদ্মা সেতুর নির্মাণযজ্ঞ দেখে। বিশ্বব্যাংক নিজেই আগ্রহী হয়ে ঋণ দেয়ার প্রস্তাব করে গেলেন। বাংলাদেশের এমন অর্জন বিশ্বকে কার্যত বিস্মিত করে দিয়েছে। সেদিনের সেই মরা কার্তিক! কুড়িগ্রামের বাসন্তীর যে জাল জড়িয়ে থাকার ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল সেই জাল নদী পাড়ের জেলেদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। দেশে মাছের চাহিদা মিটিয়ে এখন রফতানি শুরু হয়েছে। আশ্বিন-কার্তিক শুরু হলেই উত্তরাঞ্চলের বিশেষ করে বৃহত্তর রংপুরের মানুষের খাদ্যাভাব দুর্দশার চিত্র প্রকাশিত হতো পত্রিকার পাতায়Ñ আজ সেই বৃহত্তর রংপুরের এই কার্তিকেই গ্রামের কৃষক নতুন ধান ওঠার আগে সংগ্রহে রাখা ঘরের খাবার পাচ্ছে। এই কার্তিক মাসেই উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী থেকে উদ্বৃত্ত সবজি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি হচ্ছে। একদা যে কার্তিকে উত্তরের দিনমজুর কামলা কিষানরা কাজের সন্ধানে ঢাকাসহ বড় শহরের দিকে যেত তারা এখন নিজেদের এলাকায় কোন না কোন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। আজ আর কথিত অভাবী এলাকার সেই গল্প খুঁজে পাওয়া যায় না- যেখানে কিষান ও দিনমজুরের বধূ অপেক্ষার প্রহর গুনত কবে স্বামী কাজ শেষে বাড়ি ফিরবে! কবে দু’মুঠো ভাত নিজের সন্তানের পেটে পড়বে। ছোট্ট শিশু একটি ‘লাল পিরানের’ (মেয়েদের ফ্রক) জন্য চোখের জল ফেলবে। এসব চিত্র আজ নিকট অতীত। বর্তমানের চিত্র এমনই যে নবান্নের অঘ্রাণে গৃহস্থরা ধান কাটার কামলা খুঁজে পায় না। কামলাদের অনেকেই আজ ছোট গেরস্ত হয়েছে। যান্ত্রিক কৃষি অনেক কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন করে দিয়েছে। পাওয়ার ট্রিলার, ধান মাড়াই কাটাইয়ের যন্ত্র যাদের নেই তারা ভাড়ায় নিয়ে কৃষি কাজ সারছে। অনেকে এসব যন্ত্র ভাড়া দিয়েও রোজগার করছে। কার্তিকে গ্রামে কেউ আর বসে নেই। ছোট্ট শিশুদের আর লাল পিরানের জন্য কাঁদতে হয় না। না চাইতেই সে পেয়ে যায়। প্রত্যেক বাড়ির উঠানে দিন কয়েক পরে ধান মাড়াই কাটাইয়ের প্রস্তুতি চলছে। মাটি পানিতে গুলিয়ে উঠান লেপা হচ্ছে। অবসরে সামনের দিনগুলোয় গৃহস্থালি কি কাজ করা হবে তার ফিরিস্তি তৈরি হচ্ছে। গাঁয়ের বধূর একটি অংশ হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালনের ছোট্ট খামার গড়ে তুলেছে। অনেক নারী গার্মেন্টে কাজ করছে। গ্রামের অনেক পুরুষ বিদেশ বিভূঁইয়ে গিয়ে কাজ করে টাকা পাঠাচ্ছে। তাদের রেমিটেন্সে বাড়ছে রিজার্ভ। একদার মরা কার্তিক আজ অগ্রগতির যাত্রার জীবন্ত কার্তিক হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তার সার্টিফিকেট বিশ্বব্যাংক দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে বাংলাদেশে বর্তমানে (২০১৬) হতদরিদ্রের হার ১২ দশমিক ১ শতাংশ। ২০০৫ সালে এই হার ছিল ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ। বর্তমানে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে দরিদ্রের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি। এই মানুষদের মুখে খাবার পৌঁছে দিতে সরকার ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি শুরু করেছে। ৫০ লাখ পরিবার প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল পাবে। এক জরিপে বলা হয়েছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে দেশ বিজয় অর্জনের পর দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে তিনগুণ। বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (আরডিএ) কৃষি বিজ্ঞানের পরিচালক ড. এ কে এম জাকারিয়া জানান বর্তমানে দেশে বছরজুড়ে কোন না কোন ধানের আবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) সারা বছর ধান উৎপাদনের নানা জাত উদ্ভাবন করেছে। যা মাঠ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। মাঠ পর্যায়ের কৃষক জানে কোন ধান কখন আবাদ করতে হবে। উৎপাদিত হচ্ছে সম্পূরক ফসল। বাড়তি উৎপাদন হচ্ছে সকল ধরনের সবজি। সবজি আবাদের এমন অবস্থা যে শীত মৌসুমের সবজি গ্রীষ্মেও ফলছে। বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার মারিয়া গ্রামের অনেক নারী এখন বীজ বিক্রির ব্যবসা করছে। নানা দিক থেকে নারী স্বাবলম্বী হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের গ্রামীণ নারী কৃষির সকল কাজই করছে। দারিদ্র্য বিমোচনে অধিক জনসংখ্যার এই দেশে মানব সম্পদকে কাজে লাগানো হয়েছে। দেশের এক কোটিরও বেশি লোক বিদেশ বিভূঁইয়ে গিয়ে কাজ করে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে। এই এক কোটি পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের খাবার জুটেছে। সংসারের যাবতীয় খরচ মেটানোর পরও বাড়তি অর্থে শখও মেটাচ্ছে তারা। ওসব পরিবার গ্রামে বসেই প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ সংগ্রহ করতে পারছে মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধায়। দেশের অন্তত ৫০ লাখ নারী গার্মেন্টে কাজ করছে। সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংকগুলো প্রতি বছর ১২ থেকে ১৪ হাজার কোটি টাকা কৃষিঋণ দিয়ে কৃষকদের সচ্ছল ও স্বাবলম্বী করে তুলছে। বর্তমান সরকারের শাসনামলে দেশে প্রথমবারের মতো একজন কৃষক মাত্র দশ টাকা দিয়ে ব্যাংক হিসাব (এ্যাকাউন্ট) খুলতে পারে। এই এ্যাকাউন্টেই ঋণসহ কৃষির সার্বিক হিসাবের কর্মকা- পরিচালিত হয়। দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী চালু হয়েছে। বয়স্ক ভাতা বিধবা ভাতাসহ কয়েকটি খাতে প্রতি মাসে কয়েক লাখ মানুষ আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে। এসব খাতে প্রতি বছর ব্যয় বাড়ছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাত ও কর্মসূচীতে ব্যয় বরাদ্দ ছিল প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে (২০১৬-১৭) ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। এসব খাতে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৩১ শতাংশ। গত পাঁচ বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে বর্তমানে প্রায় ৭ শতাংশ। বর্তমান অর্থবছরে এই হারের টার্গেট ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বছর দুয়েক আগে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এতটাই ‘আন্ডার এস্টিমেট’ করেছিল যে ঋণ সহায়তাতেও তাদের (বিশ্বব্যাংক) ছিল গড়িমসি। এই বিশ্বব্যাংক এখন বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনসহ উন্নয়নের নানা কর্মসূচী দেখে কাউন্ট করা শুরু করেছে, সহায়তা দিতে পাশে এসে দাঁড়াতে চাইছে। যে মরা কার্তিক ঘিরে বিশ্বের দেশগুলো একসময় বাংলাদেশকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছে, বাংলাদেশকে গরিব দেশ হিসেবে দেখতে চেয়েছে, সহযোগিতা চাইতে গেলে কঠিন শর্ত জুড়ে দিয়ে পরোক্ষে অপমান করেছে, তারাই এখন পারে তো শর্ত ছাড়াই সহযোগিতা দিতে অতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার যে মন্তব্য করে অপমান করেছিলেন, বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ম্যাকনামারা তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে যে কটাক্ষ করেছিলেন, বিশ্বের সেই কথিত প্রভুদের প্রতিনিধি বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম কার্তিক মাসেই বাংলাদেশে এসে স্বচক্ষে দেখে গেলেন সেদিনের সেই কার্তিককে পেছনে ফেলে কিভাবে আজকের কার্তিক বিজয়ী হয়েছে।
×