ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের সফরে ৩শ’ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি

ইতিবাচক ভাবমূর্তিই সবচাইতে বড় প্রাপ্তি

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২০ অক্টোবর ২০১৬

ইতিবাচক ভাবমূর্তিই সবচাইতে বড় প্রাপ্তি

আনোয়ার রোজেন ॥ বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সফরে নতুন করে মোট ৩০০ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বাংলাদেশ। এটা একটা ভাল দিক। তবে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন সম্পর্কে যে ইতিবাচক ধারণা বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট নিয়ে গেলেন সেটাকেই এ সফরের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, পদ্মা সেতু ইস্যুতে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের যে তিক্ততা শুরু হয়েছিল, সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের সফরের মাধ্যমে তা পুরোপুরি কেটে গেছে। তাদের মতে, ৩০০ কোটি ডলারের বর্ধিত সহায়তার বিষয়টি বিশ্বব্যাংক-বাংলাদেশ সম্পর্কের শুভ সূচনা। এতে উভয়ের আন্তরিকতাই প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতার প্রয়োজন আছে। তাই পেছনের সমস্যা দূরে রেখে বাংলাদেশ চেয়েছে উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা। আর বিশ্বব্যাংকও আন্তরিকভাবে চাইছে এই উন্নয়নের অংশীদার হতে। এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সিনিয়র গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, তিনটি কারণে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। প্রথমত, প্রতিবছর বিশ্বব্যাংক দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য লাভ করা দেশকে শো করে থাকে। এবার দারিদ্র্য বিমোচনে মডেল হিসেবে বাংলাদেশের শো কেসিং হলো। এর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের উদ্যোগগুলো বৈশ্বিক পর্যায়ে পরিচিতি পাবে। এটা বাংলাদেশের জন্য একটা বড় প্রাপ্তি। দ্বিতীয়ত, পদ্মা সেতু ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাংক-বাংলাদেশ সম্পর্কে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, এ সফরে সেটা উভয় পক্ষই কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছে। সফরের ভেতরেই এই ধরনের ইঙ্গিত ছিল। মনে হয়েছে যে, উভয় পক্ষই আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে পেরেছে। তৃতীয়ত, দুটি খাতে বিশ্বব্যাংক নতুন ও বাড়তি অর্থায়নের কথা বলেছে। ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিশ্ব্যব্যাংকের যে কান্ট্রি এ্যাসিস্টেন্স স্ট্র্যাটেজি (সিএএস) রয়েছে, সেখানে তারা কী পরিমাণ বিনিয়োগ বাংলাদেশে করতে চায় তার ঘোষণা দেয়া আছে। এর বাইরেও সংস্থাটি আরও ৩০০ কোটি ডলার বাড়তি ব্যয়ের ঘোষণা দিয়েছে। এটা আশাব্যঞ্জক। এই অর্থ বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজে লাগবে। তবে তিনি মনে করেন বাড়তি প্রতিশ্রুতির অর্থ ব্যয়ে বাংলাদেশকে আরও বেশি সক্ষমতা দেখাতে হবে। এজন্য প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতা থাকা, সময়কাল ধরে শেষ করা এবং সর্বোপরি যে উদ্দেশে এই প্রকল্পগুলো নেয়া হবে সেটা নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, প্রায় ১০ বছর বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের সফর উন্নয়নের ক্ষেত্রে সংস্থাটির সঙ্গে বাংলাদেশের আরও একটা দীর্ঘপথের সূচনামাত্র। বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিস সূত্র বলেছে, নতুন করে দেয়া প্রতিশ্রুতি ঋণ সহজ শর্তে কম সুদে দেয়া হবে। ঋণের সুদহার হবে দশমিক ৭৫ শতাংশ। সাত বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ এই ঋণ পরিশোধে সময় পাওয়া যাবে ৩০ বছর। নতুন প্রতিশ্রুতির বিষয়ে ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স এ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরি জনকণ্ঠকে বলেন, শিশুর অপুষ্টি রোধের চলমান প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক বাড়তি ১০০ কোটি ডলার দিচ্ছে। এর ফলে প্রকল্পের কাভারেজ বাড়ানো সম্ভব হবে। আবার জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের জন্য বড় ইস্যু। এ ক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে আরও ২০০ কোটি ডলার। এই বর্ধিত আর্থিক সহায়তা আমাদের উন্নয়নকে আরও সুসংহত করবে। তবে তিনিও মনে করেন এদেশের উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন সম্পর্কে যে ইতিবাচক ধারণা বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট নিয়ে গেলেন সেটাই এ সফরের বড় প্রাপ্তি। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মহলে বিশ্বব্যাংক একটি নেতৃস্থানীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নীতিনির্ধারক যদি বাংলাদেশের প্রশংসা করেন সেটা নিশ্চিতভাবেই অন্যান্য দাতাসংস্থাকেও বাংলাদেশের প্রতি আরও আগ্রহী করে তুলবে। এর ফলে আমরা ধারারাহিক সুবধিা পেতে থাকব। আমাদের উন্নয়নের যে ধারা সেটা বিশ্বজুড়ে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাবে এবং উন্নয়নের গতি আরও দ্রুততর করা যাবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের যে লক্ষ্য সেটা অর্জনেই ৩০০ কোটি ডলার ব্যয় হবে। বিশেষ করে ধনী দরিদ্রের আয় বৈষম্য নিরসনের ক্ষেত্রে এ অর্থ কাজে লাগবে। অপুষ্ট শিশু পরিবার ও জাতির জন্য বোঝা। আর দরিদ্র পরিবারের শিশুরাই অপুষ্টিতে ভোগে। এখন এটা রোধে অর্থব্যয়ের মানে হচ্ছে আগামীর জন্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা, যা দারিদ্র্য বিমোচনে সরাসরি ভূমিকা রাখবে। আবার দীর্ঘমেয়াদে অতি দরিদ্রের বড় কারণ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যাপী বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রতিবছর বাড়ছে। এসব দুর্যোগের শিকার মানুষের দারিদ্র্য দীর্ঘস্থায়ী হয়। এ হিসেবে এখাতে যে ২০০ কোটি ডলারের সহায়তা পাওয়া গেছে তাও দারিদ্র্য বিমোচনে কাজে লাগবে। সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি : ২০৩০ বিবেচনায় নিয়েই বিশ্বব্যাংক এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে এসব অর্থ যাতে প্রকৃত অর্থে দরিদ্রদের জন্য ব্যয় হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে সময়ের অপচয়, প্রকল্পে দীর্ঘসূত্রতা ও অব্যবস্থাপনার মতো বিষয়ে বাংলাদেশের উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে।
×