ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ঠাকুরগাঁওয়ে খাদ্যবান্ধব চাল বিতরণ

ব্যবসায়ীদের নামে কার্ড

প্রকাশিত: ০৪:১০, ২০ অক্টোবর ২০১৬

ব্যবসায়ীদের নামে কার্ড

নিজস্ব সংবাদদাতা, ঠাকুরগাঁও, ১৯ অক্টোবর ॥ সদর উপজেলায় ১০ টাকা কেজিতে চাল বিক্রির কার্ড বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকার দলীয় নেতাদের স্বজনদের পাশাপাশি মৃত ব্যক্তি, শিশু ও বিত্তবানদের নামেও এ কার্ড দেয়া হয়েছে। রায়পুর ইউনিয়নের কানিকষা গ্রামের খলিলুর রহমান বছর চারেক আগে মারা গেছেন। তাঁর নামে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে কার্ড। খলিলুর জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক রুহুল আমিনের বড় ভাই আবদুর রহমানের ছেলে। কার্ডের তালিকায় রুহুল আমিনের দুই স্ত্রীর নামও রয়েছে। রুহুল আমিন রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) দু’বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। রুহুল আমিন বলেন, ‘খলিলুরের নামে কীভাবে কার্ড এলো, বলতে পারছি না।’ খলিলুরের স্ত্রী ফিরজা বেগম অবশ্য দাবি করেন, তিনি চাল তুলতে যাননি। কার্ডটি এখন কোথায়? জানতে চাইলে তিনি বলেন, কার্ডটি সামাদের কাছে আছে। সামাদ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। জামালপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পারপূগী গ্রামের ইউনুস আলীর এক ছেলে রিতু (১০) চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। আরেক ছেলে সুয়াদ আলী (৬) স্কুলে যাতায়াত শুরু করেছে। তাদের দুজনের নামেই কার্ড দেয়া হয়েছে। তবে সুয়াদের বাবার নাম ইউনুস আলী থাকলেও রিতুর বাবার নাম দেখানো হয়েছে মহসিন। তাদের মা বাবলি আকতার বলেন, ‘আমার স্বামীর নাম ইউনুস আলী মহসিন। তালিকায় দুই ছেলের নাম থাকলেও শুধু রিতুর নামে কার্ড দেয়া হয়েছে। আমাদের আর্থিক অবস্থা দেখে দলের লোকজনই এ কার্ডটি দিয়েছেন।’ ইউনুস আলী ওরফে মহসিনের আরেক ভাই মোঃ মুকুলের ছেলে মিঠুন (১২) সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। ওর নামেও কার্ড দেয়া হয়েছে। এছাড়া এ ইউনিয়নে কার্ড পেয়েছেন আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সভাপতি ওষুধ ব্যবসায়ী তরিকুল ইসলাম, ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সহসভাপতি খতিবর আলী, ব্যবসায়ী লিটন আলীসহ বিত্তশালী অনেকেই। মোহাম্মদপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান। ছেলে সফিউর রহমানের নামে তিনি কার্ড নিয়েছেন। এছাড়া তালিকায় রয়েছে মোস্তাফিজুর রহমানের ভাই মাতৃগাঁও গ্রামের রমজান আলী, আনিসুর রহমান, চাচাত ভাই আফসার আলী, আবদুর গফ্ফার, ভাতিজা মজিরুল ইসলামের নাম। একই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাকডোব গ্রামের বাসিন্দা আবদুল কাদের। তার স্ত্রী দিলুয়ারা বেগমকে কার্ড দেয়া হয়েছে। কাদেরের ভাইদের মধ্যে রবিউল ইসলাম, রেজাউল করিম, হুসেন আলী ও আক্তার আলম ঢাকায় চাকরি করেন। ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিক্রির কার্ড তাঁরাও পেয়েছেন। তবে আবদুল কাদেরের দাবি, তিনি এসব কার্ডের বরাদ্দ তুলে স্থানীয় একটি এতিমখানায় দান করেন। এছাড়া ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সামাদের মেয়ে কহিনুর, ছেলে আলমগীর, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মানিক ও তাঁর দু’বোন জেসমিন আক্তার ও মুক্তার নামও তালিকায় পাওয়া গেছে। ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরত আলী নিজের নামে ও তার ছেলে আবদুর রাজ্জাকের নামেও কার্ড নিয়েছেন। এছাড়া তালিকায় মোহাম্মদপুর গ্রামের ফয়জুল রহমান, গিলাবাড়ি গ্রামের ইব্রাহীম, অনেক বিত্তশালী লোকসহ ইউপি সদস্য সোলায়মান ও আবদুল মমিনের স্ত্রীদের নাম পাওয়া গেছে। রুহিয়া ইউপির ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ললিত কুমার রায় পাকাবাড়ি, মিল-চাতাল ও কয়েকটি পাকা দোকানঘরের মালিক। তার ছেলে অর্জুন কুমার রায়ও কার্ড পেয়েছেন। সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেনের গাড়িচালক আবদুল মজিদের ছেলে আবদুল্লাহ আল মামুনের নামে কার্ড দেয়া হয়েছে। ঘনিমহেশপুর গ্রামের মৃত সুবানের ছেলে আবদুল গফুর কাতার প্রবাসী। তালিকায় তারও নাম দেখা গেছে। ইউপি সদস্য হালিমা বেগমের স্বামী জাহাঙ্গীর আলম, ভাশুর খাদেমুল ইসলাম, দেবর জাহেরুল ইসলাম ও দেবরের ছেলে সুলতার আলমের নামে কার্ড রয়েছে। হতদরিদ্র লোকজনের তালিকা বাছাই কমিটির সদর উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের সভাপতি ও সদর উপজেলার সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা রতিকুল ইসলাম বলেন, ‘তালিকায় মৃত ব্যক্তির নাম থাকলেও আমার করার কিছুই ছিল না। তালিকায় সই করা ছাড়া তালিকা তৈরিতে ট্যাগ অফিসারদের হাত নেই। চেয়ারম্যান ও ইউপি সচিব তালিকা তৈরি করে যেভাবে আমার কাছে দিয়েছেন, আমাকে সেই তালিকাতেই সই করতে হয়েছে।’ রায়পুর ইউপির চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, তালিকা প্রণয়ন করেছে বাছাই কমিটি। আমি সেই কমিটির একজন সদস্য মাত্র। তবে কিছু অনিয়মের শোনা যাচ্ছে। সেগুলো খতিয়ে দেখে সংশোধনের ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ তালিকা বাছাই কমিটির উপজেলা সভাপতি ও ইউএনও আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘তালিকা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় কথা হচ্ছে বলে শুনেছি। তবে কেউ তেমনভাবে অভিযোগ করেননি। তবুও তালিকা যাচাই করে অসঙ্গতি পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ মাদারীপুরে ধনীর পেটে নিজস্ব সংবাদদাতা, মাদারীপুর থেকে জানান, হতদরিদ্রদের জন্য ১০ টাকা মূল্যের চালের কার্ড প্রদানে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ইউনিয়নের হতদরিদ্রদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত ধনী ও নিজ সমর্থকদের নামে তালিকা করেছেন চেয়ারম্যান মেম্বাররা। ফলে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের সুফল পাচ্ছে না দরিদ্ররা। এতে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে বঞ্চিতদের মাঝে। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে একাধিক লিখিত অভিযোগও দেয়া হয়েছে বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে। জানা গেছে, পাইকপাড়া ইউনিয়নে গরিবদের বাদ দিয়ে চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা তাদের নিজস্ব ও ধনী লোকদের নামে তালিকা করেছেন। এছাড়াও এক ব্যক্তি একাধিক কার্ড পেয়েছে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পাইকপাড়া ইউনিয়নের দামেরচর গ্রামের রাজা মিয়া মাতুব্বরের স্ত্রী মালতি বেগমের নামে দুটি কার্ড ইস্যু করা হয়েছে। একটি কার্ডের সিরিয়াল নং ১৯৫ এবং আরেকটি কার্ডের সিরিয়াল নং ২৩৯। তার বাড়িতে পাকা ঘর রয়েছে এবং ছেলে বিদেশ থাকে। কৃষ্ণপুর গ্রামের রাঙ্গা মাতুব্বর, এসকেন মোড়ল, বন্দর আলি সরদার, দামেরচর গ্রামের নুরু কাজী, কাঠুরাকান্দা গ্রামের নাজমা বেগম, সহিদুল, দক্ষিণ সারিস্তাবাদ গ্রামের ফাহিমা বেগম, মাঝকান্দার ফুলতলা গ্রামের মোতালেব একাধিক কার্ড পেয়েছে। আবার শ্রিফলতলী গ্রামের সাবেক মহিলা মেম্বারের মেয়ে সেতু বেগম কার্ড পেয়েছে। তার আধাপাকা বাড়ি, টিভি ফ্রিজ এবং জমিজমা রয়েছে। এছাড়াও কৃষ্ণপুরের ওষুধ ব্যবসায়ী ওবাইদুল হতদরিদ্রদের কার্ড পেয়েছে। তার বাড়িতেও পাকা ঘর রয়েছে। এভাবেই বণ্টন করা হয়েছে কার্ড। অপর দিকে দামেরচর গ্রামের সুফিয়া বেগম, শেফালি বেগম, সালমা বেগমসহ কয়েক হাজার নারী-পুরুষ রয়েছে যাদের নেই কোন বাড়িঘর জমি জমা। অথচ তারা কার্ড পায়নি। এ ব্যপারে মাদারীপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক তানভীর আহম্মদ বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের কার্ড সংশোধন করা হয়েছে। কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’ গাইবান্ধায় ৬ ডিলারের নামে মামলা নিজস্ব সংবাদদাতা, গাইবান্ধা থেকে জানান, ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়নে ১০ টাকা কেজি মূল্যের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর ১৮৩ বস্তা চাল আটকের ঘটনায় ৬ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে পুলিশ এ পর্যন্ত কাউকে আটক করতে পারেনি। মামলার আসামিরা হচ্ছে ডিলার আজাহার আলী ও তার সহযোগী মোজাম্মেল হক, আব্দুল হাই, আব্দুল মোতালেব এবং যে দুটি বাড়ি থেকে চাল উদ্ধার করা হয়েছে তার মালিক মোকারম মির্জা ও আলম মিয়া। এ ব্যাপারে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক রিয়াজুল হক বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। উল্লেখ্য ডিলার আজাহার আলী ওই ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মঙ্গলবার সকালে ফজলুপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ খাটিয়ামাড়ি তালতলা বাজারের পশ্চিমে মোকারম মির্জার বাড়ি থেকে ১৫৯ ও আলম মিয়ার বাড়ি থেকে ২৪ বস্তা চাল উদ্ধার করা হয়।
×