ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তিন শীর্ষ জঙ্গী নেতা হলি আর্টিজান হামলার ফান্ড গড়েছিল

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৯ অক্টোবর ২০১৬

তিন শীর্ষ জঙ্গী নেতা হলি আর্টিজান হামলার ফান্ড গড়েছিল

শংকর কুমার দে ॥ গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলায় জড়িত নব্য জেএমবি’র কর্মকা- পরিচালনার জন্য কয়েক কোটি টাকার তহবিল গড়েছিল নব্য জেএমবি’র শীর্ষ তিন জঙ্গী নেতা। এই তিন শীর্ষ জঙ্গী নেতা হচ্ছে, পুরা পরিবার নিয়ে সিরিয়ায় উধাও হয়ে যাওয়া পলাতক ডাঃ খন্দকার রোকনউদ্দিন, মিরপুরের রূপনগরে নিহত সাবেক মেজর জাহিদুল ইসলাম ওরফে মেজর মুরাদ ও আজিমপুরে নিহত তানভীর কাদেরী। নব্য জেএমবি’র তহবিলে কে কত টাকা জমা দিয়েছিলেন তার একটি হিসাব পেয়েছেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। সপবিরবারে সিরিয়ায় পলাতক ডাঃ রোকনুজ্জামান নব্য জেএমবি’র তহবিলে জমা দিয়ে গেছেন দিয়েছিলেন ৮০ লাখ টাকা। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পর পাওয়া প্রায় কোটি টাকা জমা দিয়েছিলেন মেজর জাহিদুল ইসলাম ওরফে মেজর মুরাদ। সাবেক ব্যাংকার তানভীর কাদেরী তার উত্তরার ফ্ল্যাট বিক্রি করে পাওয়া কোটি টাকা জমা দিয়েছিলেন নব্য জেএমবি’র তহবিলে। নব্য জেএমবি’র তহবিলে জমা দেয়া কয়েক কোটি টাকা দিয়ে অস্ত্র, গোলাবারুদ, গ্রেনেড-বোমা ও বিস্ফোরকদ্রব্য ক্রয়, বাসা ভাড়া, জঙ্গী সদস্যদের থাকা-খাওয়া, যাতায়াত, জিহাদী প্রচার চালানোর জন্য কম্পিউটার, ল্যাপটপ ইত্যাদি ক্রয়, সংগঠনটির সদস্য সংগ্রহসহ নব্য জেএমবি’র কার্যক্রম পরিচালনায় বিরাট নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, গুলশান হামলায় জড়িত নব্য জেএমবি তাদের কর্মকা- চালিয়ে নিতে চাঁদা হিসেবে কয়েক কোটি টাকা নব্য জেএমবি’র তহবিলে জমা দিয়েছেন কয়্কেজন শীর্ষ নেতা। সাবেক মেজর জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পর পাওয়া প্রায় কোটি টাকা জমা দিয়েছিলেন নব্য জেএমবির এই তহবিলে। নব্য জেএমবি’র তহবিলে জমা দিয়েছেন সাবেক ব্যাংকার তানভীর কাদেরী তার উত্তরার ফ্ল্যাট বিক্রি করে পাওয়া কোটি টাকা। পুরো পরিবার নিয়ে সিরিয়ায় উধাও হয়ে যাওয়া খিলগাঁওয়ের চিকিৎসক ডাঃ খন্দকার রোকনুদ্দীন নব্য জেএমবির তহবিলে জমা দিয়েছেন ৮০ লাখ টাকা। এই তিনজনের বাইরে আর কারা জেএমবিকে তহবিল যুগিয়েছে, তা বের করতে কাজ করছেন গোয়েন্দারা। মঙ্গলবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল ইসলাম এই তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, নব্য জেএমবির তহবিলের টাকা অপারেশনের কাজে ব্যয় করার পাশাপাশি নিবেদিত প্রাণ সদস্যদের বেতন, খাওয়া ও তাদের সন্তানদের পড়ালেখার জন্য ব্যয় করা হয়। সংগঠনে তাদের অবস্থান অনুযায়ী নেতা-কর্মীদের বেতন-ভাতা ঠিক করা হয়ে থাকে। যেসব জায়গায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে নব্য জেএমবির সদস্যদের গ্রেফতার করেছে তাদের সবার কাছেই পর্যাপ্ত টাকা ছিল। তবে দীর্ঘদিন ধরে অনেকটা পলাতক জীবনযাপন করায়, পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে দূরে থাকায় তারা মানসিকভাবে অনেকটাই দুর্বল ছিল জঙ্গীরা। শীর্ষ তিন জঙ্গীর একজন মেজর জাহিদ তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নব্য জেএমবি’০র তহবিলে যেই তিন শীর্ষ নেতা বিরাট অঙ্কের টাকা জমা দিয়েছিলে তার মধ্যে মেজর জাহিদুল ইসলাম ওরফে মেজর মুরাদ মিরপুর রূপনগরে পুলিশের অভিযানে নিহত হয়েছেন গত ২ সেপ্টেম্বর। তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে নব্য জেএমবিতে যোগ দিয়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তার এক মেয়ে পিংকী, যাকে আজিমপুর জঙ্গী আস্তানায় পুলিশ অভিযানে উদ্ধার করার পর তার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহত মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার ইসলাম শীলা দশ মাস বয়সী এক সন্তান নিয়ে আজিমপুর জঙ্গী আস্তানা থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার পর এখনও পর্যন্ত তার হদিস মিলেনি। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, মেজর জাহিদ ছিলেন নারায়ণগঞ্জ অভিযানে নিহত নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরীর প্রধান সহযোগী। অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তাই গুলশান ও শোলাকিয়া হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। তানভীর কাদেরী নব্য জেএমবি প্রধান তামিম চৌধুরী নারায়নগঞ্জের পাইকপাড়ায় পুলিশী অভিযানে নিহত হওয়ার পর জঙ্গী দলটির সমন্বয়কের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছিলেন তানভীর কাদেরী। ‘আব্দুল করিম’ ও ‘শমসেদ’ নামে নব্য জেএমবি সংগঠনে পরিচিত ছিলেন তিনি। করিম নাম ব্যবহার করেই তিনি বসুন্ধরা আবাসিকে গুলশান হামলাকারীদের জন্য ফ্ল্যাট ভাড়া করেছিলেন। এই বসুন্ধরার ভাড়া করা ফ্ল্যাট থেকে বের হয়েই গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলা চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয় এই পাঁচ জঙ্গী। গত ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকার আজিমপুরে পুলিশের অভিযানের পর তানভীর কাদেরীর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। তানভীর কাদেরীর দুই যমজ সন্তানের মধ্যে একজন তাহরিম কাদেরী কিশোর জঙ্গী হিসাবে গ্রেফতার হয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারেক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। তার আরেক কিশোর যমজ সন্তানকেও জঙ্গীদের হাতে তুলে দেয়ার পর অজ্ঞাত জঙ্গী আস্তানায় অবস্থান করছে। নিহত আবদুল করিমের স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা ওরফে খাদিজা আজিমপুর জঙ্গী আস্তানা থেকে আহত অবস্থায় গ্রেফতার হওয়ার পর পুলিশ প্রহরায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জবানবন্দী দেয়ার পর তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ডাঃ খন্দকার রোকনুদ্দীন ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক রোকনুদ্দীন (৫০) খিলগাঁও চৌধুরী পাড়ায় থাকতেন। তার স্ত্রী নাইমা আক্তার (৪৫) যশোর সরকারী এম এম কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তাদের সঙ্গে তাদের দুই মেয়ে রেজওয়ানা রোকন (২৩) ও রামিতা রোকন (১৫) এবং জামাতা সাদ কায়েস (৩০)। নাইমা আক্তার কবি নজরুল কলেজের অধ্যাপক। ছোট মেয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী। ডাঃ রোকনউদ্দিনের গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুরে। গত এক বছর ধরে নিখোঁজ। পুলিশের ধারণা, তারা সিরিয়া হয়ে আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় পাড়ি জমিয়েছেন। ডাঃ রোকনউদ্দিন গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলা বাস্তবায়নে জেএমবির তহবিলে ৮০ লাখ টাকা দিয়েছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে এ তথ্য পেয়েছে পুলিশ। জেএমবির তহবিলে টাকা দিয়ে ডাঃ রোকনউদ্দিন দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। পুলিশের ধারণা, তিনি বর্তমানে সিরিয়ায় অবস্থান করছেন। গত ১৮ জুলাই রাজধানীর খিলগাঁওয়ের চৌধুরীপাড়ার বাসিন্দা ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক রোকনউদ্দিন তার পরিবারসহ নিখোঁজ হন। নিখোঁজদের তথ্য ও ছবি ॥ রাজধানীর গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারি ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নিখোঁজদের তথ্য ও ছবি প্রকাশ করা হয়। নিখোঁজদের প্রথম দফায় তথ্য ও ছবি প্রকাশ করা হয় ১০ জনের ও দ্বিতীয় দফায় ৭ জনের। দ্বিতীয় দফায় যে ৭ জনের তথ্য ও ছবি প্রকাশ করা হয় তার মধ্যে ৫ সদস্যই ডাঃ রোকনুদ্দীনের পরিবারের সদস্য। জঙ্গী আস্তানায় নগদ ৩০ লাখ টাকা গত ৮ অক্টোবর ঢাকার আশুলিয়ার এক বাড়িতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের সময় আব্দুর রহমান আয়নাল (৩০) নামে এক জেএমবি নেতা পাঁচতলা থেকে পড়ে নিহত হন। ওই বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় ৩০ লাখ টাকা। এই টাকাও নব্য জেএমবির তহবিলের। এই টাকার উৎস জানতে নিহত আবদুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গত মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন, গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও অর্থ দুটোই বিদেশ থেকে এসেছে বলে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট তথ্য পেয়েছে। এর আগে গত ১৯ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনিই বলেছিলেন, অর্থটা বাইরে থেকে এসেছে। কিন্তু সেটি বাংলাদেশের কেউ বিদেশ থেকে পাঠিয়েছেন, না কি বাংলাদেশ থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পাঠিয়েছে যাতে ধরা না পড়ে- সেটি এখনও তদন্ত সাপেক্ষ। তিনি সেদিন বলেছিলেন, একটি সূত্র থেকে হুন্ডির মাধ্যমে প্রায় ১৪ লাখ টাকা জেএমবির হাতে আসার কথা তারা জানতে পেরেছেন। কারা ওই অর্থ সংগ্রহ করেছে, সে তথ্যও পেয়েছেন তারা। মধ্যপ্রাচ্য, দুবাইয়ের নাম ছাড়াও যেসব দেশ হুন্ডির হাব হিসেবে পরিচিত, তেমনই এক দেশ থেকে এসেছিল ওই অর্থ।
×