ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শান্তি কমিটির নেতার বিচার চেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা

মকবুল ধোয়া তুলসীপাতা নন, আসল চেহারা বেরিয়ে এসেছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১৯ অক্টোবর ২০১৬

মকবুল ধোয়া তুলসীপাতা নন, আসল চেহারা বেরিয়ে এসেছে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ একাত্তরের চেহারা লুকাতে তুলনামূলক কম পরিচিত নেতা মকবুল আহমাদকে নতুন আমির বানিয়ে রীতিমতো ধোয়া তুলসীপাতা সাজানোর পাঁয়তারা করছে জামায়াত। আমির নির্বাচিত হওয়ার পর এমনকি সোমবার শপথ গ্রহণের পরও গণমাধ্যমে দফায় দফায় বিবৃতি পাঠিয়ে দলগতভাবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দলটি নতুন আমিরকে দাবি করেছেন একজন ‘সৎ’ চরিত্রের মানুষ হিসেবে। তবে আমির হওয়ার পর এবার প্রকাশ্যে চলে এসেছে তার একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী গণহত্যাকারী চেহারা। ফেনী, লক্ষীপুর, নোয়াখালী অঞ্চলের মুুক্তিযোদ্ধারা জামায়াতের আমিরের চেহারা প্রকাশ করে বলেছেন, একাত্তরে মকবুল ছিল ফেনীর দাগনভূয়ার শান্তি কমিটির শীর্ষ নেতা। বহু হত্যার নির্দেশদাতা, অসংখ্য হিন্দুর বড়িঘর আগুন দিয়ে জালিয়ে দেয়া হয়েছে তার নেতৃত্বে। মুক্তিযোদ্ধা ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ হত্যাকা- ও অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দেয়া এ জামায়াত নেতার অবিলম্বে বিচার দাবি করেছেন। উল্লেখ্য, এক মাস আগে ভারপ্রাপ্ত আমিরের পদ থেকে আমিরের পদে আসেন মকবুল আহমাদ। এরপর সোমবার আমির হিসেবে শপথ নেন তিনি। রাজধানীর একটি অজ্ঞাত স্থানে শপথ গ্রহণের পর দলের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে তাকে সৎ চরিত্রের মানুষ হিসেবে বিৃবৃতি পাঠায় জামায়াত। দলটি নিজেদের স্বাধীনতাবিরোধী চেহারা লুকাতে দাবি করেছে, আমির মকবুল আহমাদ ১৯৭১ সালে একটি খ্যাতিমান হাইস্কুলের সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন শিক্ষক ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ’৭১-এর হত্যাকা-সহ বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত পানি অনেকদূর গড়ালেও আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে স্বচ্ছ ও ক্লিন ইমেজের অধিকারী মকবুল আহমাদের বিরুদ্ধে কোথাও কেউ সামান্য কোন অভিযোগ পর্যন্ত দায়ের করেনি। তবে অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীর মতো তার বিষয়েও দলটি একই অবস্থান নিলেও এবার আমির হিসেবে শপথ গ্রহণের পর মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় রাজনীতিবিদরা প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছেন তার আসল চেহারা। জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধী নয় এমন ব্যক্তি নির্বাচিত হয়েছে বলে দলটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দাবি করার মধ্যেই ‘হত্যার নির্দেশদাতা’ হিসেবে সামনে এসেছে নতুন আমির মকবুল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি কমিটির অন্যতম নেতা ও রাজাকার কমান্ডার ছিল বলে অভিযোগ এনেছেন ফেনী জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মীর আবদুল হান্নান, দাগনভূঞা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উপজেলা কমান্ডার শরিয়ত উল্যাহ বাঙ্গালীসহ মুক্তিযোদ্ধারা। ফেনী জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মীর আবদুল হান্নান বলেছেন, ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন মকবুল আহমাদ রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ছিল। তারই নির্দেশে ফেনীর স্থানীয় রাজাকার, আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ফেনী কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা ওয়াজ উদ্দিনকে চট্টগ্রামে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। দাগনভূঞা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উপজেলা কমান্ডার ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীর বিরুদ্ধে মামলার অন্যতম সাক্ষী শরিয়ত উল্যাহ বাঙ্গালী অভিযোগ করেছেন, মকবুল আহমাদের নির্দেশে দাগনভূঞা উপজেলার জয়লস্কর ইউনিয়নের লালপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ায় আগুন দিয়ে ১০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। মকবুল ছিল এ অঞ্চরের শান্তি কমিটির অন্যতম শীর্ষ নেতা। বহু হত্যাকা- হয়েছে তার নির্দেশে। এ মুক্তিযোদ্ধা তদন্ত সাপেক্ষে অবিলম্বে এসব হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত জামায়াত নেতা মকবুল আহমাদের বিচার দাবি করেন। শরিয়ত উল্যাহ বাঙ্গালী আরও বলেন, মকবুল আহমাদের নির্দেশে রাজাকার মোশাররফ হোসেন মশা দাগনভূঞা উপজেলার খুশিপুর গ্রামের আহসান উল্লাহ নামে অন্য এক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। রাজাকার মশা জীবিত আছে। তার বাড়ি একই উপজেলার সাফুয়া গ্রামে। রাজনৈতিক জীবনে ফেনী ২ আসন থেকে ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে হেরে যায় মকবুল আহমাদ। আমির হওয়ার খবর প্রকাশের পর তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব ও লক্ষীপূর- ১ (রামগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য লায়ন এম এ আউয়াল বলেছিলেন, আমির নির্বাচিত হওয়ার পরও আমরা বলেছি সে ছিল ওই অঞ্চলের যুদ্ধাপরাধী। মকবুল আহমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের চিত্র খতিয়ে দেখা হোক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থাকে তার বিষয়ে তদন্ত করতেও আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমি আশা করি শীঘ্রই মকবুলের একাত্তরের ভূমিকা খতিয়ে দেখা হবে। তার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের তদন্ত সংস্থার খোঁজখবর নেয়া জরুরী। এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারের কাজ চলমান থাকলেও ’৭১-এর ঘাতক, তালিকাভুক্ত রাজাকার, কেন্দ্রীয় জামায়াতের আমির মকবুলসহ এই অঞ্চলের দুই শতাধিক রাজাকার এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। জানা গেছে, মকবুল আহমাদের গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার পূর্বচন্দ্রপুর ইউনিয়নের ওমরাবাদে। ফেনী মডেল হাইস্কুলের শিক্ষকতা থেকে অবসরের পরই জামায়াতের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়। ২০০৮ সালে মহজোট ক্ষমতায় আসার পর পরই গ্রামের বাড়ি যাওয়া থেকে বিরত থাকে সে। রুকন থেকে পর্যায়ক্রমে দলটির অঞ্চলভিত্তিক পরিচালক, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও নায়েবে আমিরের দায়িত্ব পালন করেছে। জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী গ্রেফতারের পর ৬ বছরেরও বেশি সময় সে দলটির ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পালন করছিল। এ সময় সে আত্মগোপনে থেকেই দল পরিচালনা করেছে। ফেনী জেলা মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, একাত্তরের মুক্তিকামী মানুষের রক্তের দাগে রঞ্জিত এমন একজনকে শীর্ষ নেতৃত্বে বসিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের কলঙ্ককে অলঙ্কার হিসেবে ধরে রাখতে চাচ্ছে জামায়াত। আবার মিথ্যা বক্তব্য গণমাধ্যমে পাঠিয়ে একাত্তরের অপকর্ম লুকাতে চায় দলটি। এদিকে নানা বিতর্ক নিয়ে কথা বলেছে জামায়াতের নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর। সে দাবি করেছে, মকবুল আহমাদের ১৯৭১ সালে রাজাকার কমান্ডার হওয়ার প্রশ্নই আসে না। স্বচ্ছ ও ক্লিন ইমেজের অধিকারী মকবুল আহমাদের বিরুদ্ধে কোথাও কেউ সামান্য কোন অভিযোগ পর্যন্ত দায়ের করেনি। দলের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মী নতুন আমিরকে একজন সৎ চরিত্রের মানুষ বলে জানে। যদিও এ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত এমনকি একাত্তরে গণহত্যার দায়ে ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পরেও সকল অপরাধীকে তারা সৎ ও নির্দোষ বলেই দাবি করে এসেছে।
×