ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ধামাইল বাঁচানোর আকুতি

শ্রীহট্ট জেলার প্রাচীন নৃত্যগীত, সমৃদ্ধ লোক ঐতিহ্য

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১৯ অক্টোবর ২০১৬

শ্রীহট্ট জেলার প্রাচীন নৃত্যগীত, সমৃদ্ধ লোক ঐতিহ্য

মোরসালিন মিজান ॥ লোক ঐতিহ্যের গানের সমৃদ্ধ একটি ধারার নাম ধামাইল। গান নয় শুধু, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের নৃত্যগীত। মূলত সিলেট অঞ্চলে এই গানের চর্চা পরিলক্ষিত হয়। গানের কথায় সুরে রাধা কৃষ্ণের প্রেম। লীলা। উপস্থাপনাও বৈচিত্র্যপূর্ণ। দেখে শুনে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। সব মিলিয়ে ভাটি বাংলার সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ধামাইল। একসময় এই ঘরের উঠোন, ওই ঘরের উঠোন জমিয়ে রাখতেন শিল্পীরা। এখন নানা টানাপোড়েন। শিল্পীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। কোন ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় বিলুপ্তির পথ ধরেছে বহুকালের পুরনো নৃত্যগীত। নিবেদিতপ্রাণ কর্মী গবেষক সংগ্রাহকদের মন খারাপ। ধামাইল বাঁচিয়ে রাখার আবেদন জানিয়ে যাচ্ছেন তারা। কেউ না কেউ এগিয়ে আসবেন। কিছু না কিছু হবেই- এই তাদের আশা। যতদূর জানা যায়, ‘ধামা’ থেকে ধামাইল শব্দটির উৎপত্তি। ধামা মানে উঠোন। অনেকের মতে, বাড়ির উঠোনে পরিবেশিত হয় বলেই এর নাম ধামাইল। আরও দু’ একটি ব্যাখ্যা অবশ্য আছে। সেগুলোর তুলনায় এই ব্যাখ্যাটি যথার্থ বলে মনে হয়। ধামাইল নৃত্যগীতের প্রাণপুরুষ রাধারমণ। দীন শরৎ, মহেন্দ্র গোসাই প্রমুখের নাম বাদ দিলে বর্তমানে ধামাইল গান বলতে রাধারমণের ধামাইল গীতকেই বোঝায়। এই ধারার অসংখ্য গান রচনা করেছেন তিনি। রাধারমণ দত্তের আচারকেন্দ্রিক বিভিন্ন সঙ্গীত রয়েছে। বাদ্যবরণ, সতুরকাটা, পানখিলি, পাশাখেলা, রূপসঙ্গীত ইত্যাদি গান মূলত ধামাইল গানের মোড়কে প্রকাশিত। রাধারমণের সঙ্গীতের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য লোকসংশ্লিষ্টতা। এই সংশ্লিষ্টতা অভিযোজনে দাঁড়িয়ে লোকনারী। ধামাইলের বেলায় প্রবণতাটি সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয়। ধামাইলে পুরুষের অংশগ্রহণের কোন সুযোগ নেই। নারী শিল্পীদের দলবদ্ধ পরিবেশনা। ঘরের বউ ঝিরাই পরিবেশন করেন। সম্মেলক গান বা নাচের প্রচলিত ভঙ্গি তারা অনুসরণ করেন না। বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে স্থান পরিবর্তন করতে করতে গান করেন। কোন বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার নেই। ১৫ থেকে ২০ জন নারী শিল্পী সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে হাতে তালি বাজান। পা দিয়ে মাটিতে মৃদু আঘাত করেন। এভাবে তাল রক্ষা করা হয়। দেশের বিশিষ্ট সঙ্গীত গবেষক ড. করুণাময় গোস্বামীর বলাটি এরকম- ‘মেয়েরা দলবদ্ধভাবে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে হাতে তালি দিয়ে ও পায়ে মাটিতে আঘাত করে তাল রক্ষা করে এই নাচ নাচে। কৃষ্ণ বা গৌরাঙ্গলীলার লৌকিক রূপ এই গানের বিষয়। এতে এক একটি বিষয় বা কাহিনী নিয়ে তার বিভিন্ন অংশ পর্যায়ক্রমে পরিবেশন করা হয়।’ সঙ্গীতের কিংবদন্তি হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর লোকসঙ্গীত সমীক্ষাতে এ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। ধামাইলের প্রশংসা করে তিনি লিখেছেনÑ ‘লৌকিক নৃত্যে বাংলাদেশ অত্যন্ত দীন, যা-ও বা ছিল তাও লুপ্তপ্রায় বা বিকৃত। কিন্তু শ্রীহট্টের মেয়েরা এক প্রাণবন্ত নৃত্যধারাকে প্রবাহিত রেখেছেন তাঁদের ধামাইল নৃত্যে। সেই ধামাইল নৃত্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ধামাইল গান। শ্রীহট্ট জেলার এ একান্তই নিজস্ব জিনিস।’ এই ধারার নৃত্য গীতের বিষয় বৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারণা দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘বাংলার লোকসংগীতে বৈরাগ্য ও বিচ্ছেদের অন্তর্লীন ভাবটি প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু, ধামাইল গান ভাবের দিক থেকে মূলত রাধা-কৃষ্ণ প্রেমকে অবলম্বন করে রচিত হলেও, সুরে ও ছন্দে তা বিরহ-বিচ্ছেদ বা বৈরাগ্যকে অতিক্রম করে পার্থিব উল্লাসে ভরপুর।’ হেমাঙ্গ বিশ্বাস ধামাইলের প্রকারভেদ নির্ণয় করে লিখেছেন, ‘এর বহু রূপ আছে। কিন্তু সুরের দিক থেকে তা মূলতঃ ভাটিয়ালির ঠাটের ভিতরেই। তবে, ভাটিয়ালির টান বা মীড়ের আন্দোলন না থাকাতে প্রকাশভঙ্গি গেছে সম্পূর্ণ পালটে।’ এক সময় বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের আনাচে কানাচে ধামাইলের চর্চা হতো। সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার জেলা ছিল বিশেষ প্রসিদ্ধ। জনপ্রিয়তার কারণে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, কুমিল্লা, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে ধামাইল। এখানেই শেষ নয়, সিলেট থেকে ভারতের ত্রিপুরা, করিমগঞ্জ, কাছাড়, আসাম, হাইলাকান্দি, শিলচর এলাকায় ছড়িয়ে পরে ধামাইল। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, বিবাহ, অন্নপ্রাসন, মঙ্গলাচরণ, জন্মদিন, খাতনা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে ধামাইল পরিবেশিত হতো। কিন্তু আজ পরিবর্তনের ধারায় বিলুপ্তির পথ ধরেছে ধামাইল নৃত্যগীত। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যত দিন যাচ্ছে শিল্পী সংখ্যা কমে আসছে। বিলুপ্ত হচ্ছে দল। ধামাইলের নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক ও সংগ্রাহক শ্রীমঙ্গলের রামকৃষ্ণ সরকার। কিশোর বয়সে এই ধারার সঙ্গীতের প্রেমে পড়েছিলেন। এখনও ধামাইল গান সংগ্রহের কাজ করেন। নিজে উদ্যোগী হয়ে একটি দল গঠন করেছিলেন। গত কয়েক বছর আগে ঢাকায়ও ধামাইল পরিবেশন করে গেছে দলটি। অদ্ভুত সুন্দর এবং আকর্ষণীয় পরিবেশনা এখনও চোখে লেগে আছে রাজধানীর সংস্কৃতি কর্মীদের। কিন্তু অতি সম্প্রতি দলটির কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কেন? জানতে চাইলে রামকৃষ্ণ সরকারের কণ্ঠ বিধ্বস্ত শোনায়। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, চাকরি ব্যবসা সব ভুলে ধামাইল নিয়ে ছিলাম। গ্রামে গ্রামে ঘুরে গান সংগ্রহের কাজ করেছি। ২০১২ সালে ১৪ থেকে ১৫ জন শিল্পী খুঁজে নিয়ে গঠন করেছিলাম ‘নব নাগরী ধামাইল সংঘ’। এর পর থেকে বহু প্রতিবন্ধকতার মধ্যেই কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়েছে। কিন্তু আর পারছিলাম না। গত আগস্টে দলটি বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হই। তিনি জানান, শিল্পীর অভাবই এর মূল কারণ। সদস্যদের অনেকের বিয়ে হয়ে গেছে। অন্য গ্রামে চলে গেছেন তারা। সামাজিক বাধার কারণে নতুন শিল্পীরা আগ্রহী হচ্ছেন না। তার চেয়ে বড় সমস্যা পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। তিনি বলেন, চর্চাটির প্রতি সরকার মনোযোগী হলে ইতিবাচক অনেক কিছু এখনও করা সম্ভব। বিশেষ করে শিল্পীদের আর্থিক দিকটি নিয়ে কাজ করা গেলে ধামাইল রক্ষা করা অসম্ভব নয়। কাতর কণ্ঠে সরকারের প্রতি ধামাইল রক্ষার জোর দাবি জানান তিনি। ধামাইল নিয়ে ভাল কাজ করছেন সিলেটের আরেক গবেষক সুমন কুমার দাস। জনকণ্ঠকে তরুণ গবেষক বলেন, সুনামগঞ্জসহ অন্য জেলাগুলোতে এখনও অনেক শিল্পী আছে। শিল্পী সংগঠকদের আগ্রহের কমতি নেই। প্রেম নিয়েই কাজ করছেন। কিন্তু কত আর পারা যায়? এ পর্যায়ে সরকারী উদ্যোগ জরুরী বলে মত দেন তিনি। বলেন, গান ও সুর সংগ্রহ ও সংরক্ষণসহ বিভিন্ন দিক নিয়ে জরুরী ভিত্তিতে কাজ করা প্রয়োজন। সরকার যদি গুরুত্বের জায়গাটা ধরতে পারে তাহলে উত্তরণ সম্ভব। রাজধানী শহরে ধামাইল নিয়ে কাজ করছেন রাধারমণের গানের জনপ্রিয় শিল্পী ও সংগঠক বিশ্বজিৎ রায়। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ধামাইল সিলেটের নয় শুধু, বাংলাদেশের লোক ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ। এই ধারাটি বাঁচিয়ে রাখা খুব জরুরী। আমরা আমাদের চেষ্টা করছি, করব। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে। তা না হলে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হব। ধামাইল বিষয়ে কথা হয় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গেও। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সমৃদ্ধ লোকসঙ্গীত ও সংস্কৃতির অন্যতম একটি ধারার নাম ধামাইল। এই ধারার নৃত্যগীত একইসঙ্গে আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন। এ কারণে ধামাইল নৃত্যগীতকে বাঁচিয়ে রাখতে ও প্রচার প্রসারে কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। ধামাইল বাঁচাতে যা যা করণীয় সরকার করবে বলেও আশ্বাস দেন দেশের বিশিষ্ট এই সংস্কৃতিজন।
×