ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাসেলের জন্মদিনে শেখ হাসিনা

বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে শিশুদের আধুনিক জ্ঞানার্জন করতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৯ অক্টোবর ২০১৬

বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে শিশুদের আধুনিক জ্ঞানার্জন করতে হবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শিশুদের আধুনিক জ্ঞান-প্রযুক্তিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার ওপর জোর দিয়ে বলেছেন, ঘাতকের দল চেয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও ছোট্ট শেখ রাসেলকে হত্যা করে বাঙালী জাতির সমস্ত অর্জন নস্যাত করে দিতে। কিন্তু তারা সেটা পারেনি। আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। অন্ধকার যুগ থেকে আমরা আলোর পথে যাত্রা শুরু করেছি। আর এ আলোর পথে যাত্রার মশাল তোমরাই (শিশু-কিশোর) বহন করে নিয়ে যাবে। মঙ্গলবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের ৫২তম জন্মদিন উপলক্ষে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত শিশু-কিশোরদের উদ্দেশে করে আরও বলেন, তোমরাই হলে দেশ ও জাতির আগামী দিনের কর্ণধার। তাই বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তোমাদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। আর দেশের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। কেননা, যে কোন মহৎ কাজ অর্জিত হয় ত্যাগের বিনিময়েই। বাংলাদেশ আজ যে পর্যায়ে এসেছে, এ পর্যায়ে আনতে অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডিকে দেশ ও বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম সন্ত্রাসবাদী ঘটনা আখ্যা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কেবল জাতির পিতাকেই নয়, পুরো পরিবারকে হত্যা করা হলো। ছোট্ট রাসেলকে হত্যা করা হলো। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি হয়ে গেল খুনীর জাতি। আমরা চাই না এ ধরনের ঘটনা আর ঘটুক, আর কোন শিশুকে এভাবে জীবন দিতে হোক। তিনি বলেন, আমি চাই না সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ এদেশে থাকুক। কেননা, সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে বড় আঘাতের শিকার আমরাই হয়েছি। এদেশ হবে শাস্তির দেশ, সমৃদ্ধির দেশ। জানি এ লক্ষ্য অর্জন অনেক কঠিন। কিন্তু আমাদের পারতে হবে। তিনি বলেন, শিক্ষিত জাতি না হলে দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়া যাবে না। শিক্ষায় ঘটাবে সব অন্ধকার যুগের অবসান। তাই জঙ্গীবাদ ও মাদকাসক্তের পথ পরিহার করে আগামী প্রজন্মকে নিজেদের আদর্শবান হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি। শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান রকিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেনÑ অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, মাহমুদ উস সামাদ এমপি, সিরাজুল ইসলাম মোল্লা এমপি, কেএম শহীদুল্লাহ, মুজিবুর রহমান হাওলাদার, মুজাহিদুর রহমান হ্যালো এবং শিশু-কিশোরদের পক্ষে নাফিস বিন নাদিম। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত দাবা, চিত্রাঙ্কন ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার বিজয়ী শিশু-কিশোর এবং কৃতী ছাত্রছাত্রীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন এবং বিজয়ীদের সঙ্গে ফটোসেশনে অংশ নেন। সবশেষে শিশু-কিশোরদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শিশুদের আধুনিক জ্ঞান-প্রযুক্তিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়ে প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর সরকার যে এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, তা দেশের ভবিষ্যত কর্ণধার শিশুদের জন্যই। বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে যে সম্মান পেয়েছে তা ধরে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয়ী জাতি। বিজয়ী জাতি হিসেবেই আমরা বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে চলব। এ প্রতিজ্ঞা নিয়েই সবাইকে চলতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলতেন, বাঙালী জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। অনেক চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র হয়েছে, কিন্তু বাঙালী জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি। পারবেও না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা হচ্ছে, তা কেবল বর্তমান প্রজন্মের জন্য নয়, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যও। বাংলাদেশের একটি মানুষও ক্ষুধার্ত থাকবে না, গৃহহারা থাকবে না। প্রতিটি শিশু স্কুলে যাবে, শিক্ষা পাবে, মেধা বিকাশের সুযোগ পাবে। সে ধরনের সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলাই আমার লক্ষ্য। ভবিষ্যত কা-ারি হিসেবে গড়ে উঠতে শিশুদের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সবাইকে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। মানুষের মতো মানুষ হতে হবে। পিতা-মাতা, অভিভাবক, শিক্ষকদের কথা শুনতে হবে। দেশ অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা শুরু করেছে। এ যাত্রায় তোমাদেরই হাল ধরতে হবে। দেশ ও জাতির কল্যাণে যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে হবে। আবেগজড়িত কন্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৫ আগস্ট যে ঘটনা ঘটেছে, তার সঙ্গে একমাত্র কারবালার ঘটনার সঙ্গেই তুলনা করা যায়। কারবালাতেও বোধ হয় শিশুদের হত্যা করা হয়নি। কিন্তু ১৫ আগস্ট একই সঙ্গে তিনটি বাড়িতে হামলা চালিয়ে শিশুদেরও হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ দিয়ে আইন করে খুনীদের বিচারের হাত থেকে রেহাই দেয়া হয়েছিল। বিভিন্ন দেশে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে এ ধরনের ঘৃণ্য নজির আছে বলে আমার জানা নেই। ছোট ভাই সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে আবেগাক্রান্ত বড় বোন শেখ হাসিনা বলেন, দেশের সব শিশুর মাঝে হারানো ছোট ভাই রাসেলকে খুঁজে পাই। একটি প্রশ্নই বারবার জাগে- কী অপরাধ ছিল ছোট্ট রাসেলের যে এভাবে নৃশংস হত্যাকা-ের শিকার হতে হলো? মাকে আব্বা বলে ডাকত রাসেল ॥ ছোট ভাই রাসেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন বড় বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর আবেগজড়িত স্মৃতিচারণে মিলনায়তনে উপস্থিত শত শত শিশু-কিশোরের চোখ বেয়ে পানি ঝরতে দেখা গেছে। পিনপতন নীরাবতায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, জন্মের পর থেকে রাসেল বড় হয়েছে পিতা-মাতা, ভাই সবার স্নেহ নিয়ে। কিন্তু কতটুকু পেয়েছে পিতৃস্নেহ? তাকে বড় হতে হয়েছে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েই। ছোট্ট রাসেলকে পিতার স্নেহবঞ্চিত হয়েই বড় হতে হয়েছে। যখনই আমরা কারাগারে যেতাম বাবাকে দেখতে, রাসেলকে নিয়ে আসা কঠিন ছিল। অনেক কষ্ট করে তাকে নিয়ে আসতে হতো। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন রাসেল কথা বলতে শুরু করল সে বাবাকে খুঁজে বেড়াত। তখন মা তাকে বলত, আমিই তো তোমার বাবা। মাকে সে আব্বা বলেও ডাকত, মা বলেও ডাকত। তিনি বলেন, আবার আমরা যখন কারাগারে দেখতে যেতাম তখন অবুঝ হৃদয় বাবাকে আব্বা বলে ডাকত, আবার মাকে আব্বা বলে ডাকত। এভাবেই ছোট রাসেল বেড়ে উঠেছে। আমরা সবাই পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ছোট্ট রাসেলের কথা সব সময় মনে হয়। সে আমার চেয়ে অনেক ছোট। ৬৪ সালে রাসেলের যখন জন্ম হয় আব্বা তখন ভীষণ ব্যস্ত। পাকিস্তানে তখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। রাসেল তো আমার কোলে-পিঠে বড় হয়েছে। তার সঙ্গে কত খেলা করেছি, কত ছবি তুলেছি। কথাগুলো বলার সময় প্রধানমন্ত্রী বার বার আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছিলেন। কাঁদো কাঁদো গলায় কথা বলছিলেন। আগত বিপুলসংখ্যক শিশু-কিশোরসহ দর্শক-শ্রোতাদের অনেককেও চোখের পানি মুছতে দেখা যায়। রাসেলের নির্মমভাবে নিহত হওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, কী দোষ ছিল ছোট্ট রাসেলের। ঘাতকের দল রাসেলকেও ছাড়েনি। তাকেও সবার শেষে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ঘাতকদের একটা উদ্দেশ্য ছিলা- বঙ্গবন্ধুর রক্তের একটুকু চিহ্নও যেন না থাকে। তাছাড়া বাচ্চাটাকে সবার শেষে কষ্ট দিয়ে....। কত ছোট একটা জীবন রাসেলের। রাসেলের কী অপরাধ ছিল? শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আব্বাকে গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হলো। ছয় মাস তাঁর দেখা পাইনি। সে সময়ও রাসেল রাতের বেলা চিৎকার করে কাঁদত ‘আব্বা, আব্বা’ বলে। আমরা ছুটে যেতাম তাকে সান্ত¡না দিতে। কিন্তু আমরা কী সান্ত¡না দেব। আমরা নিজেরাও তো পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিলাম। স্বজন হারানোর বেদনা কত নির্মম তা আমরা বুঝি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কী অপরাধ ছিল আমাদের পরিবারের? অপরাধ ছিল একটিই, জাতির পিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। বাঙালী জাতি বিজয় অর্জন করেছিল। তাই পরাজিত শক্তির দোসররাই এ হত্যাকা- ঘটিয়েছে। আর কারা পরাজিত শক্তির দোসর সেটাও আমাদের জানা। যারা আমাদের বাড়িতে এসেছে, থেকেছে, খেয়েছে- তারাই ঘাতক হয়ে আমাদের বাড়িতে এসে হত্যা করেছে। কী দুর্ভাগ্য বাঙালী জাতির! দেশের বাইরে থাকায় ছোট বোন শেখ রেহানাসহ নিজের বেঁচে যাওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, স্বজন হারানোর নির্মম বেদনা নিয়ে দেশে ফিরে এসেছি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন পূরণ করতে। যে দুঃখী মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে আমার বাবা সারাজীবন ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের মুখে হাসি ফোটানোই আমার লক্ষ্য।
×