ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামের নাম রাকুদিয়া;###;‘বাঙালীরা অত্যন্ত পরিশ্রমী। তারা কাজ করতে পারে। তাই পিছিয়ে পড়ে না’

বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট স্বচক্ষে দেখলেন দারিদ্র্য জয়

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৯ অক্টোবর ২০১৬

বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট স্বচক্ষে দেখলেন দারিদ্র্য জয়

খোকন আহম্মেদ হীরা, রাকুদিয়া থেকে ফিরে ॥ সবুজের সমারোহের গ্রামটিকে সাজানো হয়েছিল অপরূপ সাজে। বাদ যায়নি গোয়ালঘর থেকে পুকুর আর হাঁস-মুরগির খামার পর্যন্ত। প্রাণের স্পন্দন ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রামের ১৯৮টি পরিবারের মাঝে। তারা বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে বরণ করে নিয়েছেন প্রিয় মানুষটিকে। তিনি বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। তাঁকে শুনিয়েছেন নিজেদের দারিদ্র্য জয়ের গল্প। সচক্ষে তাকে দেখানো হয়েছে, কীভাবে তারা নিজেদের দারিদ্র্যকে অল্প সময়ের মধ্যে পাঠিয়েছেন জাদুঘরে। ঘটনাটি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার দেহেরগতি ইউনিয়নের দক্ষিণ রাকুদিয়া গ্রামের। ওই গ্রামের হতদরিদ্র ১৯৮ জন নারীর ভাগ্যবদলের চিত্র সচক্ষে দেখতে মঙ্গলবার সকালে এসেছিলেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতাধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (এসডিএফ) নামের একটি সংস্থার আমন্ত্রণে তাদের নতুন জীবন নামের একটি প্রকল্পের কার্যক্রম পরিদর্শন করেছেন তিনি। গ্রামের হতদরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করতে ওই প্রকল্পে অর্থায়ন করে আসছে বিশ্বব্যাংক। মঙ্গলবার সকাল পৌনে নয়টার দিকে বিশেষ হেলিকপ্টারযোগে বরিশাল বিমানবন্দরে অবতরণ করেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। বিমানবন্দরে তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে স্বাগত জানান, জাতীয় সংসদের প্যানেল স্পীকার এ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস এমপি, জেলা প্রশাসক ড. গাজী মোঃ সাইফুজ্জামান, মেট্রোপলিটন (বিএমপি) পুলিশ কমিশনার এসএম রুহুল আমিন ও জেলা পুলিশ সুপার এসএম আক্তারুজ্জামান, বাবুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আফরোজা বেগম পারুলসহ প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা। বিমানবন্দর থেকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সড়কপথে তিনি (বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট) দক্ষিণ রাকুদিয়া গ্রামে পৌঁছলে সেখানে তাকে অভ্যর্থনা জানান দেহেরগতি ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ মশিউর রহমান। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট প্রায় একঘণ্টা রাকুদিয়া গ্রামে অবস্থান করে ঘুরে দেখেছেন ওই গ্রামের কয়েকটি বাড়ির ক্ষুদ্র গরু ও হাঁস-মুরগির খামার, পুকুরের মাছ চাষ, বাড়ির আঙ্গিনা এবং পতিত জমিতে সবজি ও ফসলের চাষ, কম্পোস্ট সার তৈরি করে ক্ষুদ্র ঋণ সহায়তার মাধ্যমে দারিদ্র্য জয়ের চিত্র। এ সময় তিনি গ্রামের দারিদ্র্য জয়ী নারীদের কাছ থেকে তাদের অর্জিত সাফল্যের গল্প শুনেছেন। গ্রামের নারীদের ভাগ্যবদল ও দারিদ্র্য জয়ের চিত্র সচক্ষে দেখে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বলেন, বাঙালীরা অত্যন্ত পরিশ্রমী, তারা কাজ করতে পারে, পিছিয়ে পড়ে না। বরিশালে এসে আমি খুব খুশি হয়েছি। এখানে আমরা বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন করছি। আগে এখানকার নারীরা অতিদরিদ্র ছিল। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল না। তিনি আরও বলেন, গরু পালন, মাছের চাষ করে তারা আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাদের ছেলে-মেয়েরা আগে স্কুলে যেত না। এখন যাচ্ছে। সবকিছুই ভাল লেগেছে। আমরা ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে আরও অর্থ দিয়ে সহায়তা করব। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম আরও বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে রাকুদিয়ার এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অন্য দেশও সুফল পাবে। দারিদ্র্য বিমোচনে রাকুদিয়া তথা বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য নতুন ধারণার প্রবর্তন যে খুবই জরুরী, তা বাংলাদেশ দ্রুত সময়ে অনুধাবন করতে পেরেছে। দারিদ্র্য জয়ী দক্ষিণ রাকুদিয়া গ্রামের গৃহবধূ শিউলি বেগম বলেন, ২০১২ সালে এসডিএফ থেকে বিশ্বব্যাংকের নতুন জীবন প্রকল্পের মাধ্যমে আমি ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি গাভী ক্রয় করি। এরপরে সেই গাভীর দুধ বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করি। পরের বছর ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে আরও একটি গাভী ক্রয় করেছি। বর্তমানে আমার খামারে থাকা চারটি গাভীর গোবর দিয়ে তৈরি করেছি কম্পোস্ট সার। এখন বছরজুড়ে শুধু কম্পোস্ট সার বিক্রি করেই আমার আয় হচ্ছে প্রায় ১৫ হাজার টাকা। সেই সঙ্গে বাজারে প্রতিদিন বিক্রি করা হয় গাভীর ১০ লিটার দুধ। গাভী পালনের মাধ্যমে আজ আমার অভাবের সংসারে ফিরে এসেছে সুখ ও স্বচ্ছলতা। এই সাফল্যের গল্প শুধু শিউলি বেগমের একারই নয়। দক্ষিণ রাকুদিয়া গ্রামের ১৯৮টি পরিবারেই রয়েছে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের এমন অসংখ্য কাহিনী। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট তাদের মুখেই সেই সাফল্যের গল্প শুনেছেন। এসডিএফ দেহেরগতি ইউনিয়নের ফেসিলেটর নকিবুল ইসলাম জানান, ২০১২ সালে এই এলাকায় সংস্থার কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর তারা দেহেরগতি ইউনিয়নে ১৫টি সমিতির মাধ্যমে সদস্য সংগ্রহ শুরু করেন। বর্তমানে ১৫টি সমিতির আওতায় তাদের সদস্য রয়েছে ১ হাজার ৮৪৪ জন। একই চিত্র বাবুগঞ্জের চাঁদপাশা ইউনিয়নে। সেখানেও ১৫টি সমিতির আওতায় সদস্য রয়েছে ১ হাজার ৮১৩ জন। তিনি বলেন, সমিতিতে সঞ্চয়ের পাশাপাশি তারা ঋণ নিয়ে গাভী ও মুরগি পালন, মাছ চাষ, কৃষি কাজের মাধ্যমে হতদরিদ্রদের স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করছেন। বরিশালের জেলা প্রশাসক জানান, বিশ্বব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণ সহায়তার মাধ্যমে নিজেদের পরিশ্রমের দ্বারা অতি অল্প সময়ে দারিদ্র্য দূর করেছে রাকুদিয়া গ্রামের ১৯৮টি পরিবার। ফলে ক্ষুধামুক্ত জীবন, অভাবমুক্ত সংসার আর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ধন্য রাকুদিয়া গ্রামটি আজ দক্ষিণাঞ্চলের মডেল গ্রামে রূপান্তরিত হয়েছে। যা বিশ্বে একটি মডেল হতে পারে। সেই খবর শুনেই তাদের সফলতার কাহিনী শুনতে এসেছিলেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। একইদিন বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নির্মিত উজিরপুর উপজেলার বামরাইল ইউনিয়নের ভরসাকাঠী গ্রামে নবনির্মিত সাইক্লোন সেল্টার পরিদর্শন করে সেখানে একটি নারকেল গাছের চারা রোপণ করেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। পাশাপাশি ওই এলাকায় গ্রামীণ শক্তি ও টিএমএসএস’র পরিচালিত সৌরবিদ্যুতের সুফলভোগী মমতাজ বেগমের বাড়ি পরিদর্শন করেন। পরবর্তীতে তিনি (বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট) দুপুর ১২টার দিকে বরিশাল থেকে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হন।
×