ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তাজকিয়া নুর মুন

এক টেস্টে দুই পাকিস্তানীর ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ১৯ অক্টোবর ২০১৬

এক টেস্টে দুই পাকিস্তানীর ইতিহাস

দুবাইয়ে হয়ে গেল উপমহাদেশের মাটিতে প্রথম ডে-নাইট টেস্ট ম্যাচ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে দ্বৈরথটি ছিল পাকিস্তানের ৪০০তম আয়োজন। সেটিকে স্মরণীয় করে রাখলেন দেশটির দুই তারকা আজহার আলী ও ইয়াসির শাহ। ফ্লাডলাইটের আলোয় সাদা পোশাকের ক্রিকেটে প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে তাক লাগিয়ে দেন আজহার, আর মাত্র ১৭ টেস্টেই ১০০ উইকেট নিয়ে দ্রুততম শিকারের ইতিহাসে দ্বিতীয় স্থানে জায়গা করে নেন ইয়াসির! আজহারের ট্রিপল সেঞ্চুরির সৌজন্যে ৩ উইকেটে ৫৭৯ রানের পাহাড় গড়ে প্রথম ইনিংস ঘোষণা করে পাকিস্তান। প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ডে-নাইট টেস্টে প্রথম দিনেই সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছিলেন, দ্বিতীয় দিন সেটিকে কেবল ডাবলেই রূপ দেননি, অনন্য ‘ট্রিপলে’ নিয়ে যান আজহার! পাকিস্তানী ওপেনার খেলেন অপরাজিত ৩০২ রানের মনোমুগ্ধকার ইনিংস। মাত্র চতুর্থ পাকিস্তানী হিসেবে ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকান আজহার। ১৫৬তম ওভারের তৃতীয় বলে জার্মেইন ব্ল্যাকউডকে কাভার অঞ্চল দিয়ে বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে ইতিহাসে নাম লেখান আজহার। চতুর্থ পাকিস্তানী ও টেস্ট ইতিহাসের ২৫তম ব্যাটসম্যান হিসেবে ট্রিপল সেঞ্চুরি করেন তিনি। ঠিক তখনই ইনিংস ঘোষণা করে দেন মিসবাহ-উল হক। যা টেস্টের ২৯ নম্বর ট্রিপল সেঞ্চুরি, কারণ চারজন ব্যাটসম্যান দুবার করে এই কীর্তি গড়েন। পাকিস্তানের হয়ে এর আগে ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন গ্রেট হানিফ মোহাম্মদ (৩৩৭, বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৯৫৮), ইনজামাম-উল হক (৩২৯ বনাম নিউজিল্যান্ড ২০০২) ও ইউনুস খান (৩১৩ বনাম শ্রীলঙ্কা ২০০৯)। ৫০তম টেস্টে ১১ নম্বর সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে আজহার স্বদেশী সাবেক তারকা মোহাম্মদ ইউসুফের পাশে নাম লিখিয়েছেন। এর আগে নিজের ৫০তম টেস্টে ১১টি করে সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন ইউসুফ। পাকিস্তানের হয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম ৫০ টেস্টে আজহারের চেয়ে বেশি সেঞ্চুরি আছে মাত্র দুজনের, একজন সদ্য প্রয়াত গ্রেট হানিফ মোহাম্মদ। অপরজন আজহারের বর্তমান সতীর্থ ইউনুস খান। দুজনই ৫০ টেস্টে ১২টি করে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন। ৪৬৯ বলে গৌরবময় মাইলফক স্পর্শ করেন আজহার। চার ২৩ ও ছক্কা ২টি। ৬৫৮ মিনিট ক্রিজে থাকেন। গত নবেম্বরে এ্যাডিলেডে প্রথম ডে-নাইট টেস্ট খেলে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। ওই ম্যাচে কেউ সেঞ্চুরির দেখা পাননি। এক বছরের ব্যবধানে গোলাপী বলে ফ্ল্যাড-লাইটের আলোয় আভিজাত ক্রিকেটের রেমাঞ্চকে স্মরণীয় করে রাখলেন পাকিস্তান ওয়ানডে অধিনায়ক। প্রথম দিনেই সেঞ্চুরি তুলে নেয়া আজহার অপরাজিত ছিলেন ১৪৬ রান করে। দ্বিতীয় দিনেও ক্যারিবীয় বোলারদের তুলোধুনো করেছেন। ১৯ চার ও ১ ছক্কায় ডাবল সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ৩৫৭ বলে। একই দিনে সেটিকেও ছাড়িয়ে যান। ডে-নাইট টেস্টের প্রথম সেঞ্চুরিটাকে ডাবল ছাড়িয়ে ট্রিপলে রূপ দেন ক্ল্যাসিক্যাল ওপেনার। চার মেরে যখন দু-হাত উঁচিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠেন দুবাই স্টেডিয়ামের গ্যালারি তখন দাঁড়িয়ে, দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের ড্রেসিং রুম। সম্মান জানান প্রধান নির্বাচক ইনজামাম-উল হক, কোচ মিকি আর্থার ও অন্যন্য কর্মকর্তারা। অধিনায়ক মিসবাহ এসে বুকে জড়িয়ে নেন। ও হ্যাঁ, মিসবাহর সৌজন্যে ইদানীং পাকিস্তানী উদ্যাপনের ট্রেন্ড হয়ে যাওয়া সেই ‘বুক ডনও’ দিয়েছেন আজহার! ব্যাট হাতে অনন্য এক ইতিহাস গড়েন ৩১ বছর বয়সী পাঞ্জাব-তারকা। একই টেস্টের প্রথম ইনিংসে ইতিহাসে দ্রুত ১শ’ উইকেট শিকারের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে জায়গা করে নেন আজহার-সতীর্থ ইয়াসির। প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়ে ৮৫ বছর পর এমন নজির স্থাপন করেন পাকিস্তানী লেগস্পিনার। ১৭ টেস্টেই ১০০ উইকেট শিকার করেন ‘সেনসেশনাল’ এ ঘূর্ণিতারকা। ইয়াসির অনন্য এই রেকর্ডে যৌথভাবে দ্বিতীয় স্থানে নাম লেখান। সমানসংখ্যক টেস্টে ১শ’ উইকেট নিয়ে সঙ্গী হয়েছেন চার্লস টার্নার (১৮৮৭), সিডনি বার্নস (১৯০১) ও ক্লারি গ্রিমিটের। ইয়াসিরের আগে অস্ট্রেলিয়ার গ্রিমিট রেকর্ডটি গড়েছিলেন সেই ১৯৩১ সালে! ১৬ টেস্টে ১০০ উইকেট নিয়ে তাদের ওপরে কেবল ইংল্যান্ডের জর্জ লোম্যান (১৮৮৬ সালে)। ইয়াসির-বিষে নীল ক্যারিবীয়রা অলআউট হয় ৩৫৭ রানে। দ্বিতীয় দিনই ২ উইকেট পাওয়া ইয়াসির তৃতীয় দিনে আরও তিন উইন্ডিজ ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে ফেরান। ইতিহাস গড়ার পথে তিনি একে একে তুলে নেন কার্লোস ব্রেথওয়েট, লিও জনসন, শেন ডরিখ, জেসন হোল্ডার ও মিগুয়েল কুমিন্সকে। ইনিংসে তার বোলিং ফিগার ৪৩-১৫-১২১-৫। পাকিস্তানের হয়ে দ্বিতীয় দ্রুত ১শ’ উকেট শিকারে এর আগের রেকর্ডটি ছিল সাঈদ আজমলের (১৯ টেস্টে)। সেটি তো ছাড়িয়ে গেছেনই, গোটা উপমহাদেশে এখন সবার ওপরে ইয়াসির। ১৮ টেস্টে শত-শিকারে যেখানে দ্বিতীয় স্থানে রবিচন্দ্রন আশ্বিন। এই ম্যাচ শুরুর আগে যিনি ইয়াসিরকে অগ্রিম শুভেচ্ছা জানিয়ে টুইটার করেছিলেন,‘ইয়াসিরকে আগাম শুভেচ্ছা। খুব সম্ভব সে আমার রেকর্ডটা ভেঙে দিতে যাচ্ছে। অসাধারণ। ওর বোলিং দেখলে আমারও ভাল লাগে।’ আর রেকর্ডটা ১০০ শিকারের পর আরেক টুইটে লেখেন, ‘একটু দেরিতে হলেও আমি ইয়াসিরকে শুভেচ্ছা জানাতে চাই, দারুণ কাজ করেছে সে।’ কৃতজ্ঞ ইয়াসিরের জবাব, ‘আশ্বিন আমাকে শুভকামনা জানিয়েছে, এজন্য অবশ্যই তাকে ধন্যবাদ। বিশ্বের সেরা একজন বোলারের কাছ থেকে এমন বার্তা সত্যিকার অর্থেই দারুণ ব্যাপার। আমি খুবই অনুপ্রাণীত হয়েছি।’ আধুনিক লেগস্পিনকে যারা শিল্পে রূপ দিয়েছেন মুশতাক আহমেদ-শেন ওয়ার্ন তাদের অন্যতম। গত ইংল্যান্ড সফরে একসঙ্গে এই দুই গ্রেটকে স্মরণ করিয়েছিলেন এই ইয়াসির। ক্রিকেট-তীর্র্থ লর্ডসে ২০ বছর আগে পাকিস্তানকে সর্বশেষ টেস্ট ম্যাচ জিতিয়েছিলেন ওয়াকার ইউনুস, সেবার ছিলেন মুশতাক, ১০ উইকেট নিয়ে এবার লর্ডস জয়ের ‘নায়ক’ ইয়াসির। কাকতালীয়ভাবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে পাকিদের স্পিন-দীক্ষায় ছিলেন সেই মুশতাক। ৬ উইকেট নিয়ে প্রথম ইনিংসেই নাম লিখিয়েছিলেন লর্ডসের অনার্স বোর্ডে, দ্বিতীয় ইনিংসে আরও ৪টি। কেবল তাই নয়, গ্রেট শেন ওয়ার্নের পর প্রথম কোন ‘লেগস্পিনার’ হসেবে আইসিসির টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষেও উঠে এসেছিলেন ইয়াসির।
×