ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজ;###;মোঃ মামুন রশীদ

কুকদের পাল্লাই ভারি!

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ১৯ অক্টোবর ২০১৬

কুকদের পাল্লাই ভারি!

৬ বছর বিরতির পর আবার বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজ। সর্বশেষবার ২০১০ সালে পরস্পরের মধ্যে হোম এ্যান্ড এ্যাওয়ে ভিত্তিতে ৪ টেস্ট খেলেছিল দুদল। সবগুলো ম্যাচেই হেরে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। ইংল্যান্ড সফরে পার্থক্যটা গড়ে দিয়েছিল পেসাররা আর বাংলাদেশের মাটিতে হওয়া টেস্ট সিরিজে স্পিনাররাই দাপট দেখিয়েছেন। তবে উপমহাদেশের উইকেটেও ইংলিশ পেসারদের যথেষ্ট সাফল্য আছে দারুণ কিছু করে দেখানোর। এবার আসন্ন দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে লড়াইটা হবে মূলত স্পিনেরই। বাংলাদেশের আসে পেসার সঙ্কট! তবে বাংলাদেশের চেয়ে পেস আক্রমণে সমৃদ্ধ ইংল্যান্ড দলের পুরো বোলিং আক্রমণটাই বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জের হবে। এর সঙ্গে নিয়মিত টেস্ট খেলার দিক থেকেও বড় পার্থক্য আছে শক্তিমত্তায়। গত ১৪ মাস টেস্ট খেলেনি বাংলাদেশ দল। এই দীর্ঘ বিরতির পর টেস্ট দলেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। কিন্তু টানা টেস্ট খেলার মধ্যেই আছে ইংলিশরা। অধিনায়ক এ্যালিস্টার কুকের নেতৃত্বে একঝাঁক নবীনদের নিয়ে দলটি গত দেড় বছরে দারুণ গুছিয়ে উঠেছে এবং সফলতাও পেয়ে যাচ্ছে। র‌্যাঙ্কিং অনুসারে বিবেচনা করলেও শক্তিমত্তায় অনেক এগিয়ে ইংল্যান্ড। আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ে তাদের অবস্থান চারে আর বাংলাদেশ আছে ৯ নম্বরে। শক্তির তারতম্যটা অবস্থানগত দিক থেকেই পরিষ্কার। গত ১৬ বছর ধরে টেস্ট ক্রিকেট খেললেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ দল সেভাবে এ ফরমেটে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি ঘটাতে পারেনি। ধারাবাহিকভাবে টেস্ট না খেলাটাও এর অন্যতম কারণ। অথচ নিয়মিত ওয়ানডে ও টি-২০ ক্রিকেট খেলার কারণে দলের ক্রিকেটারদের মানসিকতায় দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট উপলব্ধিটা ঠিকভাবে কার্যকর হওয়াও কঠিন। গত ১৪ মাসই বাংলাদেশ দল টেস্ট এবং এমনকি জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা চারদিনের ঘরোয়া আসরগুলোতে ঠিকভাবে খেলতে পারেননি। এই ১৪ মাসে শুধু ওয়ানডে ও টি-২০ নিয়ে ব্যস্ত ছিল দল। কিন্তু এই ১৪ মাসে ইংল্যান্ড খেলেছে ১৯ টেস্ট। নৈপুণ্যেও দারুণ উজ্জ্বল ছিল তারা। ২০১৫ সালের জুলাই-আগস্টে মর্যাদার এ্যাশেজ সিরিজে ৩-২ ব্যবধানে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জয়, পরে ক্রমানুসারে পাকিস্তানের কাছে ২-০ ব্যবধানে হার, দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ২-১ জয়, শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ২-০ জয় এবং সর্বশেষ ঘরের মাটিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২-২ সমতায় সিরিজ শেষ করেছে ইংলিশরা। এটাই নিশ্চিত করে দিচ্ছে দুর্দান্ত ফর্মে আছে এ্যালিস্টার কুকরা। সর্বশেষ ২০১২-১৩ মৌসুমে ভারত সফরেও ২-১ ব্যবধানে জয় নিয়ে দেশে ফিরেছে ইংল্যান্ড। ভারতের মাটি থেকে বিদেশী কোন দলের সিরিজ জয় যেখানে অতি কল্পনা সেখানেও সাফল্য। তারপর এটিই তাদের এশিয়া সফর। এ সফরেও শক্তিমত্তায় পরিষ্কারভাবে ফেবারিট হিসেবেই স্বাগতিক বাংলাদেশের মুখোমুখি হবে তারা। কারণ র‌্যাঙ্কিংয়ে আপাতত চারে থাকলেও সমান রেটিং নিয়েই তিনে আছে অস্ট্রেলিয়া। বেশি ম্যাচ খেলায় এক ধাপ পিছিয়ে ইংল্যান্ড। সিরিজে বাংলাদেশকে হোয়াইটওয়াশ করলেই তিনে উঠে যাবেন কুকরা। উপমহাদেশের পরিবেশে বিদেশী দলগুলো ব্যাটিং-বোলিংয়ে দারুণ চ্যালেঞ্জের মুখে থাকে। তবে ইংল্যান্ড ব্যাটিংয়ে অন্যতম শক্তির নাম অধিনায়ক কুক নিজেই। তিনি এশিয়ার মাটিতে ২১ টেস্ট খেলে ৬০.৮৬ গড়ে সর্বাধিক ২২৫২ রান করেছেন তিনি। ২৬৩ রানের একটি বড় ইনিংস ছাড়াও সবমিলিয়ে ৮ সেঞ্চুরি ও ৯ হাফসেঞ্চুরি করেছেন এশিয়ার মাটিতে। এশিয়ার বাইরের কোন দেশের আর কোন ব্যাটসম্যান এত রান করতে পারেননি এশিয়া সফরে। বর্তমান দলে থাকাদের মধ্যেও তিনিই সেরা বাংলাদেশের মাটিতে। ৪ টেস্টে দুটি সেঞ্চুরিসহ ৬৬.৮৩ গড়ে করেছেন ৪০১ রান। এখানেই কিছুটা দুর্বলতা ইংল্যান্ডের। বাকিদের অধিকাংশই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে টেস্ট খেলেননি। তবে তরুণ জো রুট, জনি বেয়ারস্টো, অলরাউন্ডার মঈন আলীরা দারুণ ফর্মে আছেন। কিন্তু দুটি প্রস্তুতি ম্যাচে দেখা গেছে ইংলিশ এই ব্যাটসম্যানদের ভয়াবহ স্পিন দুর্বলতা। আহামরি মানের কোন স্পিনার বিসিবি একাদশের হয়ে না খেললেও সফরকারী ব্যাটসম্যানরা ঘূর্ণিবলের কাছেই মাথানত করেছেন। বাংলাদেশের মূল শক্তি এই স্পিন আক্রমণেই। এবার দলও ঘোষণা করা হয়েছে স্পিন শক্তিটাকে অনেক বাড়িয়ে। টেস্ট পেসার সঙ্কটে দীর্ঘদিন টেস্ট দলের বাইরে থাকা শফিউল ইসলামের সঙ্গে দলে নেয়া হয়েছে নতুন মুখ কামরুল ইসলাম রাব্বিকে। অন্যতম পেসস্তম্ভ মুস্তাফিজুর রহমান এবং গত কয়েক সিরিজে নিয়মিত খেলা মোহাম্মদ শহীদ ইনজুরির কারণে নেই, রুবেল হোসেন ও আল-আমিন হোসেন ফর্মে না থাকায় সুযোগ পাননি। এ কারণে স্পিন নির্ভর একটি দল গড়া হয়েছে। যেখানে বাঁহাতি সাকিব আল হাসান ছাড়াও আছেন স্পেশালিস্ট স্পিনার তাইজুল ইসলাম এবং স্পিন অলরাউন্ডার মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, সাব্বির রহমান, মেহেদি হাসান মিরাজ ও শুভাগত হোম চৌধুরী। সবমিলিয়ে সাকিব সর্বাধিক ১৪৭ উইকেট শিকার করে বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের সেরা বোলার। সাকিবের সঙ্গে যত স্পিনার খেলেছেন তার মধ্যে সফলতম ছিলেন সোহাগ ৮৯ ম্যাচে ৩১ উইকেট নিয়ে। ঘরের মাটিতে স্পিনাররা ৫১ টেস্টে ৪২.৮১ গড়ে নিয়েছেন ৩৮৩ উইকেট এর মধ্যে সাকিবের দখলেই আছে ১০৪টি। আর পেসাররা সেখানে ঘরের মাটিতে সমান টেস্টে পেয়েছে ৫৬.২৫ গড়ে ১৮৮ উইকেট। সার্বিকভাবে এখন পর্যন্ত ৯৩ টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ। সেদিক থেকেও অনেক বেশি সফল স্পিনাররা। ৪৫.৩২ গড়ে স্পিনারদের শিকার ৫৫৫ উইকেট আর পেসারদের ৪০১টি। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজেও সাকিবই মূল ভরসা। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেও দারুণ সফল তিনি। ৪ ম্যাচে নিয়েছেন ৩৬.৯৪ গড়ে ১৭ উইকেট। মাহমুদুল্লাহ ছাড়া বর্তমান দলে থাকা আর কোন স্পিনারের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলার অভিজ্ঞতা নেই। তিনি অবশ্য তেমন সফলতা পাননি, মাত্র ৪ উইকেট নিতে পেরেছেন। এ কারণে সাকিবের অন্যতম সঙ্গী থাকবেন তাইজুলই। এ তরুণ বাংলাদেশের পক্ষে টেস্টে সেরা ব্যক্তিগত বোলিং নৈপুণ্যের রেকর্ডধারী। দেশের প্রথম বোলার হিসেবে এক ইনিংসে ৮ উইকেট নিয়েছেন তিনি। ২০১৪ সালের অক্টোবরে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে মিরপুরে ৩৯ রানে ৮ উইকেট দখল করেছিলেন। ৯ ম্যাচে ৩৬ উইকেট নেয়া ২৪ বছর বয়সী তাইজুলের কাঁধেই তাই দায়িত্ব। বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে অন্যতম ভরসার নাম ওপেনার তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহীম। মুশফিক কিছুটা বাজে সময় কাটালেও গত বছর দারুণ কেটেছে তামিমের। সফরকারী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২০৬ রানের একটি ইনিংস খেলেছেন তিনি। সেটি টেস্টে বাংলাদেশের পক্ষে সেরা ব্যক্তিগত ইনিংস। মুশফিকেরও আছে ডাবল সেঞ্চুরি, তিনিই দেশের পক্ষে প্রথম সেই কীর্তি দেখিয়েছিলেন। তামিম ৪ টেস্টই ৫০৫ রান করেছেন ৬৩.১২ গড়ে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ সিরিজে লর্ডসে ও ম্যানচেস্টারে ২০১০ সালে টানা দুই সেঞ্চুরিও হাঁকিয়েছিলেন। এরপরই মুশফিক ২৬.৯০ গড়ে ২৬৯ রান করে। এ দুজন ছাড়া আর কোন ব্যাটসম্যানকে নিয়ে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তেমন বড় কিছু প্রত্যাশার নেই। অবশ্য টেস্ট স্পেশালিস্ট মুমিনুল হক সৌরভ টানা ১১ অর্ধশতক বা তার বেশি রানের ইনিংস খেলার পর সর্বশেষ ইনিংসে টেস্ট ক্রিকেটের বিশ্বরেকর্ড গড়তে পারেননি। তবে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে থাকার পর তিনি কতখানি ভাল করতে পারবেন সেটাও বড় প্রশ্ন। প্রস্তুতি ম্যাচেও তেমন সুবিধা করতে পারেননি মুমিনুল। সাকিব-মাহমুদুল্লাহ ছাড়া ব্যাটিংয়ের আরেকটি সম্ভাবনার নাম ইমরুল কায়েস। গত বছর তিনি তামিমের সঙ্গে ৩১২ রানের ঐতিহাসিক ওপেনিং জুটি গড়েছিলেন খুলনায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আর বর্তমানে ফর্মেও আছেন তিনি। বাংলাদেশের সফল হওয়ার শক্তি তাই স্পিন আর টপঅর্ডারদের ব্যাটিং। তবে ব্যাটিং আর বোলিংয়ে সবদিক থেকেই এগিয়ে থাকবে ইংলিশরা। এশিয়ার মাটিতে বরাবরই ইংলিশ পেসার ও স্পিনাররা দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। গ্রায়েম সোয়ান অবশ্য এখন নেই। কিন্তু বর্তমান দলে থাকা বাঁহাতি স্পিনার মঈন ছাড়াও আছেন দুর্দান্ত ফর্মে থাকা লেগস্পিনার আদিল রশিদ। ওয়ানডে সিরিজেও বাংলাদেশ দলের জন্য ভীতিকর হয়ে উঠেছিলেন তিনি, ৩ ম্যাচে পেয়েছেন ১০ উইকেট। আর এশিয়ায় সেরা ইংলিশ পেসার জেমস এ্যান্ডারসন অবশ্য আসেননি। তিনি এশিয়ায় ১৭ টেস্টে সর্বাধিক ৫৫ উইকেট পেয়েছেন ইংলিশ পেসারদের মধ্যে। তবে আছেন অভিজ্ঞ স্টুয়ার্ট ব্রড যার ১৩ টেস্টে আছে ৩১ উইকেট এবং স্টিভেন ফিন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এই ফিনই সফলতম। ৪ টেস্টে ২৩.৪২ গড়ে নিয়েছেন ১৯ উইকেট। ব্রড তেমন সুবিধা করতে পারেননি, ২ টেস্টে ৪৬.০০ গড়ে মাত্র ৬ উইকেট নিয়েছেন। তাই সর্বোপরি বাংলাদেশ দলের স্পিন শক্তির বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের একটা ব্যালান্সড শক্তির বিরুদ্ধে হবে এ সিরিজের লড়াই।
×