ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ফুটবল বাঁচাতে ঐক্যের আহ্বান গাফফারের

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ১৯ অক্টোবর ২০১৬

ফুটবল বাঁচাতে ঐক্যের আহ্বান গাফফারের

বাংলাদেশের ফুটবল ৪৪ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ‘কালো অধ্যায়’ রচিত হয়ে গেছে দেশের ফুটবলের ইতিহাসে। সম্প্রতি এএফসি এশিয়ান কাপ ফুটবলের বাছাইপর্বের প্লেঅফে ভুটানের কাছে ন্যক্কারজনকভাবে হেরেছে বাংলাদেশ জাতীয় দল। ফলে তিন বছরের জন্য আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে নির্বাসিত হয়েছে দেশের ফুটবল। নির্লজ্জ, অমার্জনীয় এই ব্যর্থতার পর গোটা দেশ ফুঁসে উঠেছে। ক্ষমাহীন এই ব্যর্থতার জন্য বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকেই (বাফুফে) দূষছে সাধারণ জনগণ ও সাবেক ফুটবলাররা। সাবেক তারকা ফুটবলার আবদুল গাফফারও বাফুফের বর্তমান কমিটিকে ব্যর্থতার জন্য দায়ী করেছেন। দৈনিক জনকণ্ঠকে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত এই ফুটবলার বলেছেন, ফুটবলকে বাঁচাতে বাফুফের বর্তমান কমিটির সবার পদত্যাগ করা উচিত। নতুন কমিটি দায়িত্ব নিয়ে জেদ, নাক উঁচু, রাগÑঢাক, রেশারেশি, বিভেদ ভুলে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে পারলেই সম্ভব মৃত ফুটবলকে আবার জাগিয়ে তোলা। ফুটবলকে মনেপ্রাণে ভালবাসেন, দেশের জন্য উজাড় করে দিয়ে খেলেছেন একসময়। যে কারণে ফুটবলের এই জীর্ণদশায় ভীষণ মর্মাহত, হতাশ, ব্যথিত গাফফার। ফুটবলের এই ব্যর্থতার জন্য তিনি এককভাবে কাউকে দায়ী করছেন না। তার মতে, বাফুফের বর্তমান কমিটি, এই কমিটিকে যারা নির্বাচিত করেছে সেইসব কাউন্সিলররাও সমানভাবে দায়ী। গাফফার বলেন, আমি এককভাবে কাউকে দোষারোপ করব না। ফুটবল ফেডারেশনের দায়িত্বে যারা আছে তারা সবাই দায়ী। বাংলাদেশের ফুটবলের ৪৪ বছরের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বাজে পারফরমেন্স। ৯ বছর এই কমিটি দায়িত্ব পালন করছে, কিন্তু কি দিয়েছে তারা? দেশের ফুটবলকে একেবারে তলানিতে পৌঁছে দিয়েছে। ৯ বছরে ফুটবলের সাংগঠনিক ভিত ভেঙে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে। এর মাশুল আমরা দিলাম ভুটানের কাছে প্রথমবারের মতো হেরে তিন বছরের জন্য নির্বাসিত হয়ে। প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও বাফুফের বর্তমান কমিটি দেশব্যাপী ফুটবল ছড়িয়ে দিতে পারেনি বলে অভিযোগ করেন গাফফার। তার মতে, খেলা হচ্ছে শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক। কিন্তু সাফল্যের জন্য গোটা দেশে ফুটবল ছড়িয়ে দেয়া উচিত। কিন্তু বাফুফে সেটা পারেনি। এটা তাদের অমার্জনীয় ব্যর্থতা। যদি পাইপলাইনই বন্ধ হয়ে যায় তাহলে কিভাবে একটা দেশের ফুটবলের উন্নতি হবে? পাইপলাইন বন্ধ করে দেশের ফুটবলকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। গাফফার আপসোসের সুরে বলেন, বাফুফের বর্তমান কমিটি দাবি করে তারা সবসময় ফুটবল মাঠে রেখেছে। কিন্তু এটা শুধু ঢাকাতেই। ঢাকার বাইরে সারাদেশে কোথাও কোন ফুটবল টুর্নামেন্ট হয় না। তিনি প্রশ্ন রাখেন হবে কিভাবে? যতদিন ডিএফএ ও ডিএসএর মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকবে ততদিন কিছুই হবে না। ডিএফএ প্রতিষ্ঠা করে ডিএসএ কে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সরকারী টাকা লুটপাট, ফুটবলকে ধ্বংস করার জন্যই ডিএফএ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ডিএসএ-ডিএফএ এর দ্বন্দ্বের অবসান যতদিন না হবে ততদিন জেলা পর্যায়ে খেলা চালানো অসম্ভব। গত নয় বছরে দেখিনি কাজী সালাউদ্দিন জেলা পর্যায়ে যেয়ে কোন টুর্নামেন্টের উদ্বোধন করেছেন। ভুটানের কাছে ফুটবলের সলিল সমাধি হওয়ার পর বাফুফে সভাপতির দিকেই অভিযোগের তীর সবার। এখন প্রতিদিনই বাফুফে ভবনের সামনে বিক্ষোভ হচ্ছে সালাউদ্দিনের পদত্যাগ দাবিতে। এ প্রসঙ্গে গাফফার বলেন, ফুটবলার হিসেবে আমি কাজী সালাউদ্দিনকে স্যালুট করি। কিন্তু সংগঠক হিসেবে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ফুটবল মাঠের হিরো তিনি। এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে জিরো। এটা দিবালোকের মতো সত্য। দেশী খেলোয়াড় তৈরি করার কোন পরিকল্পনা তাদের নেই। তাদের একটাই লক্ষ্য, কিভাবে চেয়ার ধরে রাখা যায়। এটা করতে যেয়ে তারা ফুটবলের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে ৯ বছর ক্ষমতায় আছে এই কমিটি। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে তারা ফুটবলকে কিছুই দিতে পারেনি। বরং ফুটবলকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে। শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র লিমিটেডের সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরী সালাউদ্দিনকে শুধু নয়, তাকে যারা টাকা খেয়ে ভোট দিয়ে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত করেছে তারাও এই ব্যর্থতার জন্য সমানভাবে দায়ী করছেন। গাফফার একমত পোষণ করে বলেন, আমি নুরুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে একমত। ফুটবলের এই কঙ্কালসার অবস্থার জন্য কাজী সালাউদ্দিন এবং কাউন্সিলররা সমানভাবে দায়ী। ৯ বছরে নামতে নামতে বাংলাদেশ ফিফার ১৮৭ র‌্যাঙ্কিংয়ে। অথচ যখন তিন বছরে একটা লীগ হতো। খেলা-দলবদলের দাবিতে ফুটবলাররা রাজপথে আন্দোলন করত তখন বাংলাদেশ জাতীয় দল অনেক শক্তিশালী ছিল। আন্দোলরত খেলোয়াড় নিয়ে দল গড়ে সাফ ফুটবল, এসএ গেমসে চ্যাম্পিয়ন-রানার্সআপ হয়েছে। অথচ এই ৯ বছরে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এখন সবার নিচে। দ্বিতীয়বার দায়িত্ব পাবার পর সালাউদ্দিন জোর গলায় বললেন, ২০২২ বিশ্বকাপে খেলবে বাংলাদেশ। এর চেয়ে হাস্যকর, লজ্জার কথা আর কিছু হতে পারে না। আমরা যেখানে ভুটানের কাছে এক হালি গোল খাই সেখানে বিশ্বকাপে খেলার চিন্তা দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। সালাউদ্দিনের বড়গুণ তিনি ভাল ধোঁকা দিতে পারেন। ২০২২ বিশ্বকাপে খেলার কথা ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। তার উচিত ছিল, আগে এশিয়া মানে কিভাবে যাওয়া যায় সেটা করা। আরও একটি বড় ব্যর্থতা হচ্ছে এখনও পর্যন্ত দেশে একটি ভালমানের আন্তর্জাতিক ফুটবল আয়োজন করতে না পারা। ফুটবলের যে ভয়াবহ অবস্থা বর্তমানে তাতে স্পন্সর প্রতিষ্ঠানসহ দক্ষ সংগঠকরা আসতে চাইবে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন গাফফার। তিনি বলেন, এই রেজাল্টের পর কেউ ফুটবলের পাশে আসতে চাইবে না। ফুটবলকে বাঁচাতে, প্রাণ ফিরিয়ে আনতে দক্ষ সংগঠক দিয়ে বাফুফে পরিচালনা করতে হবে। অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু, সাবের হোসেন চৌধুরীর মতো সংগঠকদের আনতে পারলে ভাল হবে। জাতীয় দল ম্যানেজমেন্ট কমিটিরও কড়া সমালোচনা করেন গাফফার। তিনি বলেন, ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব পালন করেন কাজী নাবিল আহমেদ। কিন্তু সে কয়দিন মাঠে যায়? কয়জন খেলোয়াড় তাঁকে চেনে সন্দেহ হয়। কাজী সালাউদ্দিন সহ-সভাপতি থাকাকালীন যার কারণে পদত্যাগ করেছিলেন সভাপতি হওয়ার পর তাঁকেই পুরস্কৃত করেন জাতীয় দলের ম্যানেজার বানিয়ে। বিতর্কিত বিএনপিপন্থী এই ম্যানেজারের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই ফুটবলারদের। অথচ তার সঙ্গেই গাঁটছড়া বেঁধেছেন বাফুফে সভাপতি। ফুটবলের উন্নয়নের জন্য শেখ জামাল ধানম-ি ক্লাবের সভাপতি মঞ্জুর কাদের ৬৩ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু তার টাকা অব্যবহার করা হয়েছে। মঞ্জুর কাদের ও স্পন্সর প্রতিষ্ঠান নিটল টাটার টাকা দিয়ে ডিএফএকে খুশি করা হয়েছে। ভোট কেনাবেচার জন্য এই টাকা ব্যবহার করা হয়েছে। দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে এখন ফুটবল ফেডারেশন দেনায় জর্জরিত জানিয়ে সাবেক ফুটবল তারকা বলেন, ফুটবল ফেডারেশনের দেনা ২৫ কোটি টাকা। নির্বাচনে ব্যয় হয়েছে ২১ কোটি। এই টাকা ভোট কেনাবেচায় ব্যবহার না করে ফুটবলের উন্নয়নে খরচ করা যেত। দুর্নীতির কারণে ফিফা টাকা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তারা দুর্নীতির তদন্ত করছে। গাফফার বাফুফের পাশাপাশি ফুটবলারদের দেশাত্মবোধ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, খেলোয়াড়দের দেশের প্রতি কমিটমেন্টের অভাব আছে।
×