ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ জাভেদ হাকিম

তারুণ্যের ফেসবুক আসক্তি

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ১৮ অক্টোবর ২০১৬

তারুণ্যের ফেসবুক আসক্তি

ভার্চুয়াল জীবনযাপনের বদৌলতে এখন প্রায় সবার প্রাত্যহিক জীবনেই ফেসবুক-ভাইবার-ইমু-টুইটার-মেসেঞ্জারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের সঙ্গে বেশ ওতপ্রোতভাবেই মানুষ নিজেকে জড়িয়েছেন। বিশেষ করে আজকের নবপ্রজন্ম তো ভাবতেই পারেন না কীভাবে চলবে এসব ছাড়া- যাকে বলে লাইফ ইজ ইমপসিবল। এসব মাধ্যমের যেমন ভাল দিক রয়েছে ঠিক তেমনি অজ্ঞতা বা সঠিক বুঝের অভাবেও ঘটে যায় চরম বিপত্তি। কখনও কখনও দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব, প্রেম-ভালবাসা, আত্মীয়তার সম্পর্কেও চিরধরে। ভার্চুয়াল জীবনের কারণে অপরিপক্ব বয়সেও রঙিন স্বপ্ন দেখার হাতছানি দেয় কারও কারও মনে। যার পরিণতি অধিকাংশ সময় বয়ে আনে হতাশার জীবন। আজকের সমাজে বিকৃত মানসিকতা, উগ্রতা, প্রশ্নপত্র ফাঁস,অশ্লীলতা ও সাজানো সংসার ভেঙ্গে যাওয়াসহ নানা অপকর্ম ছড়িয়ে পরারও অন্যতম কারণ এসব যোগাযোগ মাধ্যম। এতসব অঘটনের পরেও এই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেই আবার ঘটছে অনেক গঠনমূলক কর্ম। যা এক সময় ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা হবে। এবার মূল বিষয়ে আলোকপাত করা যাক। প্রথমে আসি অজ্ঞতা ও অপকারিতা সম্পর্কে। ধরুন ফেসবুক ফ্রেন্ড কোন বিষয় নিয়ে স্ট্যাটাস বা ছবি পোস্ট দিলেন তা অন্যদের বা তাঁর কাছের বন্ধুদেরও খুব একটা পছন্দ হলো না ফলে লাইক-কমেন্ট তেমন নেই, অথচ শুধুই ফেসবুক ফ্রেন্ড কখনও দেখা সাক্ষাত হয়নি তারাই করলেন ভূয়সী প্রশংসা, এতে করে সে মনে মনে তাঁর কাছের বন্ধুদের প্রতি বিরক্ত হলেন। কখনও কখনও এমন হয় পোস্টদাতা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন প্রচুর-লাইক, কমেন্টের কিন্তু চিত্র পুরোই উল্টো, এতে করে সে মানসিকভাবে অসুস্থতা বোধ করেন। বর্তমানে ভার্চুয়াল লাইফ মানসিক রোগেরও অন্যতম কারণ। এমনও হয় কমেন্ট করলেন বন্ধু মজা করে এবং পোস্টদাতাকে ভাল পরামর্শ দেয়ার জন্য কিন্তু অনেক সময় সেই মন্তব্য মনের গহীনে আঘাত করে কখনও বা আবার মনে হয় মন্তব্যকারী ধমকের মেজাজে লিখেছেন। স্ট্যাটাসের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই, আমি হয়ত কৃতজ্ঞতা জানাতে কারও নাম উল্লেখ করে পোস্ট দিলাম কিন্তু সেই পোস্ট তাঁর জন্য হয়ে উঠল উপহাসের রসদ- ফলাফল তিক্ততা। ভার্চুয়ালে যারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন তাঁরা কিন্তু এখন সব কিছুই ভার্চুয়ালের মাধ্যমেই সমাধা করতে চান, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একটিবারের জন্যও ভাবেন না যে যার ওপর রাগ করলাম তাঁর সঙ্গে ফোনে বা সাক্ষাতে আমার মনোকষ্টের বিষয় নিয়ে কথা বলি অথচ যার ওপর করল রাগ তিনি কিন্তু কিছুই জানলেন না। ফলে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বে টানা পড়ল। আর যারা নিতান্তই ফেসবুক ফ্রেন্ড তাদের করা হলো ব্লক বা আনফ্রেন্ড। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে যারা গণহারে ফ্রেন্ডলিস্ট বাড়াতে পছন্দ করেন, এক সমীক্ষায় দেখা গেছে তারাই আবার সবচেয়ে বেশি ব্লক আন ফ্রেন্ড করার দৌড়ে এগিয়ে। এমনকি তার সুখে-দুঃখে থাকা বন্ধুও বাদ পড়ে না ব্লক লিস্ট থেকে। এটি একটি অজ্ঞতার মহা কুফল। কখনও নেটওয়ার্কের কারণে বিশেষ করে আমাদের দেশে, এই সমস্যার সম্মুখীন প্রায়ই গ্রাহকদের হতে হয়, যে সমস্যার করুণ পরিণতি সংসার জীবন-পারিবারিক বন্ধনও হুমকির মুখে পড়ে যখন অপর প্রান্তের কারও সঙ্গে জরুরী বা উত্তপ্ত বিষয় নিয়ে চ্যাটিংরত আছেন ঠিক ওই মুহূর্তে নেট ড্রপ, একবার ভাবুন তো সুধী পাঠকবৃন্দ তখন আপনি নিজেই কী ধারণা পোষণ করেন যার নেট ড্রপ হলো তার সম্পর্কে? যখন ভুক্তভোগী অনলাইনে আসলেন তখন হয়ত পানি অনেক দূর গড়িয়েছে কিংবা ব্যস্ততার কারণে আর পুনরায় যোগাযোগ করতে পারলেন না বা করলেও অন্যজন ততক্ষণে মন থেকে করলেন তাকে বয়কট সুতরাং পরবর্তীতে রিপ্লাই দেয়ারও প্রয়োজন বোধ করলেন না। এর আরও অরেকটা মারাত্মক কু-প্রভাব, উল্লেখ না করলেই নয়, আজকের অস্থির জীবনযাপনের অন্যতম কারণ পরকীয়া। যার বৃহদাংশ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যাপকহারে ব্যবহার করা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ভার্চুয়াল লাইফ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকাটা অনেকাংশে নির্ভর করে উদার মনন, বুদ্ধিমত্তা ও সঠিক চর্চার উপর। যেখানে একাডেমিক শিক্ষার প্রভাব তেমন রেখাপাত করেনÑ যদি প্রভাবই পরত তাহলে উচ্চতর ডিগ্রীপ্রাপ্তদের দ্বারা অন্যজনের টাইমলাইনে অহেতুক ট্যাগ হবার ঝামেলা হতো না কিংবা নিজ ওয়ালে অন্যের নোংরা রুচির প্রতিফলনের জন্য অস্বস্তি বোধ করতে হতো না। ইদানীং ফেসবুকে ভাইরাসের যে বিস্তার তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এবার আসা যাক ভাল দিক সম্পর্কে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেই কিন্তু আজ ভার্চুয়াল দুনিয়ার মানুষেরা গ্লোবালে পরিণত। যদি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কারও সঙ্গে সম্পর্ক হয়ে যায় তাহলে আপনার ব্যক্তিত্বেরও উন্মেষ ঘটবে নিঃসন্দেহে। পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত যেখানেই যা ঘটুক তার প্রতিকার-প্রতিরোধ-সোচ্চারে বেশ ভাল ভূমিকা রাখে সামাজিক মাধ্যমগুলো। বন্যা-ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ব্যক্তিগত সমস্যা মোকাবেলায় আজকের সমাজে-এর গুরুত্ব অপরিসীম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো এখন এতই শক্তিশালী যে এর সঠিক সময়ে উপযুক্ত ব্যবহার বদলে দিতে পারে একটি দেশের আর্থ-সামাজিক ও অসুস্থ রাজনৈতীক ধারা। নিকট অতীতে যার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। ফেসবুকের ফ্রেন্ড লিস্টে থাকা একজন মানুষ আপনার জীবনের অনেক ভুলত্রুটি শুধরিয়ে দিতে সক্ষম। যাকে কোনদিন দেখেননি বা ফোনেও কথা হয়নি এমন কারও দ্বারা আপনি এতটাই উপকৃত হবেন যে, তিনি মেধাসম্পন্ন দক্ষ শিক্ষকের ন্যায় প্রতিনিয়ত আপনাকে বিভিন্ন বিষয়ে শিখাবে, তাঁর জ্ঞানভা-ার থেকে আপনার মাঝেও ছড়িয়ে দেয়ার সদিচ্ছা থাকবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভাল ও মন্দ দিকগুলোর বর্ণনা আমার এই ছোট্ট পরিসরের লেখায় লিখে শেষ করা যাবে না। আমি শুধু মূল কয়েকটা বিষয়ের উপর আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি মাত্র। টিপ্স:-# ফ্রেন্ড লিস্টের সংখ্যা বাড়ানোর চাইতে রক্ষা করার চেষ্টা করুন # রিকোয়েস্ট পেলেই এড করার জন্য ব্যস্ত না হয়ে তাঁর প্রোফাইল ভালভাবে যাচাই করুন # যাদের সঙ্গে এড থাকবেন তাঁদের সঙ্গে মাঝে মধ্যে কুশলাদি বিনিময় করুন # সবকিছুই ভাল কিন্তু অহেতুক তর্কবাজ তাহলে তাকে কৌশলে এড়িয়ে চলুন # খেয়াল রাখুন ফ্রেন্ড লিস্টে থাকা মানুষটার দেয়া স্ট্যাটাস বা অন্যকিছু পোস্টের মাধ্যমে আপনি ভাল কিছু শিখছেন কিনা # সর্বক্ষণ কী খেলেন-কোথায় গেলেন-কার সঙ্গে ঝগড়া হলো কারে আপনি ব্লক মারলেন এ জাতীয় স্ট্যাটাস পোস্ট দেয়ার মানসিকতার লাগাম টানুন # হুট করেই যেমন কাউকে এড করবেন না ঠিক তেমনি সঠিক পর্যালোচনা না করেই কাউকে ব্লক বা আন ফ্রেন্ড করবেন না # সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আপনি নিজেকে একজন শেখার আগ্রহী উৎসাহী ছাত্র হিসেবে তুলে ধরুন # ছদ্ম নামের আইডি থেকে প্রাপ্ত রিকোয়েস্ট গ্রহণ করা হতে যথাসম্ভব বিরত থাকা, কারণ নিজ নাম পরিহার করা মানুষগুলো বহুলাংশ ক্ষেত্রে অসুস্থ মানসিকতার পরিচয় বহন করে এবং অহেতুক ফ্রেন্ডের ফেন্ড লিস্ট থেকে অন্যদের রিকোয়েস্ট পাঠানো হতে বিরত থাকি।
×