ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ধরণী রক্ষার তরুণ যোদ্ধা বোয়ান সম্রাট

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ১৮ অক্টোবর ২০১৬

ধরণী রক্ষার তরুণ যোদ্ধা বোয়ান সম্রাট

মঞ্চে ১৮ বছরের এক সুঠামদেহী, সুদর্শন, ঝাঁকড়া চুলের তরুণ। বলে চলেছেন তার স্বপ্নের কথা, যেন রূপকথার বীর বালক, পরোয়া নেই কিছুতেই- সে শুধু জানে তাকে লক্ষ্যে পৌঁছুতে হবে, ধরণীকে রক্ষা করতে হবে তার নিজেরও আগামী প্রজন্মের জন্য। তার বিশ্বাস সমুদ্র দূষণ এক সময় পৃথিবীর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে বিশেষ করে প্লাস্টিক সামগ্রী। কারণ এই প্লাস্টিক ক্ষয় হয় না। এ বিষয়ে বিশ্বের মহাশক্তিধর রাষ্ট্র, পরিবেশবাদী সংস্থাগুলো কিংবা মুনাফা লোভী জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর সাফল্য যখন খুব সামান্য তখন ১৮’র তারুণ্যের স্পর্ধিত উচ্চারণ- হ্যাঁ সম্ভব, আমি পারব। তার নেই এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। নেই কোন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি, তবু তার দৃঢ় উচ্চারণ আমি পারব! বুঝুন অবস্থা? চারপাশ থেকে ছুন্টে আসছে তীর্যক মন্তব্য, কেউবা তারুণ্যের খেয়াল বলে বিষয়ন্টিকে উড়িয়ে দিচ্ছেন আবার কেউবা ভাবছেন, হাতি ঘোড়া গেল তল-ভেড়া বলে কত জল! না, বোয়ান সøান্ট ভেড়া নন, তিনি হাতি এবং তলিয়ে যেতে আসেননি। লোকবল ছিল না, ছিল না অর্থবল। নিজ চেষ্টার সে সব যোগাড় করেছেন। আর ঠিক পরের বছর সমস্ত রসিকতা তার বিদ্রƒপের জাবাব দিয়েছেন ২০১৪ এর নবেম্বরে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার, ‘চ্যাম্পিয়ন অফ দ্য আর্থ পুরস্কার’ জিতে নিয়ে। সেই দিনন্টির তিন বছর পর আজ বোয়ান সøান্টের দিকে তাকিয়ে আছে সারাবিশ্ব। এমন কি বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। সøান্টের টেকনোলজি আমাদের নদীগুলোতে রক্ষা করতে পারে প্লাস্টিক বর্জ্য দূষণের হাত থেকে। বোয়ান সøান্ট জন্ম ২৭ জুলাই ১৯৯৪। জাতীয়তা ডাচ। এক তরুণ আবিষ্কারক। উদ্যেক্তা এবং এরোস্নেস ইঞ্জিনিয়ারের ছাত্র। যিনি সমুদ্র থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণের এক নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। তার মূল ধারণাটি হচ্ছে সমুদ্রে ভাসমান প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্র স্রোতকে কাজে লাগিয়ে টেনে আনা ও এক জায়গায় জমা করা। তার ডিজাইন ডেনফন্ট ইউনিডা সিটি অব টেকনোলজি থেকে সেরা কারিগরি ডিজাইন এর পুরস্কার জিতে নেয়। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তার নিজের ফাউন্ডেশন। ‘ঞযব ঙপবধহ ঈষবধহঁঢ়’ যার লক্ষ্য এর কারিগরি দিকে উন্নয়ন কারণ তার পদ্ধতিটি তখন পর্যন্ত মাত্র ৫% সামুদ্রিক প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণে সক্ষম ছিল যা প্রয়োজনের তুলনায় নেহায়েত কম কিন্তু ঞঊউঢ সংলাপের পর নতুন ধারণাটি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ধারণাটি হলো ‘কি করে সমুদ্র নিজেই নিজেকে পরিষ্কার রাখতে পারে। এটি একটি বৈপ্লবিক ধারণা হিসেবেই গণ্য হচ্ছে সারা পৃথিবীতে। তিনি তার ফাউন্ডেশনে শত সহস্র স্বেচ্ছাকর্মী যুক্ত করেন এবং তার পাইলট প্রকল্পের জন্য দু’মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেন। মনে রাখুন এ সবই ২ বছরের আগের ঘটনা। তার বয়স মাত্র ২০। দু’বছরে তিনি অনেক এগিয়েছেন। তশিমা আইল্যান্ডে স্থাপিত তার পাইলট প্রকল্পন্টি ২০১৬ তে প্রায় পূর্ণ রূপ নিয়েছে। ২০১৪ তে রোয়াম সøান্ট বলেছিলেন, ‘সমুদ্রে ভাসমান ময়লা বিশেষত যেগুলো পচনশীল সেগুলোর অপসারণ আজ মানব জাতির সামনে পরিবেশ বিষয়ক অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ।’ তার ব্লগে তিনি আরও বলেন’ এটি কেবল সৈকত পরিষ্কার করা বা পরিষ্কার পানির জন্য নয়। এৎবধঃ চধপরভরপ এধৎনধমব ঢ়ধঃপ পরিষ্কার করার লক্ষ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ। আমার এই পদক্ষেপ অন্যদের বিষয়টি নিয়ে ভাবাবে এবং সময়ের সঙ্গে এর কারিগরি উন্নয়নে অন্যরাও ভূমিকা রাখবেন বলে আমি আশাবাদী।’ সøান্ট আরও বলেন, তার উদ্ভাবিত প্লাটফর্মটি সমুদ্রের গতি এবং বাতাস কাজে লাগিয়ে ২০০০ মিটার দূরের বর্জ্য টেনে আনবে এবং এটি হতে যাচ্ছে সমুদ্রের বুকে ভাসমান পৃথিবীর সর্ববৃহৎ স্থাপনা। বোয়ান সøান্টের মনে এই ধারণাটি আসে হঠাৎ করেই। ১৬ বছর বয়সে তিনি গ্রীসে সমুদ্রে সাঁতারকালে লক্ষ্য করেন তার চারপাশে মাছের চেয়ে প্লাস্টিক বর্জ্য অনেক বেশি। বিষয়টি তাকে ভাবায়। তিনি তখন তার হাই স্কুলে বিজ্ঞান প্রজেক্টে ছয় মাস সময় নিয়ে তার মতবাদ দাখিল করেন, কেন সমুদ্রের প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণ কঠিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তার উৎসাহ ছিল ছোটবেলা থেকেই তিনি বর্জ্য অপসারণের জন্য একটি ধারণা দাঁড় করান। ২০১২-এর অক্টোবর এ তিনি তার ধারণাটি ঞঊউঢ সম্মেলনে উপস্থাপন করেন। এর পর তিনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রকৌশলীদের সঙ্গে পরামর্শ করে ৫০টি সাম্ভাব্য সমস্যার সমাধান করেন তার পূর্ণ ধারণাটি ইন্টারনেটে প্রকাশ হলে তা ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পরেও ও তার জন্য মূলধন যোগাড় সহজ হয়। তখন পর্যন্ত একজন নন টেকনিক্যাল নবিস হিসেবে তার এই উদ্যোগের কারণ জানতে চাইলে বোয়ান বলেন, ‘অতীতে সমুদ্র থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণের অনেক পদ্ধতি ব্যবহার হয়েছে। যার বেশিরভাগই ছিল জাহাজের মাধ্যমে নেট ব্যবহার করে,’ যেখানে প্লাস্টিকের চেয়ে মাছ উঠত বেশি।’ শুধু তাই নয় এর পেছনে ব্যয় হচ্ছিল বিলিয়ন ডলার আর সাম্ভাব্য সময় লাগত ৭৯ হাজার। বছর ধারণাটি সুখকর ছিল না। আমি জানতাম স্তূপীকৃত প্লাস্টিক স্থান পরিবর্তন করে ফলে জাহাজগুলো ধাওয়া করে তাদের। এখানে তার বৈপ্লবিক উচ্চারণ কেন আমি সমুদ্রের পেছনে ছুটব যখন সমুদ্র আমার কাছে আসতে পারে।’ একটি ভি আকৃতির ব্যারিয়ার সমুদ্র সমতলে স্থাপন করা যেটি প্লাস্টিক বর্জ্যকে প্রথমে টেনে আনবে ও পরে কেন্দ্রে স্তূপীকৃত করবে। তার বয়সের কারণে তাকে অনেক বেশি সন্দেহ আর তীর্যক মন্তব্যের সম্মুখীন হতে হয়েছে এ ব্যাপারে তার বক্তব্য।’ আমি এ ধরনের প্রতিক্রিয়া আশা করছিলাম। আমি শুধু বলব আপনারা আমার বয়স নয় কাজে মনোযোগ দিন।’ তার সর্বশেষ পরীক্ষা ছিল ৪০ মাইল এলাকা প্লাস্টিক মুক্ত করা। তাতে তিনি সফল। তৃতীয় পরীক্ষাটি হবে ১০০ কিমিব্যাপী এবং পরবর্তী তিন-চার বছরের মধ্যে আরও বড় আকারে কার্যক্রম পরিচালনা। যুগ যুগ বোয়ান সøান্ট রাই বলতে পারে। ‘আমি সমুদ্রের পেছনে ছুটব না, সমুদ্র আমার কাছে আসবে।’ আমাদের নদীগুলো কিংবা সাগর রক্ষায় একজন বোয়ান সøান্ট একান্ত প্রয়োজন। জয়তু বোয়ান সøান্ট।
×