ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সাঁইজীর মিলনমেলা ভাঙছে আজ

গুরু-শিষ্য-ভক্ত সবাই ছেড়ে যাবেন সাধুর বারামখানা

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১৮ অক্টোবর ২০১৬

গুরু-শিষ্য-ভক্ত সবাই ছেড়ে যাবেন সাধুর বারামখানা

এমএ রকিব ॥ সাধুর হাট ভেঙ্গে যাচ্ছে আজ রাত শেষে। গুরু, শিষ্য, লালনভক্ত, সেবাদাসীদের সঙ্গে নিয়ে সাঁইজীর পুণ্যভূমি কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া বারামখানা ত্যাগ করবেন সাধুরা। মঙ্গলবার সকাল থেকেই অনেকে আখড়াবাড়ি ছেড়ে যাওয়া শুরু করলেও বুধবার বাউল-সাধক তাদের ঘরানার লালনভক্তদের সঙ্গে নিয়ে পোঁটলা-পুঁটলি গুটিয়ে আখড়াবাড়ি ছেড়ে রওনা হবেন নিজ নিজ আশ্রমের দিকে। এসব বাউল যেভাবে আসেন ঠিক সেভাবেই আবার ফিরে যান। আখড়াবাড়িতে আসতে সাধুদের যেমন কোন চিঠিপত্র লাগে না, তেমনি যেতেও এদের কোন নির্দেশনার প্রয়োজন পড়ে না। সাধুদের মতে, লালনভক্তরা সাঁইজীর পুণ্যধামে ছুটে আসেন মনের টানে। আখড়বাড়িতে উপস্থিত হয়ে পালন করেন তাদের আচার অনুষ্ঠান। দুদিনেই শেষ হয়ে যায় তাদের কর্মযজ্ঞ। তাদের কাজ শেষ হলেই চলে যান নিজ নিজ আশ্রমে। লালন একাডেমির আয়োজনের সঙ্গে তাদের কোন যোগসূত্র নেই। একাডেমির অয়োজনে তারা শুধু গ্রহণ করেন অর্ধাবাস (রাত ১২টার পর খাবার), বাল্যসেবা (সকালের নাস্তা), পূর্ণসেবা (দুপুরের খাবার) ও রাখালসেবা (রাতের খাবার)। আলমডাঙ্গার কুদ্দুস সাঁই বলেন, ‘আমরা সাঁইজির মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে এসেছি। আমাদের অনুষ্ঠান দুদিনেই শেষ হয়ে যায়। বাউল-সাধুরা লৌকিকতা পছন্দ করেন না। তারা সাঁইজীকে ভক্তি, শ্রদ্ধা জানাতে এবং নিজের মধ্যে ভাববিনিময় ও গুরুকে খুঁজতেই ব্যস্ত থাকেন। সাধুরা বিশ্বাস করেন আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের মাধ্যেমে সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়া সম্ভব। তারা এখানে আসেন সাঁইজির সাক্ষাত পেতে। সেই সঙ্গে দেখা হয় তাঁর পুণ্যভূমি।’ ‘পারে লয়ে যাও আমায়...’ লালনের অমর এ বাণীকে স্মরণ করে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ’র ১২৬তম তিরোধান বা মৃত্যু দিবস উপলক্ষে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় জেলা প্রশাসনের আয়োজনে রবিবার রাত থেকে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী শুরু হয় লালন মেলা, লালনের জীবন দর্শন ও স্মৃতিচারণ করে আলোচনা সভা ও লালন সঙ্গীতানুষ্ঠান। এসব আয়োজনকে ঘিরে ছেঁউড়িয়ায় বসে সাধুর হাট। লালন সাঁইজীর দর্শন পেতে, তাঁর দর্শনের পথে হেঁটে অচেনাকে চেনা, আত্মার শুদ্ধি, মুক্তি, জ্ঞান আহরণসহ নিজের মনের বাসনা পূরণ করতে এখানে আগমন ঘটে দেশ-বিদেশ থেকে বাউল অনুসারী ও সুধীজনসহ লক্ষাধিক মানুষের। এতে লালনের আখড়াবাড়ি পরিণত হয় লালনের ভক্ত-অনুসারী, দর্শক-শ্রোতা ও বাউল-বাউলানীদের এক মিলনমেলায়। রাত যতই গভীর হয়, মানুষের ঢল ততই বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে ছেঁউড়িয়ার আকাশ-বাতাসে ভেসে বেড়ায় একতারা ও লালনসঙ্গীতের সুরের মূর্ছনা। লালন মাজারের প্রধান খাদেম মহম্মদ আলী শাহ বলেন, ‘সত্য ও সুপথের সন্ধানে মানবতার দীক্ষা নিতে আত্মার টানে দেশ-বিদেশের সাধু-গুরু ও ভক্তরা দলে দলে এসে সাঁইজীর মাজারে আসন গাড়েন। তারা গেয়ে চলেন সাঁইজীর আধ্যাত্মিক মর্মবাণী ও দেহতত্ত্বের গান।’ বাংলার বাউল সঙ্গীতের ক্ষেত্রে মরমী সাধক ও লোককবি ফকির লালন শাহের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে। দেশের গ-ি পেরিয়ে লালনের নাম আজ বহিঃবিশ্বেও প্রচারিত। লালনের গানে কেবল আধ্যাত্ম দর্শনই নয়, বাংলার সমাজ, প্রকৃতি ও মানুষের কথাও প্রতিফলিত হয়েছে। লালনের গান কেবল পল্লীবাংলার হাজার হাজার মানুষকেই মুগ্ধ ও উদ্বুদ্ধ করেনি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও অনুপ্রাণিত করেছে। প্রকৃতপক্ষে লালন আজ লৌকিক বাংলার কিংবদন্তি সঙ্গীত নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত। প্রথম দিন রবিবার রাতে মহান এ সাধকের ১২৬তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী আয়োজনের উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তিনি বলেন, ‘বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের দর্শন মানুষকে ভালবাসতে শিখিয়েছে। সবার চেয়ে বড় আমরা সবাই মানুষ। ধর্ম যার যার উৎসব সবার, অথচ আমাদের সমাজে এক শ্রেণীর লোক ধর্মকে হাতিয়ার বানাতে চায়। তারা দেশে জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাতে ধর্মকে নানাভাবে ব্যবহার করছে। লালন অহিংস মানবতার ব্রত নিয়ে মানুষের কল্যাণে অসংখ্য গান সৃষ্টি করে গেছেন। তাঁর এই অমর সৃষ্টি সঙ্গীত কোন ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আজকের এই দিনে জঙ্গীবাদ রুখতে লালনের আদর্শ একটি বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।’ আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে দ্বিতীয় পর্বে পরিবেশিত হয় লালনসঙ্গীত। এতে বাউল আব্দুল কুদ্দুসসহ প্রবীণ শিল্পীরা পরিবেশন করেন প্রার্থনা সঙ্গীত ‘এলাহী আল-আমীন আল্লাহ বাদশা আলামপানা তুমি....।’ গভীর রাত পর্যন্ত শিল্পীরা মাতিয়ে রাখেন জমজমাট এ গানের আসর। এভাবেই পার হয় মরমী গানের স্রষ্টা, আধ্যাত্মিক সাধক ও বাংলার বাউলের শিরোমণি ফকির লালন শাহ’র ১২৬তম তিরোধান দিবস। লালন শাহ ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর (বাংলা ১২৯৭ সালের ১ কার্তিক) ছেঁউড়িয়ায় তাঁর নিজ আখড়ায় দেহত্যাগ করেন।
×