অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে পুরোপুরি দারিদ্র্যমুক্ত হবে বাংলাদেশ। সেই লক্ষ্য নিয়েই বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে। ওই সময়ের মধ্যে দারিদ্র্য জয়ে বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশের পরিচিতি আসবে। ইতোমধ্যে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে এক অকল্পনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। এই সাফল্য অর্জন সরকারী ও বেসরকারী যৌথ উদ্যোগের ফল। অর্জিত প্রবৃদ্ধিকে আরও টেকসই করতে বেসরকারী উদ্যোগকে আরও বেশি এগিয়ে আসার তাগিদ দেয়া হয়েছে। সোমবার বিকেলে বিশ্ব দারিদ্র্যমুক্ত দিবস উপলক্ষে আয়োজিত প্যানেল ডিসকাশন অনুষ্ঠানে এ তাগিদ দেয়া হয়। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ইন্ড গ্লোবাল প্রভার্টি বাই ২০৩০: শেয়ারিং বাংলাদেশ এক্সপেরিয়েন্স শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন সফররত বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। এ সময় দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বলেন, এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অন্য দেশও সুফল পাবে। বিশ্ব দারিদ্র্যমুক্ত দিবস উপলক্ষে বিশ্ব ব্যাংক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) যৌথ উদ্যোগে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ভারতের সাংবাদিক শিরিন ভানের সঞ্চালনায় উপস্থিত ছিলেন স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ পল রোমার, একশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির, নারী উদ্যোক্তা রুবানা হক।
বাংলাদেশকে উদ্ভাবনী কর্মপদ্ধতি ও ধারণার খনি উল্লেখ করে সমাপনী পর্বে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বলেন, বিশ্বজুড়ে নতুন নতুন আইডিয়া খুঁজে বেড়াচ্ছে বিশ্বব্যাংক। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি নজরে এসেছে আমাদের। কঠিন উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সাম্প্রতিককালে দারিদ্র্য বিমোচন, কার্যকর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এদেশে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে। এ অর্জনের পেছনে কী কী কর্মপদ্ধতি ও নীতি কৌশল কাজ করেছে বিশ্বব্যাংক সেই অভিজ্ঞতা নিতে আগ্রহী। বিশ্বব্যাংক গত বছর দারিদ্র্য বিমোচন দিবস উদযাপন করে ঘানায়। সেখানেও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হয়েছে বলে জানান কিম। নিজের দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ টেনে কিম বলেন, দরিদ্র দেশগুলোর জন্য নামমাত্র সুদে আইডিএ তহবিল আছে বিশ্বব্যাংকের। অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে, ১৯৫৯ সালের দিকে এই তহবিল থেকে সহায়তা পাওয়ার যোগ্যতাও দক্ষিণ কোরিয়ার ছিল না। তাই টেকসই উন্নয়নের জন্য কার্যকর বিনিয়োগ ও সৃজনশীল কর্মপন্থার সমন্বয় প্রয়োজন। সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগের পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট।
শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের ক্ষমতায়ন বাড়ানো হচ্ছে। মহিলাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য কমছে। সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচীর ভূমিকাও ব্যাপক। এ সময় তিনি সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচী তুলে ধরেন। স্পীকার বলেন, নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে বাড়ছে। এখন ইউনিয়ন পরিষদে মহিলারা সরাসরি নির্বাচিত হচ্ছেন। স্থানীয় সরকারে তাদের ভূমিকা বাড়ছে। তাছাড়া সেনাবাহিনী, নেভি ও পুলিশে মহিলার যুক্ত হচ্ছেন। এমনকি নারী পুলিশরা জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনেও কাজ করছে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকারের অন্যতম লক্ষ্যই হচ্ছে দারিদ্র্য নিরসন করা। প্রচুর কর্মসংস্থানের সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমরা চাই বেসরকারী বিনিয়োগ বাড়ুক। সেজন্য ব্যাপক উদ্যোগ রয়েছে। সরকারীভাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক উন্নয়ন ও মানবসম্পদ উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করা হচ্ছে। দেশে বর্তমানে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে গ্রাম ও শহরের ব্যবধান কমে আসছে। গ্রামে প্রচুর বিনিয়োগ করা হচ্ছে। বিশেষ করে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে। ফলে গ্রামে কর্মসংস্থান হচ্ছে, জীবন যাত্রার মান বাড়ছে। তিনি জানান, ৫০ লাখ পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে চাল দেয়া হচ্ছে। এসব উদ্যোগই দারিদ্র্য কমাতে ভূমিকা রাখছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, বেসরকারী খাত আমাদের অন্যতম সহযোগী। বেসরকারী খাত অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। আরও বিনিয়োগ বাড়াতে এ খাতকে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ এখন সবচেয়ে ভাল। যে কেউ বিনিয়োগ করতে চাইলে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা দিচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতির প্রধান সৌন্দর্যই হচ্ছে সব খাতেই প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এছাড়া টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ায় বিশ্ব মন্দার পরও এদেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, গ্রাম ভিত্তিক উন্নয়নে সরকার ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়েছে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা মোতাবেক এগুচ্ছে সরকার। এর ফলেই দারিদ্র্যের হার দ্রুত কমে আসছে। আরও কমে আসবে। বাংলাদেশ ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিকে যাচ্ছে। এখন আমরা ৭.০৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধি বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়ছে। দারিদ্র্যের হার কমে আসবে। ২০০০ সালে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ৩৪.৪ শতাংশ, এখন সেটা ১২.৯ শতাংশে নেমে এসেছে।
পল রোমার বলেন, বাংলাদেশকে মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এর মাধ্যমেই অতিদ্রুত দারিদ্র নিরসন সম্ভব। গ্রাম ও শহরের বৈষম্য কমিয়ে আনতে উদ্যোগ নিতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে। এ সময় নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রান্তিক জনেগেষ্ঠীর সম্পৃক্তকরণে জোর দেন তিনি।
ফারাহ কবীর বলেন, রানা প্লাজার ঘটনার পর ইমেজ সঙ্কটসহ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি হয়েছিল। এখনও এসব চ্যালেঞ্চ চলমান রয়েছে। কিন্তু এসব চ্যালেঞ্জ উত্তরণ সম্ভব।