ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অভিমত সাবেক জাতীয় ফুটবলার জুয়েল রানার

আত্মোপলব্ধি থাকলে বাফুফের বর্তমান কমিটির পদত্যাগ করা উচিত

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ১৮ অক্টোবর ২০১৬

আত্মোপলব্ধি থাকলে বাফুফের বর্তমান কমিটির পদত্যাগ  করা উচিত

রুমেল খান ॥ জুয়েল রানা যতদিন ফুটবল খেলেছেন, ততদিন তিনি দেশ ও ক্লাবের জন্য আসলেই ‘জুয়েল’ হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ... এক আবাহনী ছাড়া সব বড় ও প্রতিষ্ঠিত দলেই খেলেছেন দাপটের সঙ্গে। স্টপার ব্যাক পজিশনে তাঁকেই বলা যায় দেশীয় ফুটবলের সর্বশেষ তারকা। তাঁর মতো এমন তুখোড় ডিফেন্ডার এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। কায়সার হামিদ ও প্রয়াত মোনেম মুন্নার মতো তারকা ডিফেন্ডারদের সঙ্গে যথাক্রমে মোহামেডান ও জাতীয় দলে দীর্ঘদিন খেলেছেন সুনামের সঙ্গে। তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনের স্বর্ণসময় কেটেছে মোহামেডানে। খেলা শুরু করেন ১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধার হয়ে, শেষ করেন ২০০৭ সালে মোহামেডানের হয়ে। কোচ হিসেবে শেখ জামাল ধানম-ি, মোহামেডান ও শেখ রাসেলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। আপাতত কোন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও দেশের ফুটবলের সব হালচালই জানেন। জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপনে তিনি জানিয়েছেন কেন বাংলাদেশের ফুটবলের এই বেহাল দশা এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায়ই বা কি। ‘আমাদের ফুটবল যে রসাতলে গেল, এটা কিন্তু একদিনেই হুট করে হয়নি। অনেক বছর ধরেই সমস্যাগুলো দানা বাঁধছিল, ভুটানের সঙ্গে হারার পর সেটা চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায়।’ শুরুতেই জুয়েলের মন্তব্য। সমস্যাগুলো নিয়েও আলোকপাত করেন জুয়েল, ‘ফুটবলার তৈরিতে নিদারুণ ব্যর্থতাই হচ্ছে এই অধঃপতনের মূল কারণ। আরেকটা কারণ হচ্ছে প্রিমিয়ার লীগ হয়ে গিয়েছিল শুধুই ঢাকা কেন্দ্রিক। খেলোয়াড় তৈরি হওয়ার যে দরজাগুলো খোলা ছিল, আন্তঃস্কুল ফুটবল, যেমন শেরেবাংলা কাপ, সোহরাওয়ার্দী কাপ ... এসব টুর্নামেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়া। ঢাকঢোল পিটিয়ে বাফুফে একাডেমি চালু করলেও তা বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ ফুটবলার তৈরিতে এই একাডেমিই সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারত।’ ভাল ফুটবলারের মতো দেশে ভাল মানসম্পন্ন কোচেরও বড়ই সঙ্কট। জুয়েল মনে করেন বাফুফের উচিত ছিল দেশীয় কয়েকজন কোচকেই মানসম্পন্ন কোচ হিসেবে তৈরি করা। তাহলে বিদেশী কোচনির্ভরতা কমত। এ প্রসঙ্গে জুয়েল আরও যোগ করেন, ‘শুধু কোচ হিসেবে দেশীদের তৈরি করে তুললেই হবে না। তাদের কাজ দিতে হবে। ব্যবহার করতে হবে। এবং সেইসঙ্গে তাদের দিতে হবে পর্যাপ্ত সময়ও। নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। সেটা কমপক্ষে ১৫ বছরের জন্য হলে ভাল হয়।’ দেশের ফুটবলের এই অধঃপতনের জন্য শুধু বাফুফে একাই দায়ী নয়, এর অংশীদার হিসেবে ক্লাবগুলোকেও দূষেছেন জুয়েল, ‘ক্লাবগুলোর মধ্যে পেশাদারিত্ব নেই, নেই কোন দায়বদ্ধতা। তাদের স্বেচ্ছাচারিতামূলক আচরণ, বাফুফেকে অসহযোগিতা, বাফুফের সিদ্ধান্ত না মানা ... এগুলোও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বাফুফে এক্ষেত্রে কোনকালেই কঠোর হতে পারেনি। ক্লাবগুলোকে শাস্তি দিতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। খেলোয়াড় তৈরির ব্যাপারে বেশিরভাগ ক্লাবই ছিল অনাগ্রহী ও নিষ্ক্রিয়। অথচ বিশে^র কোন দেশের ফুটবল ফেডারেশন কিন্তু খেলোয়াড় তৈরি করে না। করে ক্লাবগুলোই। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটেছে এর ঠিক উল্টোটিই। ক্লাবগুলো যদি তাদের বয়সভিত্তিক পর্যায়ে দল গঠন করত বা একাডেমি বানাতো, তাহলে অন্তত সেখান থেকে ৫টা হলেও মানসম্পন্ন ফুটবলার আমরা পেতাম।’ ক্লাবগুলো যে কোন খেলোয়াড় তৈরি করে না, এর একটা বড় অজুহাত তারা প্রায়ই দেখায়, ফান্ড নেই বলে। এখন অবস্থাটা এমনই দাঁড়িয়েছে যে, খেলোয়াড় তৈরির দায় যেন বাফুফের একারই! ‘অথচ ক্লাবগুলো যদি সীমিতভাবে হলেও বাফুফেকে এ ব্যাপারে সাহায্য করত, তাহলে আজ দেশে মানসম্পন্ন ফুটবলারের অভাবে আমাদের ভুটানের মতো দলের কাছে হারতে হতো না।’ জুয়েলের ভাষ্য। কিছু ক্লাব আছে, যারা এর আগে বাফুফে আয়োজিত দুটি বয়সভিত্তিক ক্লাব ফুটবল টুর্নামেন্টে ইচ্ছে করে খেলেনি। যেমন শেখ জামাল ধানম-ি ক্লাব। তাদের এমন মানসিকতা মোটেও ক্রীড়াসুলভ নয় বলে অভিমত ব্যক্ত করেন জুয়েল। তিনি বলেন, ‘এগুলো পরিহার করতে হবে।’ সবাই এখন বাফুফের পুরো কমিটির পদত্যাগ দাবি করছে। এ ব্যাপারে জুয়েলের অভিমত, ‘দেখুন, সবকিছুর মূলেই হচ্ছে রেজাল্ট। বাফুফের সবার যদি আত্মপোলব্ধি হয়, তাহলে তারা পদত্যাগ করবে। কিন্তু এখানে একটা কথা আছে। তাদের পদত্যাগের পর নতুন কেউ এলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তারা যে আগের কমিটির চেয়ে বেশি দক্ষ-অভিজ্ঞ-সফল হবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়? কাজী মোঃ সালাউদ্দিন অনেক সময় পেয়েছেন কাজ করার। কিন্তু কোন সমস্যার সমাধান করতে পারেননি।’ দেশের ফুটবলের ভাগ্যাকাশে কৃষ্ণ মেঘ জমার পেছনে জুয়েল দায়ী করেছেন ডেলিগেট বা কাউন্সিলরদেরও, ‘আমাদের কাউন্সিলরদের ৯০ শতাংশই ক্রীড়াসুলভ মানসিকতার নয়। তারা হচ্ছেনÑ রাজনৈতিক মানসিকতার। তারা বাফুফের কাছ থেকে টাকা নেন, কাজ করেন না। এগুলোর পরিবর্তন হওয়া দরকার।’ এছাড়া বাফুফেতে দুর্নীতি ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবও ফুটবলের উন্নয়নের পথে অন্তরায় বলে মনে করেন জুয়েল। ‘এসব সমস্যা সমষ্টিগতভাবে দূর না করলে কিছুই হবে না।’ ফুটবলাররা ক্লাব পর্যায়ে ৪০-৬০ লাখ পর্যন্ত টাকা পাচ্ছেন। তারা কি আসলেই এই পারিশ্রমিক পাওয়ার যোগ্য? জুয়েলের ভাষ্য, ‘তাদের এই অর্থ দিচ্ছে ক্লাবগুলোই। আমাদের দেশে কোয়ালিটি ফুটবলারের অভাব, এটা বিশেষ পরিস্থিতির কারণে ঘটছে।’ লীগে বিদেশী ফুটবলারদের নিষিদ্ধ না করে বরং তাদের সংখ্যা কমানোর পক্ষে জুয়েল, ‘তিনজনকে রেজিস্ট্রেশন করে দুজনকে মাঠে খেলালে অনেক দেশীয় ফুটবলারই সাইডবেঞ্চে বসে না থেকে মাঠে খেলে নিজেদের বিকশিত করার সুযোগ পাবে।’ জুয়েলের এসব কথা, পরামর্শ আদৌ কি বাস্তবায়িত হবে কোনদিন?
×