ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুখ যেন এক বিশাল আকাশ

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১৭ অক্টোবর ২০১৬

সুখ যেন এক বিশাল আকাশ

সুখের পেছনে অবিরাম ছুটে চলা আমাদের স্বভাব। ছুটছে জগত সংসার, উদাসী কবি, বিবাগী বাউল কিংবা চরম গৃহী সবাই। নিজের মতো করে সবাই সুখ সন্ধানে রত। কিন্তু সুখ যে এক বিশাল আকাশ যার নেই আদি, নেই অন্ত। যত কাছে যাই ততদূরে সরে যায়। সুখের নেই কোন গাণিতিক সূত্র, নেই নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা। এতক্ষণ যতটা জটিল শোনাল বিষয়টি কি সত্যি অতটা জটিল? তাও নয়। পথটি খুব সহজ হতে পারে এভাবে, কেবল একা সুখী হওয়ার ধারণাটি বাদ দিয়ে আপনি আপনার চারপাশের প্রিয় মানুষগুলোকে সুখী করুন। তারাই আপনার জীবন ভরিয়ে দেবে সুখে। সেই সঙ্গে আত্মতৃপ্তি তো বোনাস। খুব অল্পতেই এটি করা সম্ভব। কোন বিদেশী ম্যাগাজিনের অনুকরণে নয়, নয় কোন জটিল মনোবৈজ্ঞানিক পরামর্শ। আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে ‘অন্যকে সুখী করুন- নিজে সুখী হোন’ সম্পর্কিত কিছু পরামর্শ। ১. একটি শক্ত মোটা পলিথিন (ছোট আকারের) সার মিশ্রিত মাটিতে ভর্তি করুন ও পানি নিষ্কাশনের জন্য কয়েকটি ছিদ্র রাখুন। এবার একটি গোলাপের চারা রোপণ করুন তাতে। চারাসহ ব্যাগটি জানালার ধারে রাখুন যাতে পর্যাপ্ত আলো বাতাস পায় এটি। নিয়মিত যতœ নিন, প্রথম ফুলটি ফোটা মাত্র, আপনার মাকে হাত ধরে নিয়ে আসুন জানালার কাছে এবং বলুন ‘মা এটি তোমার জন্য’। আপনি মায়ের চোখে যে স্বর্গীয় আলো দেখবেন আর মুখে পরিতৃপ্তি এর বেশি সুখ কোথায়? জেনে রাখুন আপনি যখন বাইরে তখন মা নিজেই যতœ নেবেন চারাটির। আপনার জন্য ঝরবে আশীর্বাদ। ২. আপনি হয়ত ছাত্র। পড়ছেন বাড়ি থেকে দূরে কোন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। গ্রামের বাড়িতে কৃষক পিতা মাঠে হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে আপনার পড়ার খরচ যোগান। মাঠে লাঙ্গল দেয়ার বা ধান কাটার মৌসুমে দু’দিন ছুটি নিয়ে হলেও বাড়ি যান। কাস্তে হাতে মাঠে বাবার পাশে বসুন তার কাজে শরিক হোন। আপনার কাছে কেউ শ্রমিকের দক্ষতা আশা করছে না। কেবল এই শরিক হওয়াতেই পিতার পরিতৃপ্তি মুখখানি আপনার অন্তরে যে সুখানুভূতি সৃষ্টি করবে কোন মূল্যে কি তা কেনা সম্ভব। আর নিজের মাটির সঙ্গে সংযোগের সুখ তো উপরি পাওনা। ৩. প্রেমকি আপনি। কোন বিশেষ দিনে ভালবাসার মানুষটিকে বিশেষ কিছু দিতে চান? একটু আগে থেকে প্রস্তুতি নিন। সেই পুরনো পলিথিন ব্যাগ, মাটি আর এবারে একটি লতার চারা রোপণ করে জানালায় রাখুন। বিশেষ দিনটিতে সুদৃশ্য মোড়কে মুড়িয়ে প্রিয়জনকে উপহার দিন। নিশ্চিত থাকুন এটি তার জানালায় ঠাঁই পাবে। বেড়ে ওঠা লতা গাছটির সঙ্গে তার ভালবাসাও বাড়বে। যতক্ষণ ঘরে থাকবে লতাটি দেখামাত্র মনে পড়বে আপনাকে। আর আপনার প্রাপ্তি? আমি না-ই বললাম। শুধু বলি সুখ পালাবে কোথায়? ৪. আপনি যখন একান্নবর্তী পরিবারের সদস্য। একগাদা কচিকাঁচা ভর্তি ঘর। ওদের সবাইকে খুব সহজেই আনন্দিত করতে পারেন আপনি। আর নিজের তাৎক্ষণিক সুখ তো আছেই হতে পারে ভবিষ্যতের গর্ভে আপনার জন্য জমা রইবে সেরা সুখের মুহূর্তটি। কিভাবে? আজকাল স্যাটেলাইট টিভি, গুগল, ইউটিউব বা ইন্টারনেট থেকে কাগজ, পুরনো পরিত্যক্ত সামগ্রী দিয়ে অনেক মজার খেলনা বা অন্যান্য জিনিস বানানো শেখা যায়। একটু কষ্ট করে কিছু মজার আইটেম বানানো শিখুন। কোন এক ছুটির দিনে সবাইকে নিয়ে বসুন। ওদের কয়েকটি মজার আইটেম বানিয়ে দেখান। কোমলমতি শিশুগুলোর গোল্লাগোল্লা চোখ আর বিস্ময় আপনার হৃদয়ে এনে দেবে এক অনাবিল সুখ, আর ভবিষ্যত? এই নতুন কিছু তৈরি তাদের অনুপ্রাণিত করতে পারে নতুন কিছু তৈরিতে। পরবর্তীতে নতুন আবিষ্কারে হতেই পারে একদিন তাদের দাঁড় করাবে নিজস্ব আবিষ্কারের জন্য নোবেলের মঞ্চে। যেখানে দাঁড়িয়ে সে বলবে ‘আমার এই প্রাপ্তির শুরুর অনুপ্রেরণা আমার মামা/চাচা’ বলুন আপনার চোখের সুখের জলধারা বইবে কিনা ওই মুহূর্তে? অসম্ভব মনে হচ্ছে? কেবল অসম্ভব? সত্য না কল্পনাকে হার মানায়? ৫. আপনি যখন চাকরিজীবী। আজ অফিসে আপনার হাতে তেমন কোন কাজ নেই। হতে পারে আপনার কোন সহকর্মী কাজের চাপে বিপন্ন। তাই ফাঁকা সময়টুকু অলসভাবে পার না করে সবার টেবিলে একবার করে যান। জিজ্ঞেস করুন আপনি তাদের কোনভাবে সাহায্য করতে পারেন কিনা? সম্ভব হলে সাহায্য করুন। এই অল্প চেষ্টায় আপনি অর্জন করতে পারেন সহকর্মীদের ভালবাসা। আর ভালবাসাতেই তো সুখ। তাই না? ৬. ভালবাসার কথায় আবার ফিরে আসি, প্রেম করছেন। ভালবাসার মানুষটি অনেক দূরে থাকেন, হয়ত অন্য কোন জেলায় বা দেশে। প্রযুক্তির এই যুগে মোবাইল, হোয়াটস এ্যাপ, ভাইবার বা অন্য কোন মাধ্যমে রয়েছে, প্রতি মুহূর্তে যোগাযোগ, তবু বলি একটু ভিন্নতা আনুন। মাসে অন্তত একটি হাতে লিখা চিঠি পাঠান। এটি হতে পারে যান্ত্রিকতা এড়িয়ে মানবিক ছোঁয়া। শুধু তাই নয়, প্রেম দাম্পত্যে রূপ পেলে এই সংগৃহীত চিঠিগুলো দাম্পত্যের অবসরে হয়ে উঠতে পারে সুখের উৎস আবার সঙ্কটে হতে পারে সমাধানের উৎস। ৭. আপনার সুন্দর মনের প্রিয় বন্ধুটির স্বভাব বড় এলোমেলো অগোছালো, ওর বাসায় গিয়ে ঘরের এলোমেলো অবস্থা দেখে আপনার চোখ চড়কগাছ! দয়া করে ওকে একগাদা উপদেশ খয়রাত করবেন না। নিজে উদ্যোগী হয়ে ঝাড়ু হাতে নেমে পড়ুন। পরিষ্কার করে ঘরটি গুছিয়ে দিন। এমন দুয়েক বার করলে বন্ধুর স্বভাবে পরিবর্তন আসতেই পারে। তা কি আপনাকে সুখী করবে না? লেখার উদ্দেশ্য সুখের সংজ্ঞা নিরূপণ নয়। বরং এ ধারণা দেয়া যেÑ আপনি যদি সুখী হতে চান তাহলে আপনার চারপাশের মানুষগুলোকে সুখী করুন। এতে আত্মতৃপ্তির সুখ তো পাবেনই, পাশাপাশি তারাও আপনাকে সুখী করবে দু’হাত ভরে। সেই পুরনো প্রবাদ, ‘কিছু পেতে হলে, কিছু দিতে হয়’ এবং খুব অল্প দিয়েও যে সুখী করা ও হওয়া যায় সে জন্য কিছু উদাহরণ দেয়া। লেখাটি এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু সুখ বিষয়ে বিভিন্ন জনের মতামত নিতে গিয়ে সুখের এক অদ্ভুত সংজ্ঞা শুনি। আমার হতভম্ব অনুভূতি পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে নিচের অংশটুকু যোগ করা হলো। ক্যাচক্যাচ করা ও শোনাতেও সুখ! ইয়াদিয়া নিজ পেশা ও সংসার জীবনে সফল এক নারী। তার কাছে জিজ্ঞাসা ছিল আপনি কিভাবে সুখ খোঁজেন? প্রায় ৫০ সদস্যের একান্নবর্তী পরিবারের এই কর্ত্রীর দৃঢ় উত্তর ছিল, ‘প্রিয় মানুষগুলোর সাথে ক্যাচক্যাচ করাতেই আমার সুখ!’ বুঝতে না পেরে আবার জানতে চাইলাম মানে? তার উত্তর, ‘ফোনে হোক বা সামনে একটা বা দু’তিন ঘণ্টা প্রিয় কারও সাথে ক্যাচক্যাচ না করলে আমার নিজেকে দারুণ সুখী মনে হয়। মনে হয় আমি সুখ হারিয়ে ফেলছি!’ তার সন্তানদের জিজ্ঞেস করে উত্তর পেলাম, ‘আম্মু যদি কোন দিন অফিস থেকে ফিরে অন্তত ১৫ মিনিট কারণে অকারণে ক্যাচক্যাচ না করে সোজা নিজের ঘরে চলে যায়, আমরা রীতিমতো অসুখী অনুভব করি!’ পরিবারের অন্য সদস্যরাও তার সামনে পরে ক্যাচক্যাচ না শুনলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন! এই রহস্য উদ্ধার করতে গিয়ে জানলাম, তার পরিবারের সবাই জানে এই নারী তাদের যে কারও অসুখে সাররাত মাথার কাছে বসে থাকে; যে কারও বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন সর্বশক্তি নিয়ে। তাই তার ক্যাচক্যাচ শুনেও সবাই সুখী আর উনি সুখী ক্যাচক্যাচ করে! সুখ কি? এর কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আমাদের জানা নেই। আমরা কেবল সুখী হওয়ার কিছু সহজ পথ দেখাতে পারি। সে পথও যে সবার জন্য কার্যকরী তারও কোন নিশ্চয়তা নেই! তাই ঘুরে ফিরে আবারও বলি, ‘সুখ তুমি কি? বোধ করি বিধাতার মর্জির মতোই বিচিত্র এই সুখ! হে সুখ, তোমার ক্ষুরে নমস্কার। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
×