ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

অভ্যাস ৬ ॥ সিনারজাইজ

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৭ অক্টোবর ২০১৬

অভ্যাস ৬ ॥ সিনারজাইজ

(পর্ব ১) ড. স্টিফেন কোভের লেখা ‘দি সেভেন হ্যাবিটস অব হাইলি ইফেক্টিভ পিপল’ বইটিতে যে সাতটি অভ্যাসের কথা বলা হয়েছে তার ষষ্ঠ অভ্যাসটি হলো ‘সিনারজাইজ’- সৃজনশীল সহযোগিতার নীতিমালা। তবে এটা নিয়ে লিখতে গিয়ে প্রথমেই একটা ধাক্কা খেতে হলো। এই ‘সিনারজাইজ’ শব্দটির বাংলা অর্থ কী? বাংলা একাডেমির ইংরেজী-বাংলা অভিধানে শব্দটি খুঁজে পেলাম না। গুগল ট্রান্সলেটর সাহায্য করতে পারল না। বিষয়টা বেশ গোলমেলে মনে হচ্ছে। হয়ত আমি কোথাও ভুল করছি। আর যদি সত্যি সত্যি এই ইংরেজী শব্দটার বাংলা শব্দ বা পরিভাষা না থাকে তাহলে বিপদের কথা। অনেকের কাছে মনে হতে পারে, এটার অর্থ হলো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। কিন্তু আসলে তা নয়। আমি বিষয়টি একটু বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি। তবে বাংলা অভিধানে কেন শব্দটি নেই সেটা আমার মাথায় এখনও ঢুকছে না। বিষয়টি কি এমন যে, বাংলাভাষী মানুষের জীবনে এই ধরনের কোন অভিব্যক্তি কিংবা রসায়ন নেই? আমরা কি আসলেই জানি না সিনারজাইজ কিভাবে করতে হয়? যদি জানতাম তাহলে তো অভিধানে থাকত! যেমন, আমাদের পরশ্রীকাতর শব্দটি ইংরেজীতে নেই। অর্থাৎ তাদের জীবনধারায় এই ধরনের কর্মকা- নেই, তাই তাদের ওটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়নি। আবার কৃতজ্ঞ শব্দটির ইংরেজী অভিধানে কী আছে আমি জানি না। কৃতজ্ঞ অর্থ কিন্তু ‘আনগ্রেটফুল’ (অকৃতজ্ঞ) নয়। যে শব্দটি অভিধানে নেই তা নিয়ে লিখতে যাওয়া খুব কঠিন। বিশেষ করে মানুষের ব্রেনে কনসেপ্টটা ঢোকানো বেশ কষ্টকর; কারণ বিষয়টির সঙ্গে আমরা মোটেও পরিচিত নই। অনেকটা অন্ধের হাতি দেখার মতো ব্যাপার। তবুও সাহস করে লিখছি। দেখি কতটা বোঝানো যায়। আরও একটি বিপদ আছে। বিষয়টি না হয় কিছুটা বোঝানো গেল; কিন্তু এর অস্তিত্ব তো আর আমাদের চোখে পড়বে না। কারণ, এমন কিছু তো পাঠকরা চারদিকে দেখতে পাবেন না; কোন উদাহরণ থাকবে না হাতের কাছে। আমি সত্যি বুঝতে পারছি না এমন একটি জাতি কি আসলেই থাকতে পারে যারা সিনারজিতে বিশ্বাস করে না! আমি যদি ভুল করে থাকি তাহলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। যে মুহূর্তে লিখতে বসেছি সেই মুহূর্তে আশপাশের রিসোর্স ঘেঁটে এই শব্দটির অর্থ খুঁজে পেলাম না। আশা করছি যে পাঠক আমার এই লেখাগুলো পড়ছেন তারা অনেক বেশি পরিপক্ব। তাদের জন্য হয়ত বিষয়টি ধরতে সহজ হবে। এবারে কাজের কথায় আসি। ॥ দুই ॥ আমরা অঙ্কে খুব ভাল। সব সময় বলি ১ + ১ = ২। কিন্তু কেউ কি কখনও ভেবে দেখেছেন, এক যোগ একের ফলাফল তিন হতে পারে, নয়ত আরও বেশি? কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। আপনার কাছে দুটো কাঠের টুকরো আছে। এরা প্রত্যেকেই দশ কেজি ওজন নিতে পারে। কিন্তু দুটো কাঠকে যদি একত্রে লোহা দিয়ে লাগিয়ে দিন তাহলে তারা সম্মিলিতভাবে বিশ কেজির বেশি ওজন বহন করতে পারবে। প্রকৃতির ভেতর এমন সিনারজি আছে। আপনি পাশাপাশি দুটো গাছ লাগাবেন। ওরা মাটির নিচে এমনভাবে শিকড় ছড়াবে যেন মাটির গুণগত মান উন্নত হয়, অক্সিজেন নিতে পারে এবং দুটো গাছ একই সঙ্গে বেড়ে উঠবে। কিন্তু গাছ দুটোকে আলাদা মাটিতে লাগালে তারা এককভাবে একই রকম বাড়তে পারত না। খুবই ইন্টারেস্টিং বিষয়। গাছের যেহেতু জীবন আছে, তারা নিজেরা বুঝে ফেলে ঠিক কিভাবে দু’জনের ভেতর নতুন ধরনের রসায়ন আনা যায়, যা দু’জনকেই বাড়তি সুবিধা দেয়। এটাই হলো সিনারজি। এর মূল কনসেপ্টটা হলো, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়কে জোড়া দিলে ফল তাদের যোগফলের চেয়ে বড় হবে। দু’জন মানুষ একা একা যেটুকু করতে পারেন তাদের দু’জনের ভেতর সঠিক সিনারজি কাজ করলে তারা সম্মিলিতভাবে আরও অনেক বেশি করতে পারেন, যা তাদের দু’জনের যোগফলের চেয়ে বেশি। আরেকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। গুগলের প্রতিষ্ঠাতা সার্গেই ব্রিন এবং ল্যারি পেজ। তারা আলাদাভাবে কোন প্রতিষ্ঠান তৈরি করলে যা করতে পারতেন, দু’জন মিলে যখন একটি প্রতিষ্ঠান করছেন তখন তা গুগলে পরিণত হয়েছে। তাদের ভেতর রয়েছে চমৎকার একটি সিনারজি। এটা হলো সহযোগিতার চরম একটি অবস্থা, যেখানে প্রতিটি অংশ তাদের মতো করে একসঙ্গে নাচতে পারে, একটি ছন্দে দুলতে পারে, একই সুরে গাইতে পারে- একটি মিউজিক্যাল কনসার্টের সর্বোচ্চ ছন্দ, যেখানে প্রতিটি বাদ্যযন্ত্র একসঙ্গে মিলে চমৎকার একটি পারফরমেন্স উপহার দেয়। যারা বড় কোন কনসার্ট হলে সঙ্গীতের এই মূর্ছনা উপভোগ করেছেন, তারা হয়ত বিষয়টি অনুধাবন করতে পারছেন। এটা যখন সঠিকভাবে কেউ অনুধাবন করতে পারবে, সে বুঝতে পারবে সিনারজি হলো সব জীবনের সবচেয়ে বড় কর্মকা-- দি হায়েস্ট একটিভিটি ইন অল লাইফ। আপনার জীবনের অন্য অভ্যাসগুলোর সম্মিলিত সমন্বয়। স্যার উইন্সটন চার্চিলকে যখন গ্রেট ব্রিটেনের যুদ্ধের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তখন তিনি অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছিলেন, সারাটা জীবন তিনি এই মুহূর্তটির জন্য তৈরি করেছেন। তার কথা ধরেই বলা যায়, আমাদের যাবতীয় ভাল অভ্যাসই নিজেদের ভেতর সিনার্জি তৈরি করার জন্য প্রস্তুত করতে পারে। এটা একটি অদ্ভুত অভ্যাস- যার ফলাফল আপনি না দেখে বুঝতেই পারবেন না। এর ফলাফলকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অলৌকিকতার সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। কারণ এটা এত বেশি ক্ষমতাশালী যে, এই কেমিস্ট্রি থেকে কতগুণ বড় আউটপুট আসবে সেটা আগেভাগে বলে দেয়া যায় না। সিনারজি অবশ্যই এক ধরনের সহযোগিতা। কিন্তু আমরা আপাতভাবে সহযোগিতা বলতে যা বোঝাই এটা সেটা নয়। এটা অনেকটা সৃষ্টিশীল সহযোগিতা। এটা প্রয়োগ করা খুব যে সহজ তা নয়। তবে কিছু নীতিমালা নিজের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে পারলে আপনি আরেকটি মানুষ কিংবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এই সৃষ্টিশীল সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে পারেন। তবে অপরপক্ষকেও এই বিষয়টি বুঝতে হবে। আমাদের জীবনেও এই সিনারজির একটি চমৎকার উদাহরণ রয়েছে- তা হলো মানবজীবন। একজন নারী এবং পুরুষ মিলে যেভাবে একটি জীবনকে পৃথিবীতে আনেন, সেটা হলো খুব বড় ধরনের সিনারজি। এর মূল নীতিমালা হলো ‘ভিন্নতা’কে মূল্য দিতে হবে। সেটা মতের ভিন্নতা হতে পারে, শরীরের ভিন্নতা হতে পারে, গঠনের ভিন্নতা হতে পারে, কাজের ভিন্নতা হতে পারে। আপনি যা পারেন না তা অন্য একজন পারে। তাকে সঙ্গে নিয়ে আপনি আপনার শূন্যতাকে পূরণ করতে পারেন। তার মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে, তাকে সম্মান করে, তার সঙ্গে মিলে শক্তি তৈরি করতে পারলে তখন একটা সিনারজি তৈরি হতে পারে। আমরা নিঃসন্দেহে ছেলে এবং মেয়ের শারীরিক গঠনের বৈপরীত্যকে সম্মান করি (যদিও কিছু অমানুষ নারীদের ভিন্ন চোখে দেখতে শেখে) এবং এই বৈপরীত্যকে সম্মান করি বলেই আমরা প্রেম করি, ভালবাসি এবং দু’জন মিলে সন্তান নেই। আমরা যদি শারীরিক এই বৈপরীত্যকে সম্মান করে সিনারজি তৈরি করতে পারি তাহলে কেন মতের বৈপরীত্য, সামাজিক বৈপরীত্য কিংবা পার্থক্যকে কাজে লাগিয়ে আমরা সেখানেও সিনারজি তৈরি করতে পারব না? একই সূত্র এখানেও কাজে লাগবে না কেন? কেন এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা যাবে না, যেখানে ভিন্নমতকে সম্মান করা হবে এবং ভিন্নতাকে কাজে লাগিয়ে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা যাবে, যার মাধ্যমে ভিন্ন মাত্রার আউটপুট তৈরি হবে এবং এটা সম্ভব। এটাই হলো সহযোগিতার নতুন মাত্রা। এটাকে অনেকেই টিমওয়ার্ক ভাবতে পারেন। কিন্তু বিষয়টি টিমওয়ার্কের চেয়েও অনেক গভীর। ॥ তিন ॥ আপনি যখন কোথাও সিনারজি তৈরির জন্য নিজেকে সামনে তুলে ধরছেন আপনি তখন নিজেকে মেলে দিচ্ছেন অন্য মানুষের সামনে, নিজের মনকে, নিজের হৃদয়কে, নিজের ভেতরের মানুষটাকে এবং তা থেকে আপনি নতুন কিছু আশা করতে পারেন; নতুন সম্ভাবনা, নতুন দিগন্ত- একদম নতুন কিছু, যা কখনও ঘটেনি আগে। বিষয়টা অনেকটা কাব্যিক মনে হতে পারে। কিন্তু বিষয়টি আসলে এমনই। আপনি একটি খোলা মন নিয়ে অপার সম্ভাবনার দিকে নিজেকে মেলে দিতে পারেন। কিন্তু এই মেলে দেয়ার জন্য আপনার প্রয়োজন অগাধ আত্মবিশ্বাস। আপনি এই খেলায় কিছু পেতেও পারেন, আবার কিছু নাও পেতে পারেন। সেটা বুঝতে পারার মতো দক্ষতা এবং যোগ্যতা আপনার তৈরি হয়ে যাবে যখন আপনি অন্য অভ্যাসগুলো সঠিকভাবে নিজের ভেতর নিয়ে আসতে পারবেন। আপনি জানবেন না ঠিক কী এর পরিণতি, কিংবা ঠিক কী পেতে যাচ্ছেন, কিংবা কী ঘটতে যাচ্ছে। অনেকটা প্রেমে পড়ার মতো ঘটনা- আপনি জানেন না আপনার প্রেমের মানুষটির কাছ থেকে কী পেতে যাচ্ছেন; কিন্তু আপনি অপার এক সম্ভাবনার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, যেখানে রয়েছে অগাধ বিশ্বাস এবং নিজের ভেতর এক ধরনের নিরাপত্তা। আপনি অনুভব করতে পারবেন, ভাল কিছু একটা ঘটবে, যা বর্তমানের চেয়ে অনেক ভাল। এই বিশ্বাস নিয়েই আপনি নিজেকে মেলে দেবেন। আপনি এমন একটা বিশ্বাস নিয়ে পা বাড়াবেন যে, যারা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবে সকলেই এটার গভীরে প্রবেশ করবে এবং যতই গভীরে যাবে ততই পরস্পরকে জানার উত্তেজনা বাড়তে থাকবে এবং সেই গভীর অনুভূতি আরও বেশি শেখার দরজা খুলে দেবে, নতুন মোমেন্টাম তৈরি করবে এবং সবাইকে মিলে বিশাল একটি প্রবৃদ্ধি উপহার দেবে। এই বিশ্বাস নিয়েই আপনাকে মাঠে নামতে হবে। আপনার ভেতর সন্দেহ থাকলে কোন অবস্থাতেই এই খেলা জমবে না। যেমন ব্যক্তিগত জীবনেও আপনি চাইলে চমৎকার সিনারজি তৈরি করতে পারেন। আপনার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে, ছেলেমেয়ের সঙ্গে, মা-বাবার সঙ্গে, বন্ধুদের সঙ্গে, নয়ত প্রেমিক-প্রেমিকার সঙ্গে। কিন্তু আমাদের অনেকই সারাজীবনে সামান্যতম সিনারজির স্বাদ পাই না এমন উদাহরণ অসংখ্য পাওয়া যাবে। তাদের ব্রেন ভিন্নভাবে স্ক্রিপ্ট করা। তারা ডিফেন্সিভ এবং প্রটেক্টিভ মনস্তত্ত্বে¡ বিশ্বাস করে। তারা মনে করে, জীবন কিংবা অন্য মানুষ বিশ্বাসী নয়। ফলে তারা কখনই নিজেকে মেলে ধরে না। নিজেকে খুলে দেয় না পাখির ডানার মতো। তারা সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয় এক ধরনের কম্প্রোমাইজ জীবনযাত্রায়। তাদের জীবনে কখনই অভ্যাস-৬ বিষয়টি তৈরি হয় না। তারা ভিন্নভাবে প্রশিক্ষিত, ভিন্নভাবে স্ক্রিপ্টেড। কিন্তু এটাই হলো আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। জীবনে যে কতটা সম্ভাবনা ছিল সেটা আমরা কখনই এক্সপ্লোর করে দেখতে পেলাম না। সেই কুয়ার ভেতরেই কাটিয়ে দিলাম পুরোটা জীবন। আমাদের ভেতর সম্ভাবনা রয়ে যায় সুপ্ত, লুকানো এবং অনাবিষ্কৃত। যারা ইফেক্টিভ মানুষ নন তারা তাদের সুপ্ত ক্ষমতাকে ব্যবহার না করেই সারাটা জীবন কাটিয়ে দেন। তবে কারও কারও সামান্য কিছু অভিজ্ঞতা কিংবা স্মৃতি থাকতে পারে। ছোটবেলায় নয়ত বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দলবেঁধে খেলতে গিয়ে, নয়ত কোন বন্ধুর জন্য সাহায্য তুলতে গিয়ে, কিংবা বন্যা বা শীতের সময় সাহায্য নিয়ে কষ্টে জর্জরিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে। খুব সামান্য সময়ের জন্য হলেও তখন মানুষ সেই সিনারজি দেখতে পায়। কিন্তু ওটা যে কী ভীষণ ক্ষমতাশালী ছিল সেটা আর মনে রাখে না, কিংবা নিজের জীবনে এসে কাজে লাগায় না। তার মাথায় থাকে ওটা কেবল খেলার মাঠে, নয়ত টাকা তোলার কনসার্টেই ব্যবহার করতে হয়। একই বিষয়টি যে নিজের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যায় সেটা আমরা কখনই শিখি না। আমরা ধরে নেই ওটা কেবল বিপদের সময়ই ব্যবহার করা যায়। কিন্তু বিষয়টি মোটেও তা নয়। আপনি আপনার প্রাত্যহিক জীবনেও একই ফর্মুলা ব্যবহার করতে পারেন। আপনি অন্য মানুষের সঙ্গে সিনরাজি তৈরি করতে পারেন। এর জন্য প্রয়োজন হবে নিজের ভেতর প্রচ- আত্মবিশ্বাস, খোলা মন এবং নতুনকে স্বাগত করার মনোভাব। একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। সৃষ্টিশীল যে কোন বিষয়ই আগে থেকে পরিমাপ করা যায় না। আপনি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবেন না ঠিক কী ফলাফল আসবে। এটা অনেক ক্ষেত্রেই ধোঁয়াটে হতে পারে, টার্গেট লাগতেও পারে, নাও পারে, এমনকি ‘ট্রায়াল এ্যান্ড এরর’ পদ্ধতি ব্যবহার করে সামনে এগিয়ে যাওয়া লাগতে পারে। কারণ আপনি আসলেই জানেন না সামনে কী আছে! যে সকল মানুষের অজানার প্রতি ভয় কাজ করে, কিংবা ধোঁয়াটে পরিবেশে কাজ করার মানসিকতা তৈরি হয়নি এবং নিজের ভেতরে ইন্টিগ্রিটি তৈরি হয়নি, তারা পুরো বিষয়টি ‘খামাকা’ ভাবতে পারেন। তাদের কাছে এর কোন অর্থই বহন করে না এবং এই ধরনের একটি উচ্চ পর্যায়ের ক্রিয়েটিভ কার্যক্রমে নিজেকে যুক্ত করাটা সুখকর হবে না। যে কারণে অনেক মানুষ ‘স্টার্ট-আপ’ প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারে না। স্টার্ট-আপ অবস্থায় অনেক কিছুই ধোঁয়াশা থাকে। কিন্তু সবাই মিলে সেখান থেকে একটি চমৎকার সমাধান তৈরি করতে হয়। যদি তারা খুব ভাল একটি সমাধান তৈরি করে ফেলে তখন সবাই বুঝতে পারে তাদের ভেতর কেমন একটি সিনারজি কাজ করেছিল। আমাদের বেশিরভাগ মানুষই স্ট্রাকচার, সুনিশ্চিত এবং ভবিষ্যত দেখতে পাওয়া যায় এমন কার্যক্রম এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। তারা সিনারজির জন্য প্রস্তুত নয়। ॥ চার ॥ সিনারজি শেখার সবচেয়ে ভাল ক্ষেত্র হতে পারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা খুবই পুরনো ধ্যানধারণার। আর আমরা ছেলেমেয়েদের ভেতর এত বেশি প্রতিযোগিতা ঢুকিয়ে দেই যে, সেখানে আর সিনারজি ভাবা তো অনেক দূরে, সামান্য সহযোগিতার হাতও তৈরি হয় না। আমি স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি সামান্য প্রজেক্ট ওয়ার্ক, কিংবা হোমওয়ার্ক, নয়ত এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে কী সাংঘাতিক টানাপোড়েন। দলের একজন একটু বেশি কাজ করেছে, সেটা যেন কড়ায়-গ-ায় মেপে বুঝে নিতে হবে। যে ছাত্র কিংবা ছাত্রী একটু কম কাজ করল তাকে কম নম্বর পাওয়ানোর জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা। কেউ কারও নোট শেয়ার করবে না, কিংবা পুরনো বইটাও দিতে চাইবে না। এমন একটি বৈরি পরিবেশে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যটিই আর থাকে না। আমাদের মতো দেশগুলোতে শিক্ষার অর্থ হলো সার্টিফিকেট কিংবা নম্বর। এর বাইরে আমরা আর কিছুই ভাবতে পারি না- সেটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যেমন সত্যি, তেমনি মা-বাবা এবং শিক্ষার্থীদের দিক থেকেও সত্যি। শিক্ষার পুরো বিষয়টিই যেন বেশি নম্বর তোলার প্রতিযোগিতা। কিন্তু প্রতিযোগিতা আর সহযোগিতা একসঙ্গে কাজ করে না, করতে পারে না। আপনি যার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছেন তার সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন কিভাবে? শিক্ষার মূলমন্ত্র হলো যে ‘শিক্ষা’ সেটাই আমরা ভুলে গেছি। তাই আমরা শিখছি না কিছুই; কিন্তু সার্টিফিকেট নিচ্ছি প্রচুর, যা এই সমাজের জন্য তেমন একটা কাজে লাগছে না। আমাদের লোকসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, মুরগির সংখ্যাও একই হারে বাড়ছে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলোই তো হয়ে উঠতে পারত চমৎকার শিক্ষার শ্রেণীকক্ষ। একটি ক্লাস হয়ে উঠতে পারে পরম শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু, যদি সেখানে সঠিক সিনারজি তৈরি করা যায়। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, অনেক শিক্ষকই আমার এই কথাগুলো বুঝতে পারছেন না। তাদের কাছে শিক্ষার অর্থ হলো নিজের মতো করে বোর্ডে জটিল বিষয়টি লিখে যাওয়া আর সেমিস্টার শেষে আরও জটিল প্রশ্ন করে ছাত্রছাত্রীদের জীবনে ত্রাস তৈরি করা। আমি এমন শিক্ষকও দেখেছি যিনি যে টপিকটি ক্লাসে পড়াননি কিন্তু পরীক্ষায় সেই বিষয়ে প্রশ্ন দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের হয়রানি করে নিজের মহত্ত দেখিয়েছেন। এমন অসংখ্য সাইকো শিক্ষক পাওয়া যাবে আশপাশে যারা শিক্ষার মূল দর্শন থেকে কোটি কোটি মাইল দূরে অবস্থান করেন। কিন্তু কিছু শিক্ষক আছেন যারা ক্লাসে চমৎকার সিনার্জ তৈরি করতে পারেন। একই ক্লাসে শিক্ষক আর ছাত্রছাত্রী মিলে এমন একটি শেখার পরিবেশ তৈরি করেন যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েই একসঙ্গে নতুন কিছু তৈরি করেন, নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দেন, কোন একটি বিষয়ে নতুনভাবে গভীরে যেতে পারেন। বিষয়টি এমন নয় যে, শিক্ষক খুব ভাল লেকচার দিয়ে গেলেন, আর ছাত্রছাত্রীরা মন দিয়ে সেটা শুনে বিষয়টি বুঝে ফেলল। বিষয়টি এমন যে, ছাত্রছাত্রীরাও শেখার প্রক্রিয়াতে অংশ নেবে, তারা শিক্ষকের সঙ্গে মিলে ক্লাসে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করবে যার মাধ্যমে মূল বিষয়টি তো জানা হবেই, সেখান থেকে নতুন ধারণার জন্ম হবে, উদ্ভাবনী হবে, নতুন আইডিয়া আসবে, ক্রিয়েটিভিটি বিকশিত হবে এবং সবাই মিলে সম্মিলিত জ্ঞানের ভা-ার তৈরি করবে। ওখানে সবার মিলিত জ্ঞান হবে একেকজনের আলাদা জ্ঞানের সমষ্টির চেয়ে বেশি। প্রথম দিকে ছাত্রছাত্রীরা হয়ত ওভাবে অংশ নিতে চাইবে না। নিজেকে মেলে দিতে ভয় পাবে। কিন্তু একজন ভাল শিক্ষক সেই পরিবেশটুকু তৈরি করতে পারেন যেখানে সকল ছাত্রছাত্রী নিজেদের ভেতরের মানুষটিকে খুলে ধরতে এবং নিজের আইডিয়াগুলো সবার সঙ্গে শেয়ার করতে পারে। সেক্ষেত্রে অনেক কিছুই একটু এলোমেলো মনে হতে পারে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় সবাই যা শিখবে, সেটা আমাদের কল্পনারও বাইরে। পুরো দেশে হাতেগোনা কিছু শিক্ষক পাওয়া যাবে যারা এই দারুণ সিনারজি তাদের ক্লাসে তৈরি করতে পেরেছেন। ॥ পাঁচ ॥ ক্লাসরুম থেকে সিনারজি না শিখলেও কেউ কেউ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সেই সিনার্জ তৈরি করতে পেরেছেন। গ্লোবাল পয়েন্টে আমরা প্রচুর প্রতিষ্ঠান পাব যারা এই সিনারজি কাজে লাগিয়ে পাল্টে দিয়েছেন পৃথিবীকে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো গুগল, যা আমি আগেই বলেছি। আপনি একটি প্রতিষ্ঠানের ভেতর কর্মীদের নিয়ে যেমন সিনারজি তৈরি করতে পারেন, একইভাবে অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও সিনারজি তৈরি করতে পারেন। তবে আমাদের মতো দেশে এর প্রয়োগ খুব কম। আমাদের দেশে পার্টনারশিপের ব্যবসাই ঠিকমতো কাজ করে না, সেখানে ভিন্ন আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সিনারজি তৈরি করা আরও কঠিন। দুটো প্রতিষ্ঠান মিলে যে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করা যায় সেটা আমরা বুঝতে পারি না। আমাদের ভেতর যেহেতু সেই পারস্পরিক বিশ্বাসটুকু নেই, তাই এটা আর হয়ে ওঠে না। সবাই ভাবি, যেটুকু পারি নিজে নিজে করি; অন্যের সঙ্গে করতে গিয়ে ঠকার দরকার কী! আমাদের ভেতর এই মানসিকতা কাজ করে বলেই দেশে কোন গ্রেট কোম্পানি তৈরি হয়নি এখনও। একটি প্রতিষ্ঠান প্রচুর মুনাফা করলেই সেটা গ্রেট হয়ে যায় না। তারা বুঝতেই পারে না অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সিনারজি তৈরি করতে পারলে দু’জন মিলে ইতিহাস তৈরি করা যায়। বর্তমান বাংলাদেশে স্টার্ট-আপ নিয়ে প্রচুর কথা এবং আলোচনা হচ্ছে। অনেকেই নতুন ধ্যানধারণা নিয়ে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান তৈরির চেষ্টা করছেন। তারা নতুন সমস্যার সমাধান বের করতে চাইছেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত করে বলে দিতে পারি, তারা যদি কর্মীদের ভেতর কোন সিনারজি তৈরি করতে না পারেন তাহলে ওগুলো খুব সাদামাটা ধরনের কিছু ব্যবসা হবে। একটি মুদির দোকান দেয়ার নাম কিন্তু স্টার্ট-আপ নয়। আপনি স্টার্ট-আপ দেবেন নতুন কোন সমস্যা সমাধানের জন্য এবং সেখানে অনেক অজানা বিষয় থাকবে। সেই অজানা বিষয় সমাধান করতে হলে কর্মীদের ভেতর সিনারজি আনতে হবে। আর সেটা না করতে পারলে স্টার্ট-আপগুলো মারা যাবে। অনেকেই বলেন, স্টার্ট-আপ করার জন্য ফান্ডিং পাচ্ছেন না। কিন্তু তারা বুঝতে পারছেন না, একটি স্টার্ট-আপ সফল হওয়ার জন্য কর্মীদের ভেতর যে সিনারজি প্রয়োজন তারা সেটাই তৈরি করতে পারছেন না। আমি জানি, এই দেশে যখন সিনারজি শব্দটাই অভিধানে নেই সেখানে এই কনসেপ্ট তৈরি করা খুব কঠিন হবে। মানুষ একা একাই চেষ্টা করে যাবে। কিন্তু এমন একটা সময় আসবে যখন এই দেশের মানুষও এটা বুঝে ফেলবে, শিখে ফেলবে। তখন আমরা নিত্য-নতুন উদ্ভাবনী দেখতে পাব। ১৫ অক্টোবর ২০১৬ ুং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×